মাথুরের বিরহ কবিদেরও আচ্ছন্ন করেছে। তাঁরাও রাধার এই বিরহকে সইতে না পেরে এক অভিনব উপায় গ্রহণ করে বৃন্দাবন পরিত্যাগী মথুরাগামী কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার মিলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। বিরহ বিকারের আবেশে রাধা কল্পনার মাধ্যমে কৃষ্ণের সঙ্গ-সুখ উপভোগ করছেন— একেই ‘ভাব সম্মিলন’ বা ‘ভাবোল্লাস’ নাম দিয়ে বৈষ্ণুব পদকর্তাগণ মিলনের বিচিত্র পদ রচনা করে নিজেরাও বিরহ-ভাব মুক্ত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন— “ভাবসম্মিলনের পদগুলিতে আবেগের নিষ্ঠা ও রসের বৈচিত্র্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কারণ এই পদসমূহে বিরহ ও মিলনের রস একসঙ্গে মিলিত হইয়াছে।
কৃষ্ণের মথুরা গমনের পর রাধা ও কৃষ্ণের আর মিলন হয় নাই বটে, কিন্তু বৈষ্ণুব ভক্তকবিগণ এই বিরহের হাহাকারে কেমন করিয়া সমাপ্তি রেখা টানিবেন ? তাই তাঁহারা ভাবসম্মেলন ও ভাবোল্লাস নামক এক পৃথক পর্যায়ের পরিকল্পনা করিতেছেন, যেন কৃষ্ণ সত্যই দীর্ঘ বিরহের ব্যবধানের পর তাঁহাকে গ্রহণ করিতে আসিতেছেন—চারিদিকে তাহারই শুভ সূচনা, কিন্তু কৃষ্ণ তো মথুরা হইতে ফিরেন নাই। কিন্তু পদকর্তা এ নির্মমতা সহ্য করিবেন কি করিয়া? তাই এই পর্যায়ের পদে রাধা-কৃষ্ণের কাল্পনিক মিলনের চিত্র আঁকিয়া তাঁহারা লীলারসের উপসংহার করিয়াছেন।”
বৈষ্ণুব কবিগণ যে রাধাকৃষ্ণের নিত্য মিলনের কথা বলেছেন, তা বৃন্দাবন-রূপ লোকে নয়, তা কোনও কুঞ্জে নয়, তা ভাবলোকে। মহাভাবই বৃন্দাবনলীলায় রূপের মাঝারে অঙ্গ লাভ করল—সে রূপ আবার ভাবের মাঝারে ছাড়া পেল। এটাই ভাবসম্মিলনের মূলকথা।
বিদ্যাপতি প্রায় সর্ববিধ রস পর্যায়ভুক্ত পদ রচনা করেছেন এবং অধিকতর ক্ষেত্রেই সার্থকতা অর্জন করেছেন। বিদ্যাপতি রাধিকার বিচিত্র অনুভূতির কথা প্রকাশ করলেও বিরহ বেদনা এবং ভাবসম্মিলনের পদে যেন আপনাকেও অতিক্রম করে গেছেন। ভাবসম্মিলন পর্যায়ের পদে বিদ্যাপতির সমকক্ষ কবি বৈষ্ণব সাহিত্যে বিরল।
নির্জন রাত্রে শ্রীরাধিকা কল্পনায় (অথবা স্বপ্নে) প্রিয়তম কৃষ্ণের মুখচন্দ্র প্রত্যক্ষ করেছেন, তাই আনন্দ বিহ্বল রাধিকা সখীর কাছে বলেন—
“আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লু
পেখলু পিয়া-মুখ-চন্দা,
জীবন যৌবন সফল করি মানলু
দশ দিশ ভেল নিরদন্দা।”
কৃষ্ণবিরহে এতদিন রাধিকার হৃদয়ে অত্যন্ত দ্বন্দ্বমুখর ছিল, কিন্তু আজ সমস্ত প্রকার অন্তর্দ্বন্দ্বের অবসান ঘটেছে।
এতদিন পর রাধিকা তাঁর গৃহকে প্রকৃত গৃহ বলে মনে করেছেন, কেননা প্রিয়জন বিহীন গৃহে বিরাজ করে শ্মশানের শূন্যতা। নিজের দেহকে আজ দেহ বলে মানছেন। কেননা নারীদেহের পরম সার্থকতা তো প্রিয়-মিলনে। রাধিকা চাইছেন এই ‘আনন্দ-মুখরিত দিনে প্রকৃতিতে নেমে আসুক বসন্ত মিলনের পরিবেশ।
“সোই কোকিল অব লাখ লাখ ডাকউ
লাখ উদয় করু চন্দা।
পাঁচ বাণ অব লাখ বাণ হউ
মলয় পবন বহু মন্দা।।”
কোকিলের কুহু তানের মধ্যে চাঁদের স্নিগ্ধ আলোর নীচে, মন্দ মন্দ বসন্ত বাতাসের স্পর্শ শরীরে মেখে রাধিকা কৃষ্ণমিলনে মেতে উঠতে চান। আবার রাধিকার কাছে কৃষ্ণ প্রেম শীতের ওড়নার মতো উষ্মতা নিয়ে হাজির হয়। বিরহের তাপ দগ্ধতা কাটাবার জন্য কৃষ্ণপ্রেম যেন গ্রীষ্মের বাতাসের মতোই সুশীতল। সেই সঙ্গে কৃষ্ণই হলেন রাধিকার প্রেম সমুদ্রে পার হবার নৌকা—
“শীতের ওঢ়নী পিয়া গীরিশের বা।
বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।।”
প্রিয়তমকে কোনও মূল্যেই তিনি প্রবাসে পাঠাতে রাজী নন।
জ্ঞানদাস বিদ্যাপতির ন্যায় ভাবসম্মিলনের কিছু পদ রচনা করেছেন। জ্ঞানদাসের রাধা মনে প্রাণে অনুভব করেন যে, ‘তোমায় আমায় একই পরাণ’। অতএব আকুল আগ্রহে তিনি প্রিয়তমকে হৃদয় মন্দিরেই প্রতিষ্ঠা করে নেবেন—
‘বঁধু আর কি ছাড়িয়া দিব
এ বুক চিরিয়া যেখানে পরাণ-
সেখানে তোমারে থোব।
পরিশেষে বলতে হয়, ভাবোল্লাসের পদ রচনায় বিদ্যাপতি তাঁর অন্তরের সমস্ত দরদ মিশিয়ে রাধিকাকে গড়েছেন। বিরহের পর রাধিকার এই যে কল্পমিলন তার মধ্যে আছে প্রেম গভীরতার স্পর্শ। বিদ্যাপতির রাধিকার মনের ভাব বিহ্বলতাকে প্রকাশ করতে রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করে বলতে ইচ্ছা করে—
“তোমায় আমি হেরি সকল দিশি,
সকল দিয়ে তোমার মনে মিশি,”
—’গীতাঞ্জলি’ (১৩৮)
Leave a comment