অথবা, বৈষ্ণব পদাবলীর শিল্পগুণ, সাহিত্যগুণ, কাব্যগুণ নির্ণয় কর
অথবা, মধ্যযুগে রচিত বৈষ্ণব পদাবলীর সাহিত্যিক মূল্য বা শিল্পমূল্য আলোচনা কর
উত্তর : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে যাবতীয় সৃষ্টির মধ্যে জনপ্রিয়তায় ও কাব্যমূল্য বিচারে বৈষ্ণব কবিতা বা পদাবলী যে সর্বোৎকৃষ্ট, এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বৈষ্ণব পদের উদার মানবিকতাবোধ, মানবমনের শাশ্বত আকুতির সার্থক রূপায়ণ এবং ব্যক্তিপ্রাণের স্পর্শে উজ্জীবিত এর গীতিধর্মিতাই বস্তুত বৈষ্ণব পদাবলীতে একটা সর্বজনীন আবেদন সৃষ্টি করেছে। ফলে সেকালের রচনা হয়েও প্রেমানুভূতির গভীরতা, রচনা সৌকর্য ও আবেগের চমৎকারিত্বে বৈষ্ণব পদাবলী একালেও সাফল্য সৃষ্টি করেছে।
বৈষ্ণব কাব্যের আলোচনায় এর ধর্ম ও দর্শনের পটভূমি প্রাধান্য পেয়ে আসছে। বৈষ্ণব শাস্ত্রকারদের মতে বৈষ্ণব কবিতা বৈষ্ণব তত্ত্বেরই রহস্যভাষ্য। রাধাকৃষ্ণের যে প্রেমলীলা বৈষ্ণব পদাবলীতে ব্যক্ত হয়েছে তা প্রেমমূলক কথা কাব্যের উপাদান মাত্র নয়, বৈষ্ণব মহাজনের কাছে তা অধ্যাত্ম সাধনার প্রতিচ্ছবি, রাধাকে ভক্ত বৈষ্ণব প্রেম গাথার নায়িকা বলে মনে করেন না, তার নিকট রাধা মহাভাব স্বরূপিণী, ভক্তির চরম রূপ তার মধ্যে ফুটে উঠেছে। এছাড়া চৈতন্যদেব রাধাকৃষ্ণের উপাসনার মধ্য দিয়ে একটি বিশেষ ধর্মীয় দর্শন ও তথ্যের জন্মদান করেছেন। ফলে সঙ্গত কারণেই পদাবলী একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সাধনার অঙ্গ বিশেষরূপে পরিগণিত হয়ে আসছে।
এক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগতে পারে কোন গুণে বৈষ্ণব পদাবলীকে সর্বজনীন স্বীকৃতি দান করা হয়। বৈষ্ণব কবিরা অধ্যাত্ম প্রেমের জয়গান করেছেন। দেহকে আশ্রয় করে তাঁরা দেহাতীত প্রেমের সাধনা করেছেন। তাই দৈহিক মিলন তাদের কাব্যে মুখ্য নয়। বৈষ্ণব কবিদের কাব্য আদিরসাত্মক হয়েও সর্বজন ভোগ্য হয়েছে। পদাবলীতে রাধাকৃষ্ণের জৈবিক আকর্ষণ এবং দৈহিক মিলন প্রেমতত্ত্বকে রসমণ্ডিত করেছে। আদিরসের প্রাবল্য তত্ত্বাশ্রিত জীবাত্মা ও পরমাত্মা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ছাড়িয়ে সর্বসাধারণের হৃদয়গ্রাহী সাধারণ নরনারীতে পরিণত হয়েছে।
বৈষ্ণব পদাবলীতে সৃষ্টি ও স্রষ্টার মিল বা লীলা অর্থাৎ পরমাত্মা কৃষ্ণ ও জীবাত্মার রাধার লীলারহস্যকেই বৈষ্ণব মহাজনেরা প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু এই তত্ত্বটিকে বাদ দিলে সমগ্র পদাবলী মানবীয় আবেদনে পরিপূর্ণ। সমালোচক ব্রজেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে যে মন্তব্য করেছেন, “বৈষ্ণব কবিতায় প্রেমের এমন উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটিয়াছে যাহা আমাদিগকে আমাদের এই কান্না হাসি বিজড়িত ধরিত্রীর প্রেমের কথাই মনে করাইয়া দেয়। কৃষ্ণের রূপ দেখিয়া রাধার আকুলতা, নায়ক- নায়িকায় মিলন পূর্ব-দর্শন ও শ্রবণ হইতে জাত প্রগাঢ় অনুরক্তি, প্রিয়তমের সাথে মিলিত হইবার জন্য রাধার অভিসারে যাত্রা প্রভৃতি বিষয় বৈষ্ণব কবিরা এমন জীবন্ত করিয়া বর্ণনা করিয়াছেন যে, তাহা আমাদিগকে ঘরের কথাই স্মরণ করাইয়া দেয়। …………. দেবতার উদ্দেশ্যে বৈষ্ণব কবিরা যে প্রেমগীতি’ উপহার দিয়াছেন তাহাদের মধ্যে ধরণীর প্রেমতৃষ্ণিত নরনারীর স্নিগ্ধ সুকুমার মুখচ্ছবি দেখিতে পাওয়া যায়।” (বৈষ্ণব কবিতা)
অর্থাৎ প্রেমের আকর্ষণে বৈষ্ণব মহাজনদের তত্ত্বাশ্রিত রাধাকৃষ্ণ ধরার ধুলায় নেমে এসেছে বাস্তব নরনারীরূপে। এ মানবিকতা ও প্রেমানুভূতির আকর্ষণই বৈষ্ণব পদাবলীকে সাহিত্যিক মূল্য এনে দিয়েছে।
বৈষ্ণব পদাবলীর সাহিত্যিক মূল্যের আরেকটি প্রধান গুণ ১. হলো গীতিময়তা। আধুনিক সংজ্ঞানুসারে বৈষ্ণব কবিতা গীতিকবিতা নয়। কারণ এতে কবির ব্যক্তিমনের প্রকাশ না হয়ে ২. গোষ্ঠী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। তথাপিও রাধাকৃষ্ণের প্রেমের আর্তি ও আকুলতাকে কবিরা যেভাবে প্রকাশ করেছেন তার মাধ্যমে কবির হৃদয়ানুভূতি মাঝে মাঝে প্রকট হয়ে উঠেছে। কাব্য বিচারের ক্ষেত্রে প্রধানত দুটি বিষয় প্রাধান্য দেওয়া হয়- ক. কবি হৃদয়ের গভীর অনুভূতি ও মননশীলতা; খ. হৃদয়ানুভূতি প্রকাশের উপযুক্ত পরিবেশ বা ভাবমণ্ডল সৃষ্টি করার ক্ষমতা।
বৈষ্ণব পদাবলী বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি এখানে বৈষ্ণব কবিগণ নিজ হৃদয় হতে বক্তব্য প্রকাশ করতে না পারলেও এবং রাধাকৃষ্ণকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করলেও কবিদের অন্তর মাধুর্য পাঠকদের নিকট প্রকাশিত হয়েছে। অনেক কবির হৃদয়ানুভূতি ও পরিবেশ-ভাবমণ্ডল অঙ্গাঙ্গিভাবে মিলিত হয়ে পদাবলীকে প্রথম শ্রেণির কাব্য মর্যাদা দান করেছে। এক্ষেত্রে আমরা বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাসের নাম উল্লেখ করতে পারি। এসব কবি গীতি প্রবণতার সাথে মাঝে মাঝে রোমান্টিকতা, প্রকৃতি, পরিবেশের সমন্বয় ঘটিয়ে পদাবলীর কাব্যমূল্য অধিকতর বৃদ্ধি করেছেন। কতিপয় দৃষ্টান্ত:
আষাঢ়ের প্রথম মেঘদর্শনে বিরহী-মনের ব্যাকুলতার প্রকাশ ঘটেছে রাধার এ উক্তিতে,
‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।’ (বিদ্যাপতি পদ-২৪৯)
কিংবা, জ্ঞানদাসের রাধা যে প্রেমার্তি অভিব্যক্ত করেছেন,
রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়া রহিল।
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল। (পদ-৬০)
অথবা, চণ্ডীদাসের রাধার প্রেমের বিচ্ছেদের কাঁটা মেশানো, অজানা শঙ্কার বেদনা মেশানো অভিব্যক্তির প্রকাশ-
এমন পিরীতি কভু দেখি নাই শুনি
পরাণে পরাণে বান্ধা আপনা-আপনি৷৷ (পদ-১৮৮)
এমনিভাবে অসংখ্য কাব্যমণ্ডিত পদ রয়েছে বৈষ্ণব পদাবলীতে যা বৈষ্ণব কবিদের অনুভূতির গভীরতা থেকে উৎসারিত হয়েছে এবং পদাবলীর কাব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।
যে কোনো সাহিত্যের কাব্যমূল্যায়ন কিংবা শিল্প ও সাহিত্যগুণ বিচার করতে গেলে এর ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার বিচার অপরিহার্য। বৈষ্ণব পদাবলী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এর ভাব যেমন প্রাণমাতানো, ভাষাও তেমনি মনোমুগ্ধকর। পদাবলীতে দ্বিবিধ ভাষার প্রয়োগ লক্ষণীয়। একটি হলো মৈথিলী প্রভাবজাত ‘ব্রজবুলি’ নামক এক মিশ্র ভাষা; অপরটি বাংলা। বৈষ্ণব কবিদের মতে দু’ভাষাই স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীলতা লাভ করেছে। বৈষ্ণব পদকর্তাদের মধ্যে বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, লোচনদাস ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনায় সার্থকতা দেখিয়েছেন। অন্যদিকে চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, বলরামদাস প্রমুখ বাংলা পদ রচনায় সাফল্য রেখেছেন। ব্রজবুলি ও বাংলা- উভয় ভাষার পদই পদাবলীতে নতুন প্রাণ প্রবাহের সৃষ্টি করেছে। উদাহরণ:
১. ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর। (জ্ঞানদাস পদ-৬১)
২. কর-যুগে-নয়ন মুদি চলু ভামিনী
তিমির পয়ানক আশে।
কর-কঙ্কন-পণ ফণিমুখ-বন্ধন
শিখই ভুজগ-গুরু-পাশে ৷৷ (গোবিন্দদাস পদ-১৫০)
ভাষা সহজ, সরল, সাবলীল ও প্রাণস্পর্শী হওয়ায় বৈষ্ণব ভাবটি সাহিত্যের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গণমনে এক অপূর্ব প্রভাব বিস্তার করে।
পদাবলীর ভাষার ন্যায় ছন্দেরও অভিনবত্ব রয়েছে। পদাবলীর সাহিত্যিক মূল্য নির্ণয়ে ছন্দের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বৈষ্ণব কবিরা অনেক স্থলে ছকে বাঁধা ছন্দে পদ রচনা না করে প্রয়োজনানুসারে ভাবের প্রকাশক্ষম ছন্দ গড়ে নিয়েছেন। পদাবলীর ছন্দ সংস্কৃত, প্রাকৃত ও বাংলা লোকসংগীত থেকে গৃহীত। কতিপয় উদাহরণ:
চর্চরী ছন্দ: ৩ঃ৪ | ৩ঃ৪ || ৩ঃ৪ | ৩
নন্দ: নন্দন | চন্দ : চন্দন || গন্ধ : নিন্দিত | অঙ্গ।
জলদ : সুন্দর | কমু : কন্ধর || নিন্দি: সিন্ধুর | ভঙ্গ৷৷ (গোবিন্দদাস পদ-১৩)
একাবলী ছন্দ : ৬/৫ বহু দিন পরে | বঁধুয়া এলে।
দেখা না হইত | পরাণ গেলে ৷ ।
এতেক সহিল | অবলা ব’লে।
ফাটিয়া যাইত পাষাণ হ’লে।। (চণ্ডীদাস পদ-২৭৮)
সাত মাত্রার যতিভাগ : এ সখি | হামারি দুখের নাহি ওর।
………………………………………………….
কান্ত পাহুন | কাম দারুণ || সযনে খর শন | হন্তিয়া॥
(বিদ্যাপতি পদ-২৪৯)
মিশ্রবৃত্ত পয়ার : ৮ || ৬ মাত্রাঃ
হাসিতে খসিয়া পড়ে | কত মধু-ধার।
লহু লহু হাসে পহুঁ | পিরীতের সার॥
(জ্ঞানদাস পদ-৬১)
অলঙ্কার কাব্যদেহের সৌকর্য বৃদ্ধি করে। প্রাচীন যুগ হতেই কবিরা কাব্যকে নানা অলঙ্কারে ভূষিত করেছেন। বৈষ্ণব কবিরাও নানা অলঙ্কারে বৈষ্ণব কবিতার কাব্যসৌষ্ঠব বৃদ্ধি করেছেন।
অনুপ্রাস : জীবনে মরণে জনমে জনমে
প্রাণনাথ হৈও তুমি ৷৷ (চণ্ডীদাস পাদ-৩০৯)
রূপক: হাথক দরপণ মাথক ফুল।
নয়নক অঞ্জন মুখক তাম্বুল॥
হৃদয়ক মৃগমদ গীমক হার।
দেহক সরবস গেহক সার॥ (বিদ্যাপতি পদ-২৮৬)
বিষম : সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
আনলে পুড়িয়া গেল।
অমিয়া-সাগরে সিনান করিতে
সকলি গরল ভেল ॥ (পদ-১২৪)
অতিশয়োক্তি: যাঁহা যাঁহা নিক্সয়ে তনু তনু জ্যোতি।
তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি। (গোবিন্দদাস পদ-৫২)
উৎপ্রেক্ষা: দুহু ক্রোড়ে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।
আধ তিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া ॥’ (চণ্ডীদাস পদ-১৮৮)
তবে শুধু অলঙ্কার প্রয়োগ করেই নয়, নিরলঙ্কার কাব্য সুষমায়ও বৈষ্ণব কবিগণ অনেক সময় বৈষ্ণব কবিতাকে গতি ও সৌন্দর্য দান করেছেন। যেমন-
১. ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি
অবনী বহিয়া যায়।
ঈসত হাসির তরঙ্গ-হিলোলে
মদন মূরুছা পায় ৷৷ (গোবিন্দদাস পদ-২৫)
পরিশেষে বলা যায় যে, এভাবে ভাব, ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার প্রয়োগে পদাবলী মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে অতুলনীয়। নরনারীর হৃদয়ে সজ্ঞাত প্রেমের প্রকাশে পদাবলী কিছুটা ‘মৈমনসিংহ গীতিকার’ সাথে তুলনীয়। বৈষ্ণব কবিরা ঘটনা বিন্যাসে, ভাব, ভাষায়, মননশীলতায়, বাকবৈদগ্ধ্যে ও কলানিপুণতায় বৈষ্ণব পদগুলোকে রমণীয়তা দান করেছেন। ফলে কাব্যগুণে, শিল্পগুণে এবং সাহিত্যিক মূল্যে বৈষ্ণব পদাবলী নিঃসন্দেহে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কীর্তি।
Leave a comment