ভগবানের পদতলে নিজেকে নিঃশেষে নিবেদন করাকেই আত্মনিবেদন বলে। এই রসপর্যায়ের পদগুলিই বৈষ্ণব সাহিত্যে প্রার্থনা বা নিবেদন পর্যায়ের পদরূপে চিহ্নিত। রাধা ভক্ত শ্রেষ্ঠা। তাঁর মত সাধনা জীবের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ রাধা তো আর জীব নন তিনি ভগবানের হ্লাদিনী শক্তি। তথাপি দুয়ের মধ্যে ভেদ আছে। তাই রাধা ভগবানের উদ্দেশ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন করেন। বৈষ্ণব কবিরা রাধার এই নিবেদনের মধ্যেই মর্তজীবনের সার্থকতার পথ খুঁজে পেয়েছেন। রাধার আত্ম নিবেদন ও প্রার্থনা পদের মধ্যে পার্থক্য আছে। নিবেদনে রাধা ভক্ত শ্রেষ্ঠা। ভগবানে আত্মসমর্পণ ক’রেই তিনি সুখী-

বঁধু কি আর বলিব আমি

জীবনে মরণে   জনমে জনমে

প্রাণনাথ হৈও তুমি।

কৃষ্ণের জন্য রাধা সমাজ সংসার সব ত্যাগ করেছেন। কৃষ্ণ বিনা তার গতি নেই—

ভাবিয়া দেখিনু    প্রাণনাথ বিনে

গতি যে নাহিক মোর।

কৃষ্ণের মধ্যেই তাঁর পৃথিবী। কৃষ্ণের জন্য তিনি সব নিন্দা কলঙ্কও সহ্য করতে প্রস্তুত।

ডাকে সব লোকে    কলঙ্কী বলিয়া

তাহাতে নাহিক দুখ।

তোমার লাগিয়া   কলঙ্কের হার

গলায় পরিতে সুখ।।

প্রার্থনা : বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রার্থনা পদের একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। পূর্বরাগ থেকে শুরু ক’রে মাথুর পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়, প্রার্থনার পদ তার ব্যতিক্রম। এখানে ভগবান মুক্তিদাতা আর ভক্ত মুক্তিপ্রার্থী। ভক্ত যেন জীবন-অভিজ্ঞতার বিভিন্ন স্তর অতিক্রম ক’রে পরিণত অবস্থায় ভগবানের চরণে আত্মোৎসর্গের প্রার্থনায় ব্যাকুল। বৈষ্ণব পদাবলীর অন্যান্য পদ যেমন মানবিক রসে উজ্জ্বল, প্রার্থনার পদ কৃষ্ণের ঐশ্বরিক রূপে সমৃদ্ধ।

বিদ্যাপতির প্রার্থনার পদগুলিতে ভগবানের চরণে আত্মোৎসর্গের বাসনা মূর্ত হয়েছে। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তিনি এই সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে ঈশ্বরই মানুষের শেষ আশ্রয়। ঈশ্বরের নিকট নিজেকে নিঃশেষে সমর্পণ করা ভিন্ন আর অন্য কোনও গতি নেই। তাই কবি তিল তুলসী দিয়ে নিজেকে কৃষ্ণপদে অর্পণ করেছেন—

মাধব বহুত মিনতি করি তোয়।

দেই তুলসি তিল   এ দেহ সমর্পিলু

দয়া জনু ছোড়বি মোয়।।

কবি জানেন যে তার জীবনের দোষগুণ বিচার করবার কালে গুণের ভাগ বেশী পাওয়া যাবে না। পরের জন্মে পশুপাখী প্রভৃতি যেভাবেই জন্ম হোক না কেন, তাঁর চিত্ত যেন ঈশ্বরের পাদপদ্মেই থাকে, কবির এই প্রার্থনা—

কিয়ে মানুষ পশু   পাখি কুলে জনমিয়ে

অথবা কাট পতঙ্গে।

করম বিপাকে  গতাগতি পুন পুন

মতি রছ তুয়া পরসঙ্গে।।

ঈশ্বরের কাছে ভক্তের পরীক্ষা তার কর্মের মধ্যে। ভক্ত যদি পূণ্যকর্মে জীবন অতিবাহিত করে, তবে তার পক্ষে ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করা কঠিন হয় না। কিন্তু কবি মনে করেন তাঁর জীবনের অনেকাংশ কেটেছে ভোগবিলাসের মধ্যে

তাতল সৈকতে   বারিবিন্দুসম

সুতমিত রমণীসমাজে।

তোঁহে বিসরি মন   তাহে সমর্পিলু

অব মঝু হব কোন কাজে।।

কবির অর্ধেক জীবন কেটে গেছে অজ্ঞানতার অন্ধকারে, নারী সঙ্গে ভোগবিলাসের মধ্যে যৌবনের দিনগুলি কেটেছে। এইরূপ জীবন যাপনের পরিণতি যে ভয়াবহ কবি তা জানেন, তথাপি কৃষ্ণের প্রতি আছে তাঁর অগাধ বিশ্বাস—

তুইঁ জগতারণ   দীন দয়াময়

অতয়ে তোহারি বিশোয়াসা।

ঈশ্বরের আদিও নেই, অক্তও নেই। পৃথিবীর সব কিছু তার থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং তাতেই লীন হয়ে যাচ্ছে। কবির তাই নিশ্চিন্ত বিশ্বাস—

ভনয়ে বিদ্যাপতি   শেষ শমন ভয়

তুয়া বিনা গতি নাহি আরা। 

আদি অনাদিক    নাথ কহায়সি

ভবতারণ ভার তোহারা।।

চণ্ডীদাসের নিবেদন পর্যায়ের পদের সঙ্গে বিদ্যাপতির প্রার্থনা পদের ভাবসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। প্রধানতঃ রসসম্ভোগের করিরূপে বিদ্যাপতি পরিচিত হলেও শান্তরসাশ্রিত প্রার্থনার পদগুলি তাঁর সাহিত্যকীর্তিরূপে অম্লান হয়ে আছে। বৈষ্ণবীয় পঞ্চরসের প্রথম রস শাক্তরস এখানে ভগবান সম্পর্কে ঐশ্বর্যের অনুভূতি বর্তমান। তাই এই শ্রেণীর পদগুলিতে ভক্ত ভগবানের ঐশ্বরিক রূপের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। চৈতন্যপূর্বযুগের কবি বিদ্যাপতির কাব্যে ভগবানের ঐশ্বর্যরূপটির প্রকাশ আছে সত্য; কিন্তু প্রার্থনা পর্যায়ের পদে যে দীনতা ও অকিঞ্চনতা প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে বিদ্যাপতিকে শ্রেষ্ঠ সাধকরূপে পরিগণিত করা যায়।

চণ্ডীদাস প্রার্থনা পর্যায়ের পদ লেখেন নি। তাঁর ‘নিবেদন’ পর্যায়ের পদগুলিকে প্রার্থনা পর্যায়ভুক্ত করা চলে। রাধার জবানীতে চণ্ডীদাস কৃষ্ণের পদে আত্মসমর্পণ করেছেন—

“কহে চণ্ডীদাস   পাপপুণ্যসম

তোমারি চরণখানি।।’

ঈশ্বরকে নিত্যবস্তু বলে মনে করে জাগতিক কামনা-বাসনা বিসর্জন দিয়ে ভক্ত ভগবানের নিকট আত্মসমর্পণ করেন এই পর্যায়ে। কখনো বা মুক্তি কামনা করেন। ভক্ত ও ভগবানের সম্পর্কের এই অবস্থাকে শাস্তরসের অবস্থা বলা হয়। চৈতন্যপূর্বযুগের এই পদে মুক্তির বাসনা ছিল। কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম অনুসারে পরবর্তী কালে ভক্ত কখনই মুক্তি কামনা করেন না। শাস্ত রসাশ্রিত পদে ভক্ত যখন ভগবানের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন এবং এই ভবপারাবার পার করবার দায়িত্ব অর্পণ করেন তখনই প্রার্থনার সূচনা। এই ভাববস্তুকে অবলম্বন করে যে পদ রচিত তাকে বলা প্রার্থনার পদ। এইভাবে ভক্ত এই মায়াময় সংসার থেকে মুক্তি চান। প্রার্থনার পদে ভক্তের এই আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তি‌ বাসনা প্রকাশিত হয়।

বিদ্যাপতি প্রার্থনা পদের শ্রেষ্ঠ রূপকার। এই পর্যায়ের কবিতাগুলিতে কবির আত্মদৈন্য, আত্মনিবেদন, জগতের অনিত্যতা এবং জীবের পরম আশ্রয় ভগবানে আত্মসমর্পণের কথা বলা হয়েছে। এই জগৎ যে অতি তুচ্ছ এবং মায়াময়—এই অনুভূতি প্রথম জীবনে তাঁর না হলেও পরবর্তীকালে হয়েছে। জীবনের অর্ধেক সময় তিনি নিদ্রায় কাটালেন—বন্ধুদের সঙ্গে রসালাপে কতদিন গেল। যৌবনে রমণীসঙ্গে কত সময় নষ্ট করেছেন। আর বার্ধক্যে এসে দেখেছেন যে দোষগুণ বিচার করতে গেলে গুণের লেশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তথাপি তাঁর আন্তরিক বিশ্বাস এই বিশ্বের প্রতিটি কীটপতঙ্গ প্রাণীকে যিনি ত্রাণ করেছেন তিনি কবিকেও ত্রাণ করবেন। কারণ তাঁর থেকেই সকল কিছু জন্ম নিচ্ছে। চতুরানন ব্রহ্মাও এই পালনকর্তার অধীন। যিনি বিষ্ণুর অবতাররূপে কল্পিত সেই কৃষ্ণ অনাদি ও অনন্ত। তাঁর সূচনাও নেই, শেষ বা মৃত্যুও নেই। কবি তাঁর কাছেই আত্মসমর্পণ করে নিশ্চিত্ত; কারণ তাঁর হাতেই আছে বিশ্বকে ত্রাণ করার ভার—“ভবতারণ ভার তোহারা”

শেষ বয়সে কবি আধ্যাত্মিকতার চরম স্তরে উন্নীত হয়েছেন। আমিত্বকে বর্জন করে সবই শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করেছেন। ভক্তের তথা জীবের মাধবের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া অন্য উপায় তো আর নেই। এই উপলব্ধি কবির প্রার্থনা পদকে শাশ্বত সাহিত্যের মর্যাদা দিয়েছে।