“বৈষ্ণব পদাবলীর নিখিল মানবের চিত্তগ্রাহী রোমান্টিক রসপ্রবণতা আছে, এবং আছে বলিয়াই এই পদাবলী শুধু বৈষ্মব মোহাত্তের মঠে এবং পাঠ বাড়ীতে স্থান পায় নাই, আধুনিক সহৃদয় পাঠকেরও রসের ভোগে লাগিয়াছে।” ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অভিমত অনুসরণ করে বলা যায় ধর্মীয় দিক থেকে বৈষ্ণুব পদবলীর বিশেষ মূল্য থাকলেও এর রস ও ভাবের দিক থেকে এমন এক যুগাতিচারী বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে যা সমস্ত কালের পাঠক পাঠিকার রস পিপাসু মনকে নাড়া দেয়। তাই বৈষ্ণবপদালী ও পদকারদের সম্পর্কে কিছু বলতে গিয়ে কেলবমাত্র ধর্মীয় বাতাবরণেই চিন্তার পরিধিকে সীমাবদ্ধ রাখলে সঠিক তথ্য ও তত্ত্ব সংগ্রহ থেকে বঞ্চিত হতে হবে। রাধাকৃষ্ণ লীলাকে ‘বিশুদ্ধ মর্ত্যজীবনচারী রোমান্টিক ভাবানুভূতি রূপে কল্পনা না করে সমগ্র মানব জাতির অস্তরের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে তুলনা করাই এর সার্থকতা। জ্ঞান দাস তারই প্রতিভু। রোমান্টিক কল্পনাকে পাথেয় করে রাধা কৃষ্মকে শুধুমাত্র বিশুদ্ধ ধর্মীয়ভাবের নামে প্রতিষ্ঠা না করে সমগ্র মানব মানবীর প্রতিমূর্তি রূপে তিনি গড়ে তুলেছেন।
জ্ঞানদাসের রোমান্টিক কবি প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছে বাংলা ও ব্রজবুলি ভাষায় বৈষ্ণব পদরচনার মধ্যে দিয়ে। বিদ্যাপতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে জ্ঞানদাস ব্রজবুলি পদ রচনায় রত হয়েছিলেন বাংলার মাটিতে তাঁর জন্ম হলেও ব্রজবুলি ভাষাকে তিনি যথেষ্ট কদর করতেন।
“লহু লহু মুচকি হাসি হাসি আত্তলি পুন পুন হেরসি ফেরি।
জনু রাত পাতি সঞে মিলন বঙ্গভূমে ঐছন কয়ল পুছবি।।”
এ কবিতায় অর্থালঙ্কার ও শব্দালঙ্কারের আতিশয্য না থাকলেও কবিতার যে মহৎ গুণ ব্যঞ্জনা, গূঢ় রসের ইঙ্গিত, তা এর মধ্যে বিদ্যমান। বিশেষ করে,
“ধনী হে বুঝলু এ মন বাত।
এতদিনে দুহুঁক মনোরথ পূরল
ভেটালি কানুক সাথ।।”
—ব্রজবুলি শব্দের দ্বারা রাধার এ উক্তিতে চমৎকার ভাব স্ফুরিত হয়েছে। ড. সুকুমার সেন তাই বলেছেন : “Janadasa was the most careful writer of Brajabuli,” তা সত্ত্বেও বলতে হয়—‘ব্রজবুলি তাঁহার কবিভাষা, প্রাণের ধাত্রী নহে’ তার প্রাণের ধাত্রী হোল বাংলা ভাষা।
জ্ঞানদাস ছিলেন চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য। যে সিঁড়ি বেয়ে বৈষ্ণব পদসাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্বের আসন চণ্ডীদাস দখল করেছিলেন,— ভাবও ভাষায় জ্ঞানদাস তাঁরই পথ অনুসরণ করেছিলেন। অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ভাষায় “যখন জ্ঞানদাস কৃত্রিম কবি সংস্কারের চশমা আর ব্রজবুলির সাজ সজ্জা ত্যাগ করিয়া বাঙালি সুরে রাধাকৃষ্ণের সুখ দুঃখের কথা শুনাইয়াছেন, তখনই তিনি পাঠকের মন লুঠ করিয়া লইয়াছেন, তখনই তিনি চণ্ডীদাসের যথার্থ উত্তর সাধক হইয়াছেন।” অন্যান্য পদকারদের মতো জ্ঞানদাস বাল্যলীলা, দানখণ্ড, নৌকাবিলাস, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পদরচনা করলেও তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পেয়েছে মূলতঃ রসোগারের পদরচনায়।
জয়দেবের ‘গীত গোবিন্দমের’ মতো জ্ঞানদাসের রসোগারের পদের নানা স্থানে হয়তো আদিরসের অনিবার্য অনুপ্রবেশ ঘটেছে, রাধাকৃষ্ণের সম্ভোগের চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তবু “রাধার প্রতি কৃষ্ণের স্নিগ্ধ সজল মেদুর মমতার কোমলস্পর্শ বড় করুণ হয়ে ফুটে উঠেছে।”
একই শয্যায় ঘুমের ঘোরে রাধিকা এপাশ ওপাশ করলে কৃষ্ণ ব্যাকুল চিত্তে বলে ওঠে—
নিঁদের আলসে যদি পাশমোড়া দিয়ে।
কি ভেল কি ভেল বলি চমকি উঠয়ে।”
কৃষ্ণের এ প্রেমের স্বরূপ উত্তর-চৈতন্য যুগের পদাবলীতে হয়তো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তবুও “কায়ার সহিত ছায়া মিশাইতে পথের নিকট রয়।” কৃষ্ণের এ ব্যাকুল বেদনা জ্ঞানদাস সমগ্র মানবের আর্তি ক্রন্দন রূপে লিপিবদ্ধ করেছেন।
স্বপ্ন বিলাস পর্বে স্বপ্ন ঘোরের মধ্যে রাধিকা যখন আর্ত চিৎকার করে বলতে থাকে—
পরান বঁধুকে স্বপনে দেখিলু বসিয়া শিয়ার পাশে।
নাশার বেশ পরশ করিয়া ঈষৎ মধুর হাসে।”
এই নিকট সান্নিধ্য লাভের মধ্যে দিয়ে স্বপ্ন ভঙ্গের পর রাধিকা যা বলে ওঠে তা জগতের শাশ্বত চির প্রিয়-বিরহের নামান্তর মাত্র— “পরশ করিতে রস উপজিল জাগিয়া হৈনু হারা।” আসন্ন বিচ্ছেদের মর্মন্তদ যন্ত্রণায় অনুভব করেছে— “কপোত পাখীরে চকিতে বাঁটল বাজিলে যেমন হয়।” প্রিয় বঁধু কত কাছের মানুষ, তবুও দিবানিশি রাধার মনে হয় কত দূরে দূরে তার অবস্থান কেন তারা এক হতে পারে না, তবে কি বিধাতার অভিশাপে। সেতো দেখে আসছে—’শিশুকাল হৈতে বন্ধুর সহিতে পরাণে পরাণে নেহা। তাহলে উভয়ের মধ্যে এত দূরত্ব কেন? তাহলে কি এটা পাপের ফল? না বিধাতার অভিযোগ? “না জানি কি লাগি কো বিহি গরল ভিন ভিন করি দেহা।” তবে রাধিকা সমূহ বিচ্ছেদ কাতরা হলেও মিলনে তার স্বস্তি কোথায়? সারা অঙ্গ জুড়ে কৃষ্ণের সান্নিধ্যে মোহিত হলেও পুঃন হারাবার ভয়ে ক্রন্দন জাগে—
“রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।”
আক্ষেপানুরাগের পদ রচনায় চণ্ডীদাসের কৃতিত্ব উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের ন্যায়। তবুও জ্ঞানদাস যা সৃষ্টি করেছেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার পক্ষে যথেষ্ট। কৃষ্মের জন্যে আক্ষেপধ্বনি রাধার কণ্ঠে যখন স্ফুরিত হয়—
সুখের লাগিয়া এঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল।
অমিয় সাগরে সিনান করিতে সকলি গরল ভেল।।”
তখন কি বিস্মিত হতচকিত হতে হয় না জ্ঞানদাসের রচনা নৈপুণ্যে? যে সুখের আশায় বন্ধুর সঙ্গে পিরীতি করলো, শীতল বলে চাঁদের কিরণকে বরণ করতে চেয়েছিল কিন্তু কর্মদোষেই তা তীব্র দাহকারী রৌদ্র করে পরিণত হল। পিপাসা মেটাতে জলদ প্রার্থনা করলে বজ্রের দ্বারা তা কেবল প্রতি হত হয়ে ফিরলো।
“কানুর প্রেম মরণ অধিক শেল।”
শ্রীরাধা সমাজ সংসার আত্মীয় পরিজন সমস্ত ভুলে যখন বলে ওঠে, বন্ধু—
“তোমার গরবে গরবিনী আমি রূপসী তোমার রূপে।
হেন মনে লয় ও দুটি চরণ সদা লয়্যা রাখি বুকে।।”
একি তার জীবনের শেষ পরিণাম, না প্রেমের পরিণতির রূপ। প্রিয় বিরহে চোখের জলই সম্বল করে তার দিন কাটছে, সখীদের সান্ত্বনা তার মনে ধরে না—কারণ তার দশা যে রাত না হতেই রাতের প্রদীপ নিভে যাওয়ার মতো। শুধু পথ চাওয়া, রাত্রি দিন, মাস, বর্ষ, সব শেষ হয় কিন্তু রাধা কৃষ্ণের জন্য পথ চাওয়া আর শেষ হয় না বারে বারে তাই—
কাহ্ন নেহারিতে নয়ন অন্ধায়লা দিবস লিখিতে পথ গেল।
দিবস দিবস করি মাস বরিস গেল বরিসে বারিস কত ভেল।।”
এই বিরহিণী রাধিকা, জ্ঞানদাসেরই সৃষ্টি। কোন প্রথাসিদ্ধ নায়িকার আদলে না গড়ে তিনি বিশ্বমানবীর স্বরূপকে রাধার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করিয়েছেন। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে এর রূপ নির্মিত হয়েছে, তবুও এক দুর্বধিগম্য রোমান্টিক মানসিকতার বশবর্তী হয়ে কবি এই নায়িকাকে চিরন্তন মানবী মূর্তিতে রূপান্তরিত করেছেন। রাধিকা চিরজনমের মতো এই ভেবে সান্ত্বনা পেল—
“রূপের পাথারের আঁখি ডুবিয়া রহিল।
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।”
তাই আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন জ্ঞানদাস। মধ্যযুগীয় আবেষ্টনে থেকেও যে রোম্যান্টিক চিত্র তাঁর রচনার মধ্যে পরিস্ফুট তা আধুনিক কালের। সমালোচকের মতে, “জ্ঞানদাসের যুগ ও আমাদের যুগের মধ্যে প্রায় চারিশত বৎসরের ব্যবধান— সে ব্যবধান মন, প্রাণ ও হৃদয়ের। তবু কেমন করিয়া জানি না, জ্ঞানদাসের পদে আমরা আধুনিক মানুষের প্রাণের কথা শুনতে পাই। রাধাকৃষ্ণের রূপকে কবি যেন নিখিল মানবের দেশকালাতীত বেদনাকেই নিকষে সোনার রেখার মতো ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। আবেগে তিনি মানবিক, চিত্রকল্পে তিনি আধুনিক।”
Leave a comment