এমন পিরীতি কভু দেখি নাহি শুনি।
পরাণে পরাণে বান্ধা আপনা আপনি।।
দুষ্টু কোরে দুহূ কান্দে বিচ্ছেদ ভরিয়া।
আধ তিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া।।
—পদকার কে? কোন্ পর্যায়ের পদ? কবি মানুষী-প্রেম অপেক্ষা এই প্রেমের শ্রেয়তা কীভাবে প্রতিপাদন করেছেন?
উত্তর: উদ্ধৃত চরণ কটি ‘কবি চণ্ডীদাস’ বিরচিত। এটি চণ্ডীদাসের পূর্বরাগ রস পর্যায়ের পদ।
কৃষ্ণকে প্রথম দর্শনেই শ্রী রাধিকার মনে যে ভাব জেগে ছিল, তার জন্য মনের মাঝে উভয়ের মধ্যে যে একটি অচ্ছেদ্য সম্পর্ক রচিত হয়েছিল, তারই অভিব্যক্তি শ্রীরাধার এক সখী (কবি) অপর আর এক সখীর কাছে ব্যক্ত করছে।
বৈষ্ণব শাস্ত্রে, রাধাকৃষ্ণের প্রেম ‘পরকীয়া’ অর্থাৎ গোপন প্রেম। সমাজে স্বীকৃতি নেই, ফলে এ মিলন ক্ষণস্থায়ী। তাই আসন্ন বিচ্ছেদের কথা স্মরণ করে সখীরা জাগতিক প্রেমের আলোকে রাধা কৃষ্ণকে প্রতিপাদন করতে চেয়েছেন। উভয়েই গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়েও বিচ্ছেদের আশঙ্কায় মর্মাহত। একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েও ভাবছে উভয়ের আধ তিলের জন্য অদর্শন হলে তা মৃত্যুরই নামান্তর। মাছ যেমন জল ছাড়া বাঁচে না। রাধাও তেমন কৃষ্ণ পিরীতি ছাড়া বাঁচতে পারে না।
নগর বসালাম সাগর বাঁধিলাম
মাণিক পাবার আশে।
সাগর শুকাল মাণিক লুকাল
অভাগী করম দোষে।
—পদকার কে? কোন্ পর্যায়ের পদ? এই বেদনা কার? এবং কেন?
উত্তর : আলোচ্য অংশটির পদকার হলেন কবি জ্ঞানদাস।
চরণকটি ‘আক্ষেপানুরাগ’ রস পর্যায়ের পদ।
এবেদনা বৈক্ষ্ণব পদ সাহিত্যের নায়িকা শ্রীরাধিকার।
লৌকিক নিয়মে শ্রীকৃষ্ণের নিত্য প্রিয়া রাধিকা পরকীয়া নায়িকা। প্রিয়কে লাভ করতে রাধাকে তাই গোপন কষ্ট সাধ্য পথ বেছে নিতে হয়। কিন্তু প্রাণপাত পরিশ্রম করেও একান্ত নিজের মতো করে না পাওয়ার জন্য রাধিকার এই আক্ষেপ। আপন অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে উপমার সাহায্যে বলেছেন-কৃষ্ণরূপ মাণিক পেতে নগর বসিয়েছেন, সাগর বেঁধেছেন, কিন্তু ভাগ্য দোষে সে সাগর শুকিয়েছে মাণিকও আত্মগোপন করেছে।
আজু কেন দেখি বিপরীত।
হবে বুঝি দোঁহার চরিত।।
চণ্ডীদাস মনে মনে হাসে।
এ রূপ হইবে কোন দেশে।।
—পদকার কে? কোন্ পর্যায়ের পদ? এই পদের বৈশিষ্ট্য কি? অংশটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : চণ্ডীদাস।
‘বংশী শিক্ষা ও নৃত্য শিক্ষা : সখীরা (কবি) চিরকাল দেখে এসেছেন শ্যামসুন্দরই বাঁশী বাজিয়েছেন। কিন্তু আজ দেখা গেল সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। আজ যিনি বাঁশী বাজাচ্ছেন তিনি শ্যাম নয় রাধা। বস্তুত কৃষ্ণের পোষাক পরেই কুঞ্জে রাধা বংশী শিক্ষা করছেন।
(এ বিপরীত চিত্রে সখীরা বিস্মিত)। একদা কৃষ্ণের কাছে রাধা শিক্ষা পেতে চাইলে কৃষ্ণের অনুযোগ-রাধাকে কৃষ্ণের বেশ ধারণ করতে হবে। সবার অগোচরে তাই রাধাকৃষ্ণ পরস্পরের বেশ পরিবর্তন করে। এই অপরিচিত বেশভূষা দেখে সখীরা ভাবতে শুরু করেছে—এঁদের চরিত্র বুঝি এমন। অন্যে তার স্বরূপ বুঝবে না। কবি চণ্ডীদাসও মনে মনে হাসছেন আর ভাবছেন বোধহয় অন্য কোনও দেশে এমন রাধা নেই।
রাতি কৈনু দিবস, দিবস কৈনু রাতি …
এমন ব্যথিত নাই ডাকি বন্ধু বলি।।
—পদকার কে? কোন্ পর্যায়ের পদ? এই ব্যাকুলতার যথাযথ ব্যাখ্যা দাও।
উত্তর : কবি চণ্ডীদাস।
আক্ষেপানুরাগ : কৃষ্মকে পেতে রাধা অসাধ্য সাধনে তৎপর। দিনকে রাত, রাতকে দিন করেছে তবু কৃষ্ণের প্রেমের স্বরূপ সে বুঝতে পারেনি, নিজেকে অভাগিনী বিবেচনা করে স্রোতের শ্যাওলার সঙ্গে তুলনা করেছে। কারণ শ্যাওলা যেমন আপন ইচ্ছায় যেতে পারে না, স্রোতের টানে ভেসে যায়, অনুরূপভাবে রাধাও সংসারে ফিরে যেতে ইচ্ছা পোষণ করেও ফিরতে পারে না। সে যেন বিশ্ব সংসারে একাকী। কৃষ্ণের মত প্রেমনিধি থেকেও নেই। এমন কোনও দরদী বন্ধু নেই কাছে তো তাকে একটু আপন জনের মতো বিষাদে সান্ত্বনা দেবে।
পুন পুন গতাগতি করু ঘর পথ।
খেনে খেনে ফুলবনে চলই একান্ত।।
ছলছল নয়ন কমল—সুবিলাস।
নব নব ভাব করত পরকাশ।।
—পদকর্তা কে? কোন শ্রেণীর পদ ? কাকে উদ্দেশ্য করে কবি বলেছেন? এ পদের বৈশিষ্ট্য কি?
উত্তর : রাধামোহন ঠাকুর।
গৌরাঙ্গ বিষয়ক গৌরচন্দ্রিকার পদ। গৌরাঙ্গকে উদ্দেশ্য করে কবি এই উক্তি করেছেন।
রাধাভাবে ভাবিত গৌরাঙ্গ দেবের মধ্যে শ্রীমতী রাধিকার পূর্বরাগ-আর্তি ফুটে উঠেছে। কৃষ্ণের পুনদর্শনের আকাঙ্ক্ষায় রাধার তনু মনে যে ভাব সঞ্চারিত হয়েছিল। গৌর দেহেও সেই ভাব সু-পরিস্ফুট। গৌরাঙ্গ দেব একবার ঘরে আসছেন আবার পথে বেরিয়ে যাচ্ছেন, কখনো ফুলবনে একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর কমলের মতন নয়ন যুগল ছলছল করছে এবং প্রতি মুহূর্তে অপরূপ ভাব সঞ্চারিত হচ্ছে।
কত মধু যামিনী রভসে গোঁয়ায়লু
না বুঝলু কৈছন কেল।
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু
তব হিয়া জুড়ন না গেল।।
—কোন্ কবির রচনা ? কোন শ্রেণির পদ? তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : কবি বল্লভের রচনা।
পূর্বরাগ পর্যায়ের : কোনও এক সখী শ্রীরাধার কাছে জানতে চায় প্রেমের স্বরূপ কি? তাতে রাধা জানায় প্রেম-প্রীতি কি তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, তা উপলব্ধির অগোচর। রাধার ভিন্ন কোনও সত্তা নেই তার জীবন কৃষ্ণময়। তবু কৃষ্ণ প্রেমের স্বরূপকে সে আজও বুঝতে পারেনি। কত বসন্ত রাত্রি কৃষ্ণ-সঙ্গিনী হয়ে রাধিকা কাটিয়েছে, কিন্তু কৃষ্ণের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেনি। লক্ষ লক্ষ যুগ হৃদয়ে হৃদয় যোগ করে কাটিয়েছে তবু তার হৃদয় তৃপ্ত হয়নি, কারণ কৃষ্ণের স্বরূপ হল—’অবাঙ মানস গোচরঃ’
জল বিন্দু মীন থেকে কবহু না জিয়ে।
মানুষে এমন প্রেম কোথা না শুনিয়ে ।।
ভানু কমল বলি সেহো হেন হয়।
হিমে কমল মরে ভানু সুখে রয়।।
—কবি কে? কোন শ্রেণীর পদ ? তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
উত্তর : চণ্ডীদাস।
পূর্বরাগ পর্যায়ের : রাধা কৃষ্মের প্রেম তুলনাহীন, মনুষ্য জগতে এমন প্রেমের দৃষ্টান্ত ‘মেলে না’। কারণ ক্ষণিকের জন্য উভয়ের বিচ্ছেদ ঘটলে তা মৃত্যুর মত যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। জলছাড়া যেমন মাছ বাঁচতে পারে না কৃষ্ণ-প্রেম বিরহিণী রাধিকারও অনুরূপ দশা। বাস্তবিক সূর্য ও পদ্মের মধ্যে অপরূপ প্রেমের সন্ধান করা হয়ে থাকে, অর্থাৎ সূর্যোদয়েই পদ্ম বিকশিত হয়। সূর্যের বিরহ পদ্ম সইতে পারে না বলে প্রভাতের সূর্যালোকেই কমল ফুটে ওঠে। কিন্তু রাধা কৃষ্ণের প্রেমের সঙ্গে এর তুলনা চলে না। কারণ হিমে কমলের অপমৃত্যু ঘটলেও পুনঃ সূর্যোদয়ের তা অন্তরায় হয় না। অর্থাৎ সূর্যের বিরহ কমল না সহ্য করতে পারলেও কমলের অভাব সূর্য গ্রাহ্যই করে না। কিন্তু রাধা-কৃপ্রেম এমন অচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত যে প্রেমিক-প্রেমিকার তিলেক অদর্শন মৃত্যুর নামাস্তর।
করম বিপাকে গতাগতি পুন পুন
রতি রহ তুয়া পরসঙ্গ।
—কবি কে? কোন্ শ্রেণির পদ? করম বিপাক কি? গতাগতি পুনঃপুন কেন? ভক্তচিত্তের অভিব্যক্তি কী বুঝাও।
উত্তর : বিদ্যাপতি।
প্রার্থনা বিষয়ক : মানুষ কর্মানুযায়ী ফল লাভ করে, তা কর্ম বিপাকে রূপান্তর লাভ করেছে।
এই কর্ম দোষে মানুষ বারে বারে পৃথিবীর বুকে জন্মের মধ্য দিয়ে ফিরে আসে। এটাই কবির কাছে ‘গতাগতি পুনপুন’। জগৎপতি হলেন স্বয়ং মাধব। তুচ্ছাতিতুচ্ছ জীবকে আশ্রয় দেবার দায় তাঁর। কবি কর্ম দোষে বা কর্মগুণে পৃথিবীতে বারে বার জন্মগ্রহণ করতে পারেন, তবে তাঁর কামনা প্রতি জন্মেই যেন ভগবৎ প্রসঙ্গে তাঁর মতো থাকে। এই উক্তির মধ্যে জন্মান্তরবাদের সুর ধ্বনিত হয়েছে।
ত্রিভুবন-মণ্ডন কলিযুগ-কাল
ভুজগ-ভয়-খণ্ডন রে।….
—কবি কে? কোন্ পর্যায়ের পদ? কার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে? তাৎপর্য কি?
উত্তর : গোবিন্দ দাস।
গৌরাঙ্গ বিষয়ক : গৌরাঙ্গ দেব প্রসঙ্গে বলা হয়েছে।
গৌরাঙ্গ কে প্রত্যক্ষ দর্শনথেকে কবি বঞ্চিত হলেও কল্পনায় তাঁর স্বরূপ প্রত্যক্ষ করেছেন। গৌরাঙ্গের স্বরূপ এমনই—স্বর্গমর্ত পাতাল এমনকি কাল-সর্পরূপী কলিযুগ এর (গ্লানিময়) ভয় থেকে সাধারণ মানুষকে উদ্ধার করতে তিনি তৎপর। সমগ্র সমাজ সংসার পুলকিত আকুল কলেবরে তাঁর প্রতি প্রেম গদ গদ চিত্ত। কারণ গৌরাঙ্গদেব স্বয়ং হাসি হাসি মুখে মধুর ভাষণে অমৃত বর্ষণ করে চলেছেন। তাতে মন্দাকিনী-স্রোতের মত দুনয়নে অশ্রুবারি রাশি ঝরে পড়ছে। অর্থাৎ গৌরাঙ্গের সৌন্দর্য ধারণাতীত, তাঁর সীমা অনুভব করা কখনোই সম্ভব নয়।
কলঙ্কী বলিয়া ডাকে সব লোকে
তাহাতে নাহিক দুখ।
তোমার লাগিয়া কলঙ্কের হার
গলায় পরিতে সুখ।।
—কবি কে? কোন্ শ্রেণির পদ? কাকে কেন কলঙ্কী বলা হয়েছে?
উত্তর : চণ্ডীদাস।
নিবেদন পর্যায়ের পদ : কৃষ্ণ প্রেমে উন্মাদিনী রাধিকা সমাজ সংসার সব ভুলেছেন—কারণ কৃষ্ণই তাঁর অভীষ্ট। কৃষ্ণ যেহেতু পর পুরুষ, সেই হেতু, রাধার এই আসক্তি সাধারণের কলঙ্করূপে প্রতিপন্ন হয়েছে। রাধা অপরের বিবাহিতা পত্নী। তাইতো সে কৃষ্ণ কলঙ্কিনী। তবে রাধিকা এই কলঙ্কের জন্য ব্যথিত বা চিন্তিত নয়, বরং কৃষ্ণপ্রেমে যদি তিনি নিজেকে ডুবিয়ে দিতে পারেন তবে স্বপ্ন-সাধ ভার পূরণ হবে এবং তার জন্য যে কলঙ্ক সেই কলঙ্কের হার নিজ কণ্ঠে ধারণ করে সুখ অনুভব করবেন। তিনি জানেন কৃষ্ণপ্রেম তাঁর নিকট চরম এবং পরম কামনার ধন।
দেখ সখি কো ধনি সহচরী মেলি ।
হামারি জীবন সঞে করতহি খেলি।।
—বক্তা কে? কোন্ শ্রেণির পদ? কবি কে? ‘হামারি জীবন সঞে’ উক্তিটির তাৎপর্য কি?
উত্তর : শ্রী কৃষ্ণ।
পূর্বরাগ (শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ) শ্রেণির : গোবিন্দ দাস।
শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমতী রাধিকার দর্শন লাভ করেছেন তাঁকে দেখে শ্রীকৃষ্ণের মনে হয়েছে রাধার দেহ জ্যোতি যেন বিদ্যুৎচমকের মতো। শ্রীমতীর দৃষ্টিতে ফুঠে ওঠে স্থলপদ্ম রাজি। শ্রীকৃষ্ণের মনে হয়েছে-‘হামারি জীবন সঞে’ অর্থাৎ তাঁর জীবন নিয়ে শ্রীরাধা খেলা করছেন। শ্রীমতীর প্রথম দর্শনের পরই শ্রীকৃষ্মের মনে পূনঃ দর্শনের এবং মিলনের সাধ জেগে ওঠায় বিরহ কাতর কৃষ্ণ চিত্তে এমন ভাব জাগ্রত হয়েছে।
আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লু পেখলু পিয়ামুখ চন্দা।
জীবন যৌবন সফল করি মানলু দশ দিশা ভেল নিরদ্বন্দ্বা।।
– কবি কে? কোন্ পর্যায়ের পদ? তাৎপট কি ?
উত্তর : বিদ্যাপতি।
ভাবোল্লাস ও ভাব সম্মিলন : শ্রীকৃষ্ণ মথুরা চলে গিয়েছেন, ফিরে আসেননি। রাধিকার চলছে বিরহদশা। কিন্তু বৈষ্ণুব কবিরা তাতে মনপূত নন। তাই কল্পনায় তাঁরা রাধা-কৃষ্ণের একটা ভাগবত সম্মেলন ঘটিয়েছেন যাকে স্বপ্ন সম্ভোগ’ বলে। রাধা কৃষ্ণের মিলন বাস্তব জগতের নয়, ভাব জগতের। কাজেই প্রেমিকার মনে অনুরূপ ভাবোদয় ঘটতে পারে কেবল মাত্র স্বপ্নাবস্থায়। রাধিকা তাই আজ রাত শেষ হওয়ার আগেই স্বপ্নে প্রিয় শ্রীকৃষ্মের মুখ দর্শন করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সমস্ত জীবন যৌবন সফল ও স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে উঠলো এবং তাঁর সমস্ত মনের দ্বিধা দূর হয়ে গেল। অর্থাৎ রাধা-জীবনের কোনদিকেই কোনও দ্বন্দ্ব নেই, সবই প্রসন্নতার ইঙ্গিতবহ।
যাদবেন্দ্র সঙ্গে লইও রাঙা পানই হাতে থুইও
বুঝিয়া যোগাবে রাঙ্গা পায়।
—কবি কে? কোন্ পর্যায়ের পদ? তাৎপর্য কি?
উত্তর : যাদবেন্দ্র
বাল্যলীলা পদ : মা যশোদা বালক শ্রীকৃষ্ণকে বলছেন-পরাণের পরাণ নীলমণি, আমার শপথ রইল—তুমি ধেনুর আগে যেয়ো না। মোহন বেণু বাজিও, যেন আমি ঘরে বসে শুনতে পাই। গোচারণে ক্ষুধা পেলে চেয়ে নিও, পথের দিকে তাকিয়ে চলো। কানু, তুমি কারো কথায় বড় ধেনু ফিরাতে যেওনা—মা মিনতি করে বলছে—তরুর ছায়ায় থেকো। গায়ে যেন রোদ না লাগে। কবিও আকৃতিও জানাচ্ছেন—যাদবেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে তার হাতে দিয়ো রাঙা পানই (পাদুকা), সময় বুঝে রাঙা পায়ে পরিয়ে দেবে। অর্থাৎ মাতৃহৃদয়ের ব্যাকুলতা এবং সদা জাগ্রত অনুপুঙ্খ পরিচয়ের মধ্য দিয়ে বৈষ্ণব কবি যাদবেন্দ্র এখানে মানবিকতা বোধের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন সৃষ্টি করেছেন।
রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল।
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।।
—কবি কে? কোন্ পর্যায়ের পদ? তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
উত্তর : জ্ঞানদাস।
পূর্বরাগ: শ্রীমতী গিয়েছিলেন কদম্বতলে; সেখানে গিয়ে কৃষ্মের দর্শন পাবার পর থেকে তাঁর মনে পুনঃ কৃষ্ণদর্শনের আর্তি জেগেছে। দর্শনমাত্র কৃষ্ণ শ্রীমতীর মনপ্রাণ হরণ করেছেন। শ্রীকৃষ্ণের রূপসাগরে রাধার আঁখি ডুবে মরেছে আর কৃষ্ণের যৌবন বনে বিচরণ করতে রাধার মনমৃগ পথ হারিয়ে ফেলেছে। কৃষ্ণ-মলন কামনায় উথাল পাথাল করছে।
কর-কঙ্কণ পণ ফণিমুখ বন্ধন
শিখই ভুজগগুরু পাশে
–কবি কে? কোন্ পর্যায়ের পদ? তাৎপর্য কী?
উত্তর : গোবিন্দ দাস।
অভিসারকৃষ্ণের উদ্দেশে অভিসারের পূর্বে রাধা নিজেকে অনুশীলনের মধ্য দিয়ে প্রস্তুত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। পদ্মের মতো কোমল পদতলে কাঁটা ফুটিয়ে, কাপড়ের টুকরো দিয়ে পায়ের নুপূর বেঁধে, কলসের জল ঢেলে পিছল করে রাধা তাতে পা টিপে টিপে চলছেন। এমনকি এই অভিসারের জন্যে মন্দিরে রাত জাগছেন। অন্ধকারে হাঁটতে হবে জেনে চোখে হাত চাপা দিয়ে চলা অভ্যাস করছেন। অন্ধকার পথে অনেক বিষাক্ত সর্পের সমাহার। কামড় দিলেই বিপদঁ, তাই তিনি হাতের কঙ্কন বাঁধা রেখে সাপের ওঝার কাছে সর্প বশীকরণের মন্ত্র শিখতে শুরু করেছেন। অর্থাৎ সকল বাধা অতিক্রম করবার জন্য তিনি কীভাবে মহড়া দিচ্ছেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাই এর মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছে।
মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী
ফাটি যাওত ছাতিয়া
—কবি কে? কোন্ পর্যায়ের, তাৎপর্য কী?
উত্তর : বিদ্যাপতি।
মাথুর : ঘোর বর্ষার দিনে প্রিয় সমাগমের জন্য বিরহিনী নারীর হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিন্তু রাধিকার প্রাণ প্রিয় শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় প্রবাসী, কাজেই প্রিয় মিলনের কোনও সম্ভাবনা নেই। একদিকে বর্ষার আগমনে দাদুরী আর ডাহুকীর উল্লাসের সীমা নেই, তারা তাদের প্রিয়জনকে আহ্বান জানাচ্ছে। তাদের এই আহ্বান রাধার হৃদয় তার বেদনাকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওরা প্রিয়র সান্নিধ্য লাভ করবে, আর, রাধাই শুধু বিরহ তাপিত বক্ষে কালযাপন করবে—ভাবতে গিয়ে, রাধার হৃদয় দীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
অভিনব হেম কল্পতরু সঞ্চরু
সুরধুনী তীরে উজোর।
—কবি কে? কোন পর্যায়ের? তাৎপর্য কি?
উত্তর : গোবিন্দ দাস।
গৌরাঙ্গ বিষয়কঃ সাক্ষাৎ দর্শন থেকে বঞ্চিত হলেও কল্পনার দৃষ্টিতে কবি গৌরাঙ্গদেবের রূপ নির্মাণ করেছেন। তিনি মানস নেত্রে দেখছেন, হেম নির্মিত চলমান কল্প-বৃক্ষ রূপে শ্রীগৌরাঙ্গ সুরধুনীর তীরে আলোক দান করছেন। কবি-কল্পনায় এখানে যেন গৌরকান্তি গৌরকিশোরের আসল স্বরূপ ধরা পড়েছে। স্বর্ণকান্তি গৌর সুন্দরকে দেখে যাতে কারো এটিকে প্রকৃত বৃক্ষ বলে ভ্রম না হয়, তার জন্য কবি শ্রীচৈতন্যের চলমান জীবন্ত রূপটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন এবং তার দেহে কাস্তিতে সুরধুনীর তীরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
কত চতুরানন মরি মরি যাওত
ন তুয়া আদি অবসানা।
-কবি? কোন্ পর্যায়ের? তাৎপর্য?
উত্তর : বিদ্যাপতি।
প্রার্থনা : জগৎপতি মাধবের নিকট সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে বিদ্যাপতি উদ্ধার পেতে চেয়েছেন। জগতে তিনিই একমাত্র সৎ এবং সত্য, তাই উদ্ধার কর্তাও তিনিই। জগতের স্রষ্টা ব্রহ্মার, আদি অস্ত থাকলেও পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কোনও আদি অন্ত নেই। অসংখ্য তরঙ্গ যেমন সমুদ্রের বুকে উত্থিত হয়ে আবার সমুদ্রের বুকে হারিয়ে যায় অনুরূপভাবে অজস্র জীবকূল তাঁর দ্বারা সৃষ্ট হয়ে তাঁর মধ্যেই সমাহিত হচ্ছে। তাই কবির দৃষ্টিতে ভগবান হলেন সমুদ্র আর মনুষ্যকুল তরঙ্গ মাত্র। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কবির হিন্দু দর্শন-বিষয়ক পাণ্ডিত্যের যথাযথ পরিচয় মেলে।
সুন্দরী কৈছে করবি অভিসার।
হরি রহ মানস সুরধুনী পার।
—কবি কে? কোন্ পর্যায়ের? তাৎপর্য কি?
উত্তর : গোবিন্দ দাস।
অভিসার : শ্রীমতী অভিসার যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর সখী এই দুর্যোগময়ী রজনীর বিভীষিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলে এখনই বাইরে বেরুনো মানেই মৃত্যুকে ডেকে আনা। কিন্তু রাধা অনড়। সখী শেষ চেষ্টা করতে ছাড়ে না। জিজ্ঞাসা করে ‘তুমি কেন অভিসার করবে?’ যার জন্য অভিসার করবে সেই প্রাণধন শ্রীকৃষ্ণ তো মানস সুরধুনী নামক হূদের অপর পারে রয়েছেন; তিনি তো কুঞ্জে এখন নেই, যেখানে রয়েছেন সেখানেও তোমার পক্ষে পৌঁছানো অসম্ভব। তবে এর মমার্থ হল—মন-যমুনার অপর পারে যে পরমপুরুষ থাকেন তাঁকে পেতে হলে মনের বাধা তো অতিক্রম করতেই হবে।
মরিয়া হইব শ্রীনন্দের নন্দন
তোমারে করিব রাধা।।
—কবি কে? কোন্ পর্যায়ের? বিশ্লেষণ কর?
উত্তর : চণ্ডীদাস।
প্রেমবৈচিত্র্য : প্রেম জর্জর চিত্তে রাধিকা প্রেমধন কৃষ্ণকে আক্ষেপের সুরে জানাচ্ছেন বধু, আমার মনের দুঃখ তোমাকে কেমন করে জানাবো। অল্প বয়সে যখন ভালো করে বুঝতে শিখিনি তখন তোমার প্রেমে মগ্ন থেকেছি। যার জন্য ঘরেতে দুদণ্ড স্থির থাকতে পারিনি। এ যে কি নিদারুণ জ্বালা তা তোমাকে আমি বোঝাতে পারবো না। পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তবে সাধনার জোরে প্রথমে সাগরে ডুবে মরবো, তারপর আমি শ্রীনন্দের নন্দন হয়ে জন্ম নেব। আর হে প্রাণ প্রিয় বঁধু, তোমাকে করবো রাধা, এবং প্রেম করেই তোমাকে ছেড়ে যাবে তখন বুঝবে রাধা হয়ে জন্মানো কি জ্বালা।
বঁধু কি আর বলির তোরে।
জীবনের মরণে জনমে জনমে
প্রাণনাথ হইও তুমি।।
—কবি কে? কোন্ পর্যায়ের? তাৎপর্য কী?
উত্তর : চণ্ডীদাস।
নিবেদন : কৃষ্ণ প্রেম পাগলিনী রাধিকা অনেক ভেবে দেখেছেন যে, এই বিশ্ব ভূ মণ্ডলে কৃষ্ণ বিনা তাঁর অন্য কোন গতি নেই। কৃষ্ণ ছাড়া তাঁর পক্ষে বেঁচে থাকা নিরর্থক। তাই তো আপনাকে উজাড় করে দেবার ভঙ্গিতে কৃষ্ণ সমীপে শ্রীমতী রাধিকা বলছেন—ওহে বন্ধু, তোমাকে আর কি বলবো? বলার মতো তেমন আর কিছু তো নেই। শুধু এই নিবেদন করি যে-জীবনে মরণে জন্মে জন্মে তুমিই কেবল আমার প্রাণনাথ হইও। আর আমি কিছু চাইনা, আমি তোমাতেই আত্মসমর্পিত। এইভাবে রাধা তাঁর নিজস্ব সত্তার লোপ সাধন করে দিয়ে জন্ম-জন্মান্তরের জন্য শ্রীকৃষ্ণের মিলন কামনা করেছেন।
“অভিনব হেম কল্পতরু সঞ্চরু
সুরধুনী তীরে উজোর”
–কার সম্বন্ধে একথা বলা হয়েছে? কেন বলা হল? এটি কোন্ পর্যায়ের পদ?
উত্তর : এখানে গৌরাঙ্গ সম্বন্ধে তার রূপের বর্ণণা দিয়েছেন পদকর্তা গোবিন্দ দাস।
গৌরাঙ্গ যেন ভাগীরথীর তীর উজ্জ্বল করে এক অপূর্ব স্বর্ণময় কল্পবৃক্ষের মতো সঞ্চরন করছে, আর ভ্রমরের মত বিভোর ভক্তগণ তার চঞ্চল চরণ কমল তলে গুঞ্জন ধ্বনি তুলছে। পরিমলের লোভে সুর এবং অসুর সবাই এখানে ছুটে আসছে।
এটি গোবিন্দ দাসের ‘গৌরাঙ্গ বিষয়ক’ পদের অন্তর্গত।
তাকর চরণে দীনহীন বঞ্চিত
গোবিন্দ দাস রহুঁ দূর।।
–কেন গোবিন্দ দাস একথা বলেছেন? বৈষ্ণবীয় বিনয় ছাড়াও তার অন্য কোনো কারণ আছে কি?
উত্তর : এটি গোবিন্দদাসের ‘গৌরাঙ্গ বিষয়ক’ পদের অন্তর্গত। গৌরাঙ্গের রূপ ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ সমস্ত ভক্তগণ। তার চরণ পদ্ম লাভ করার জন্য ভক্তভ্রমরের দল ছুটে যেতো তার কাছে। গৌর কিশোর সর্বক্ষণ প্রেমরত্নরূপ ফল বিতরণ করে অখিল ব্রাহ্মণ্ডের মনোরথ পূর্ণ করেছেন। কিন্তু সেই গৌরাঙ্গের রূপ ও রস রূপফল থেকে বঞ্চিত হলেন। অর্থাৎ গৌরাঙ্গের মৃত্যুর পরে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। ফলে, তাঁকে দেখার সুযোগ তার হয়নি। তাই গোবিন্দদাস গৌরাঙ্গের পাদপদ্ম লাভ থেকে বঞ্চিত রইলেন।
‘নটবর গৌরকিশোর’ কাকে বলা হয়েছে? নটবর কাকে বলা হয়? গৌরকিশোর কে নটবর বলা হল কেন?
উত্তর : গৌরাঙ্গকে নটবর বলা হয়েছে। তাঁর দেহের ঘর্ম মধুর মত বিন্দু বিন্দু ক্ষরিত হচ্ছে। আর তা থেকে কদম্বের মত ভাবরাজি বিকশিত হচ্ছে। তাঁর রূপের বর্ণনায় কবি গোবিন্দদাস নটবরের সঙ্গে তুলনা করে গৌরাঙ্গকে নটবর গৌর কিশোর বলেছেন।
নীরদ নয়নে…. ইত্যাদি কবিতাটিতে কোন ‘গৌরমহিমা’ প্রকটিত হয়েছে?
উত্তর : পদটি গোবিন্দদাসের গৌরাঙ্গ বিষয়ক পর্যায়ের পদ। এতে রয়েছে গৌরাঙ্গে র রূপের বর্ণনা। তার রূপ এই রকম—মেঘের ন্যায় নয়ন থেকে ঘন ঘন বারি সিঞ্চিত হচ্ছে। তার দেহের ঘর্মর্জল মধুর মত বিন্দু বিন্দু ক্ষরিত হচ্ছে। আর তা থেকে কদম্বের মত ভাবরাজি বিকশিত হচ্ছে। নটবরের মত তিনি ভাগীরথীর তীরে উজ্জ্বল করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর সেখানে ভক্ত ভ্রমরেরা ভিড় করছে। গৌরকিশোর তাদের মনোরথ পূর্ণ করছেন।
‘আজু হাম কি পেখলু নবদ্বীপ চন্দ’—এই কবিতাটি কোন ভাষায় লেখা? এর ক্রিয়াপদগুলির বৈশিষ্ট্য কি? কার রচনা? কোন পর্যায়ের পদ? নবদ্বীপ চন্দ কে? এর কেন কবি উহাকে নবদ্বীপ চন্দ বলেছেন তাঁর গূঢ়ার্থ সংক্ষেপে বলো।
উত্তর : পদটি গৌরচন্দ্রিকা পর্যায়ের, পদকর্তা হলেন রাধামোহন ঠাকুর। গৌরাঙ্গকে নবদ্বীপচন্দ বলা হয়েছে।
রাধাভাবে ভাবিত শ্রীগৌরাঙ্গ হাতের ওর মুখ ন্যাস্ত করে আছেন—তিনি বারবার ঘরের বাইরে যাচ্ছেন আর আসছেন। আবার কখনো কখনো একা উদ্যানে পরিভ্রমণ করেন। তাঁর পদ্মের মত দুটি চোখে নানা ভাব প্রকাশ পাচ্ছে। পুলকজাত রোমাঞ্চে তার সমস্ত দেহ শিহরিত হয়ে উঠেছে। পদকর্তা রাধামোহন ঠাকুর এই প্রেমের তল খুঁজে পাচ্ছেন না। এখানে পূর্ব রাগের ভ বে ভাবিত নবদ্বীপচন্দ্র শ্রীগৌরাঙ্গ। রাধার প্রেমে গৌরাঙ্গ এখানে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। তাই পদকর্তা এই প্রেমের তল খুঁজে পাচ্ছেন না।
“নাম পরতাপে যার ঐছন করল গো”–এখানে নাম প্রসঙ্গটি কটি রূপের কথা বলা হয়েছে?
উত্তর : দ্বিজ চন্ডীদাস-রচিত এই পদটা বৈষ্ণব পদাবলীর ‘পূর্বরাগ’ এর অন্তর্ভুক্ত। পূর্বরাগের একটা বিশেষরূপ আছে নামানুরাগ এবং শ্রবণানুরাগ। শুধুমাত্র নামের উচ্চারণে রাধা মুগ্ধ হয়েছেন। রাধা কোনও সামান্য নায়িকা নন, বৈষ্ণব সাহিত্য দর্শনে তিনিই আদর্শ নায়িকা। বস্তুত এই নামের মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরাগের যে রূপ রাধার কাছে প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে।
“যেখানে বসতি তার নয়নে দেখিয়া গো’
যুবতী ধরম কৈছে রয়”
—রাধার মানসিক রূপ এই উক্তির আলোকে প্রকাশ করো।
উত্তর : পদটি ‘পূর্বরাগ’ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। পদকর্তা দ্বিজ চন্ডীদাস। এই শ্যামনামে এত মধু আছে যে নাম জপ করতে করতে রাধার, দেহ অবশ হয়ে যায়, যার নামের প্রতাপে যুবতীর এই অবস্থা, তার অঙ্গ স্পর্শে যে, কী হবে তা তো ভাবতেই পারে না রাধা। যে দেহে এই নামের বাস সেই দেহ দর্শনে যুবতীর ধর্ম কিভাবে আর থাকবে? সেই নামকে রাধা ভুলে যেতে চান কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারে না।
“দরশ পরশ লাগি আউলাইচ্ছে গা’’ –‘আউলাইছে’ কথার অর্থ কী? এই উক্তির কাব্যরসের মূল কোথায়?
উত্তর : আলোচ্য পদটি ‘পূর্বরাগ’ পর্যায়ভুক্ত। পদকর্তা জ্ঞানদাস। আউলাইছে কথার অর্থ হল আকুল হয়েছে অর্থাৎ এলিয়ে পড়েছে।
পদটি পূর্বরাগের অন্তর্ভুক্ত হলেও পদটাকে রসোদগারের একটা উত্তম দৃষ্টান্ত বলে গ্রহণ করা হয়।
অনস্ত বাসনার অনস্ত হাহাকার মাত্র চার ছত্রের মধ্যে, যেভাবে ধরা পড়েছে তা নিখিল মানবের বেদনা প্রস্ফুটিত হয়েছে। কৃষ্ণের দর্শন ও স্পর্শ লেগে রাধার শরীর আকুল হয়ে উঠেছে। তত্ত্বগত অর্থ হল ভগবানের দর্শনের ভক্তের মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। যার মধ্য দিয়ে নিখিল মানবের বেদনা প্রকাশিত হয়েছে।
“সখি কি পুছসি অনুভব মেয়ে”—কবিতাটি কোন পর্যায়ের পদ? এই পর্যায়ের রাধার মানস বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দাও।
উত্তর : পদটি ‘পূর্বরাগ’ পর্যায়ের পদকর্তা হলেন, কবিবল্লভ।
রাধিকা তার সখিকে বলছেন—তুমি আমার অনুভূতি জানতে চাইছো? কিন্তু ভালোবাসার অনুভব তো ব্যাখ্যা করে বোঝানো যায় না। এতো কোন জড় বস্তু নয় যে এর কোন একটা স্থায়ী রূপ থাকবে। প্রতি মুহূর্তে ভালোবাসার রূপ পালটাচ্ছে, নব থেকে নবতর রূপে প্রকাশিত হচ্ছে, সেই ভালোবাসা, প্রীতি, অনুরাগকে কি কথা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়? যা তিলে তিলে নতুন রূপ লাভ করছে তাকে তো প্রকাশ করা যায় না।
‘কন্টক গাড়ি কমল সম পদতল’— ইত্যাদি পদে যে অভিসার প্রস্তুতির চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
উত্তর : পদটি অভিসার পর্যায়ভুক্ত গোবিন্দ দাসের রচিত পদ।
আঙিনার মাঝখানে কাঁটা পুঁতে কাপড়ের টুকরো দিয়ে পায়ের নূপুরে বেঁধে, গাগরির জল ঢেলে আঙ্গিনাকে পিছল করে শ্রীমতি রাধা পা টিপে টিপে চলছেন। হে মাধব, তোমার অভিসারের জন্য মন্দিরে রাত জেগে ধনি দুস্তর পথ চলার সাধনা করছেন। অন্ধকারে পথ চলবার আশায় দুই হাতে চোখ ঢেকে ভাবিনী চলেন। তিনি হাতের কঙ্কন বাঁধা দিয়ে ওঝার কাছ থেকে সাপের বশ করার মন্ত্র শেখেন। গুরুজনের বচনকে তিনি বধিরের মত মানেন এক কথা বললে অন্যকথা শোনেন। পরিজনের কথায় তিনি বোকার মত হাসেন। গোবিন্দ দাস তার সাক্ষী রয়েছে।
“মন্দির বাহির কঠিন কপাট” এই উক্তিটিতে কবির বক্তব্য কি? তা আলোচনা করো।
উত্তর : পদটি গোবিন্দদাসের অভিসার পর্যায়ের অন্তর্গত। নায়িকার প্রণয়ের গভীরতা ওই প্রাবল্য প্রকাশের জন্য গোবিন্দদাস প্রাকৃতিকরাকে টেনে এনেছেন। তার বর্ণনায় কবির চিত্রগীত রচনার দক্ষতা প্রকাশ পেয়েছে। দুর্দান্ত বর্ষার চিত্র কবি জীবন্ত করে তুলেছেন। বর্ষা এসে গেছে ঘন কৃষ্ণ মেঘে আকাশ ঢাকা, চারিদিক অন্ধকার, মেঘের প্রচন্ড গর্জন। এমন দিনে রাধার অস্তরে কৃষ্ণের আবির্ভাবা রাধ হৃদয় সমুদ্র উদ্বেল অস্থির। কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের অভিসারে যেতে হবে এই দুর্যোগের পথ চিরে। ঘরের কপাট বন্ধ। তবুও রাধিকার অভিসারে যাত্রা করতে হবে।
‘মন্দির বাহির’ ‘ইত্যাদি পদটিতে হরি কোথায় আছেন বলা হয়েছে?
উত্তর : দুর্যোগের সময় অভিসারে বাধা দেয় প্রিয় সখী ঝড়জলে বজ্রপাতের মধ্যে পথে বেরুলে রাধার মৃত্যু অবধারিত। তার কাছে প্রাকৃতিক বাঁধা কিছুই নয়। তার নিজের মধ্যে কৃষ্ণ বিরাজ করছে যার ফলে তার আর কোনও দিকে মন নেই, মন কেবল সেই কৃষ্ণের প্রতি। নিজের মর্যাদা যে কৃষ্ণ সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছে তার কাছে সাংসারিক বাধা তটিনী স্বরূপ।
বিরহ পর্যায়ের কবিতায় বিদ্যাপতি শূন্যতার যে সর্বসম্মত চিত্র রচনা করেছেন তার পরিচয় দাও।
উত্তর : মিলনের পর বিরহ। বিরহের পদ রচনায় বিদ্যাপতির দক্ষতা আরো বেশী। মিলনে রাধার যে আনন্দ চাঞ্চল্য-বিরহে তারই ব্যথা আরো অধিক হয়ে ওঠে। না পাওয়ার চেয়ে পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা আরো ব্যাপক ও গভীর। কর্তব্যের আহ্বানে কৃষ্ণ মথুরা চলে যান৷ বৃন্দাবনের মিলন কুঞ্জেনে যে আসে শূন্যতা। বৃন্দাবনের তরুলতা পশুপক্ষী সবাই কৃষ্ণ বিরহে নীরব বিষণ্ণ—“নন্দপুর চন্দ্রবিনা, বৃন্দাবন অন্ধকার।” এ যেন রাধার অসীম বিরহ শূন্যতার প্রতীক। রাধার দুচোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। বিরহ যন্ত্রণা দগ্ধ রাধার জ্যোতির্ময়ী মূর্তি ফুটে উঠেছে ‘মাথুর’ পদে। তবুও আশায় প্রতীক্ষায় দিন গোনেন রাধা এই আশায় যে কৃষ্ণ নিশ্চয় ফিরে আসবেন। দিন যায়, মাস যায়, বছর গড়িয়ে যায় তবুও কৃষ্ণ ফিরে আসেন না। বিরহের যন্ত্রণায় রাধা শীর্ণকায়া হয়ে ওঠেন। তখন তার হৃদয়ে আক্ষেপ ধ্বনিত হয়।
Leave a comment