বৈষ্ণব সাহিত্যে শিল্পরস, অধ্যাত্মসংস্কার, ধর্মীয় কৃত্য প্রভৃতির পটভূমি রচিত হলেও এ এমন একটি অতুলনীয় চরিত্র লাভ করেছে যে, দেশ-কালের সীমা উত্তীর্ণ হয়ে নিখিল মানব-অস্তরে এ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সুশীলকুমার চক্রবর্তীর ‘বৈষ্ণব সাহিত্য’ গ্রন্থের ভূমিকায় অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ মহাশয় মন্তব্য করেছেন— “বৈষ্ণব ধর্ম লইয়াই বৈক্ষ্ণব সাহিত্য। বৈষ্ণুব ধর্মকে বাদ দিয়া এ সাহিত্যের আলোচনা চলে না।” বৈষ্ণব ধর্ম বিশেষত গৌড়ীয় বৈষ্ণুব ধর্মের মূল তাৎপর্যের সম্বন্ধে অবহিত থাকলে বাংলার বৈষ্ণব পদাবলীর যথার্থ রসাস্বাদন ও তার স্বরূপ আস্বাদন সম্ভব, নইলে তা দুরূহ বোধ হবে।
আমরা বৈষ্ণুব কবিদের কাব্যাস্বাদ করেছি। এখন বৈষ্ণবধর্ম ও সাহিত্য রচনার কিছু তাত্ত্বিক ও পটভূমিকা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন।
পরকীয়া তত্ত্ব : তাত্ত্বিক বিচারে শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণ অভিন্ন এবং শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্মের আনন্দ অংশের প্রকাশ। কিন্তু লৌকিক বিচারে আমরা দেখি শ্রীরাধা বৃষভানুনন্দিনী ও আয়ানের স্ত্রী। কাজেই কৃষ্ণের সম্পর্কে পরকীয়া। বৈষ্ণব কবিদের এই পরকীয়াবাদ যে তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত তা এক বিশেষ দার্শনিকতত্ত্ব। তত্ত্বের দিক দিয়ে রাধা যেহেতু কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি, তাই রাঁধার সঙ্গে কৃষ্ণের প্রেম স্বকীয়। জীব জগতে পরকীয়া প্রেমের অনেক কী অসাধ্য সাধনই না করেছেন। বিদগ্ধ বৈষ্ণব কবি তারই গূঢ়তম চিত্র এঁকেছেন এই ভাষায় :
“কর কঙ্কন-পণ ফনি মুখবন্ধন
শিখই ভুজগ গুরু পাশে।
গোপীতত্ত্ব : কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার নিত্যলীলা। তিনি হ্লাদিনী শক্তি, ভক্তজীবের প্রতীক রাধা। কৃষ্ণের সঙ্গে নিত্যলীলাকে মধুরতর করে তোলবার বাসনায় সখীদের আবির্ভাব। সখীদের মিলিতরূপই যেন শ্রীরাধা। তাই রাধাহীন সখী বা সখীহীন রাধার কল্পনা করা যায় না। তাই সখীদের দ্বারাই শ্রীকৃষ্ণ রাধার প্রেমলীলার পুষ্টি।
“সখি কী পুছসি অনুভব মোয়।
সোই পিরিতি অনু রাগ বাখানিতে
তিলে তিলে নূতন হোয়।”
এখানে অনুভূতির যে আন্তরিকতা ও গভীরতা প্রকাশিত হয়েছে তার তুলনা নাই।
গৌরতত্ত্ব : শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর ভক্তমণ্ডলীর কাছে এক বিশেষরূপে প্রকাশ পেয়েছেন। ভক্তরা তাঁকে মনে করতেন রাধাকৃষ্ণের মিলিত বিগ্রহ। তিনি বহিরঙ্গে রাধা অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ। অপ্রাকৃত গোলকের রাধাকৃষ্ণের লীলা তাঁর জীবনে প্রকাশ পেয়েছিল। শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের কারণ ব্যাখ্যা করে বৈশ্বব কবিগণ বলেছেন শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান শ্রীরাধার প্রণয় মহিমাকে আস্বাদ করার জন্য শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব।
“রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি
অন্যান্যে বিলসে রস আস্বাদ করি।।
সেই দুই এক করে চৈতন্য গোঁসাই।
রস আস্বাদিত দেহে হৈল এক ঠাঁই।।”
শ্রীচৈতন্য রাধাভাবে ভাবিত হয়ে কৃষ্ণের ভজনা করতেন বলে বৈক্ষ্ণব পদাবলীতে রাধাভাবের প্রাধান্য।
মহাজন : “ঋষিরা যেমন মন্ত্রের সাক্ষাৎ দ্রষ্টা, বৈক্ষ্ণব সাধক তেমনি শ্রীরাধাগোবিন্দ -লীলার প্রত্যক্ষ দর্শক। এইজন্যই তাঁহাদেরকে ‘মহাজন’ বলে। প্রত্যক্ষ দর্শক হেতু বৈব কবিতা শুধু মিষ্টি কথার সমষ্টি মাত্র নহে। এর এক-একটি কবিতা যেন এক একখানি চিত্র।
লীলাশুক : বৈষ্ণব কবিতা মাত্রই লীলাশুক। কেননা রাধাকৃষ্ণের লীলা নিত্যবস্তু। ভক্ত কবি, সেই লীলা দর্শন করে চক্ষু সার্থক করতে, রসনার সার্থকতা লাভ করতে। সাধক কবির পরিচয় হল মধুর বৃন্দাবনলীলাকে দর্শন, আস্বাদন এবং শুকের ন্যায় মধুর কাব্যকাকলীতে তার মাধুর্য বর্ণনা। সুতরাং ‘লীলা শুক’ কথাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
বৈষ্ণুব গীতিকবিতা যে একটি চিরকালীন মানবিক আবেদন জাগাতে পেরেছে, তা পদ কর্তাদের মুন্সীয়ানা ও কাব্য সৌন্দর্যের পরিচয় বহন করে। ধর্মের নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যেও কবিচিত্তের অহংমুখী আকুতি ও তার যথাযথ প্রকাশ বৈব পদবলীতে ঘটেছে। তাই আধুনিককালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বৈষ্ণব কবিতায় প্রশ্ন করেছেন, কবিদের এই অনুভূতির অন্তরালে তাঁদের ব্যক্তিগত আবেগানুভূতি যতখানি সক্রিয়, ধর্মের ভূমিকা কি ততখানি?
“জনম অবধি হাম রূপ নেহারলু
নয়ন না তিরপিত ভেল।
সোই মধুর বোল শ্রবণই শুনলু
শ্রুতিপথে পরশ না গেল।”
অসীমকে সীমার বন্ধনে নিয়ে গিয়েছে বলেই কি আর অসীমের অনুভূতি লাভ করা যায় না। রাধিকা জন্মজন্মান্তর ধরে শ্রীকৃষ্ণের রূপ দর্শন করলে তাঁর নয়ন তৃপ্তি লাভ করলো না। আরও দর্শনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই গেল।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ব্রজাঙ্গনা কাব্য এবং বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভানুসিংহের পদাবলী যে বৈষ্ণব পদের অনুকরণে রচিত হয়েছিল এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বৈষ্ণব কবিতার এই কাল ও ধর্মবন্ধন—মুক্তির প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্তই তার উৎকর্ষের শ্রেষ্ঠ পরিচায়ক।
Leave a comment