অথবা, বৈষ্ণব পদাবলীর আধ্যাত্মিকতা বিচার কর

উত্তর : রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা বৈচিত্র্যকে কেন্দ্র করে বৈষ্ণব মহাজনগণ যে পদাবলী রচনা করেছেন তা বৈষ্ণব পদাবলী। এই পদাবলী যে প্রেমলীলাতে বর্ণিত তা মানবিক প্রেমের আধারেই বিধৃত। বিরহ-মিলন-কথায় পরিপূর্ণ বৈষ্ণব পদগুলো স্বভাবতই আমাদের মানবীয় প্রেমের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু বৈষ্ণব শাস্ত্রকারেরা রাধাকৃষ্ণের প্রেমগীতিকে মানবীয় প্রেমগীতি বলে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। তাঁরা রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলাকে জীবাত্মা পরমাত্মার প্রণয়লীলার রূপক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ধর্মদর্শনের ও সাধন ভজনের অবলম্বন করেছেন।

আলোচ্য ক্ষেত্রে আলোচনার বিষয়- এই বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্য কি শুধু সংসারের নরনারীর প্রেমের মধ্যে সীমিত? না এর আর কোনো তত্ত্ববহুল দিক আছে।

বৈষ্ণব মহাজনদের কাছে বৈষ্ণব কবিতা বৈষ্ণব তত্ত্বেরই রসভাষ্য। তাঁদের কাছে তা অধ্যাত্ম সাধনার প্রতিচ্ছবি। রাধাকে ভক্ত বৈষ্ণব প্রেম গাথার নায়িকা বলে মনে করেন না, তাঁর নিকট মহা মহাভাব স্বরূপিণী, ভক্তির চরম রূপ তার মধ্যে ফুটে উঠেছে। পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার প্রেমই বৈষ্ণব তত্ত্বের মূল রহস্য। এই তত্ত্বটিকে বাদ দিয়ে বৈষ্ণব পদাবলীকে শুধু সাধারণ নরনারীর প্রেমকাহিনীর অনুরূপ বা প্রতিরূপ বলে গ্রহণ করলে চলবে না। কেননা বৈষ্ণব মহাজনেরা মনে করেন, “মর্ত্যের মানবিক প্রেম শুদ্ধ প্রেম নহে, উহা কাম ও দেহবুদ্ধিযুক্ত। উহাতে স্বার্থহীনতার ভাবটিও দেখিতে পাওয়া যায় না।” [সূত্রঃ বৈষ্ণব কবিতাঃ ব্রজেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য]

বৈষ্ণব মতানুসারে মানুষ ও ভগবানের সম্পর্কটি সংক্ষেপে এই-আদিতে পরমপুরুষস্বরূপ বিধাতা এক ছিলেন। তিনি নিঃসঙ্গ বোধ করলেন, তাই নিজ অংশ থেকে নারী স্বরূপকে সৃষ্টি করে ‘যুগল’ হলেন। কাজেই সৃষ্টি স্রষ্টার আনন্দ সহচর। সচ্চিদানন্দ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার আনন্দাংশ দ্বারা সৃষ্ট জীবের প্রতীক রাধার সঙ্গে অপ্রাকৃত বৃন্দাবন ধামে লীলায় রত। ভক্ত এই লীলা মানবদৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করে আনন্দ রসে নিমজ্জিত হবেন- এটাই হলো বৈষ্ণবীয় তত্ত্ব। শ্রীকৃষ্ণের আনন্দাংশের বা হ্লাদিনী সত্তার মানবীরূপ হচ্ছে বিশাখা চন্দ্রাবলী রাধা। তবে আনন্দাংশ বা হ্লাদিনী সত্তার সার অর্থাৎ শ্রেষ্ঠতম পূর্ণতম প্রকাশ রাধা। একদিকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অপরদিকে তাঁর হ্লাদিনী সত্তার মানবী রূপ চিরযৌবন সম্পন্না রাধার মধ্যে নিত্য প্রেমলীলা চলছে। এই প্রেমিক যুগলের প্রেমলীলাই বৈষ্ণব দর্শন ও শাস্ত্রে মানুষী প্রেমের আধারে ব্যক্ত করা হয়েছে। চণ্ডীদাসের ভাষায়,

‘এমন পিরীতি কভু দেখি নাই শুনি

পরাণে পরাণে বান্ধা আপনা-আপনি। (পদ-১৮৮)

বৈষ্ণব কবিতা ধর্মমূলক কবিতা। প্রেমের ধর্ম হচ্ছে প্রেমিক ও প্রেমাস্পদ পরস্পর পরস্পরকে আত্মস্থ করতে আকুল হবে, পরস্পরের মধ্যে আত্মবিলোপে কৃতার্থ হবে। এ প্রেম জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার প্রেম। সমালোচকের ভাষায়, “জীবাত্মা হচ্ছে পরমাত্মার খণ্ডাংশ। বিন্দু বিন্দু পানি নিয়ে সমুদ্র। কিন্তু বিন্দুর একক শক্তি নিতান্ত তুচ্ছ। তাই তার অস্তিত্ব রক্ষার গরজেই। সমুদ্রের জন্য তার আকুলতা। বিন্দুস্বরূপ জীবাত্মা তাই পরমাত্মার জন্য ব্যাকুল। এই ব্যাকুলতার জন্যই জীবাত্মা প্রেমিক, তাই সে রাধা।” (ভূমিকা: মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা)

তবে শুধু দার্শনিক মতবাদ প্রচার করাই বৈষ্ণব পদের মূল উদ্দেশ্য নয়। পদাবলীর অন্তরালে ভগবানের আরাধনার কথাই গীত হয়েছে। বাস্তব জগতে যেমন নরনারীকে আকর্ষণ করছে, নারী যেমন পুরুষকে অনুসরণ করছে, তেমনি পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ এবং জীবাত্মা রাধার মধ্যে লীলা চলছে। শ্রীকৃষ্ণের জন্য রাধার যেমন আকুলতা, তেমনি পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণেরও আকুলতা আছে, কেননা জীবাত্মাকে বাদ দিয়ে তাঁর লীলা ভোগ হয় না। কিন্তু কোনো বিশেষ জীবাত্মার জন্য তাঁর আকুলতা নেই। এজন্য একক জীবাত্মা রাধা সদা উদ্বিগ্ন। কৃষ্ণের ষোলোশ গোপিনী আছে, রাধার কৃষ্ণ ছাড়া কেউ নেই। তাই রাধা সদা শঙ্কিত,

‘এই ভয় উঠে মনে এই ভয় উঠে।

না জানি কানুর প্রেম তিলে জনি টুটো।’ (চণ্ডীদাস পদ-৮৪)

প্রেমের পরিণতি একাত্মতায়, যাকে বলা চলে, ‘আনলহক’ বা ‘মোহন’। এ অবস্থাটা বৈষ্ণব তত্ত্ব মতে যুগলরূপ ও অভেদরূপ। এ সাধনার বৈষ্ণবীয় নাম ‘রাধাভাব’।

শ্রীচৈতন্য দেবের আবির্ভাবের পর গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন গড়ে উঠে এবং রাধাকৃষ্ণের অপার্থিব প্রেমলীলা চৈতন্য দেবের জীবনে মূর্ত হয়ে দেখা দেয়। তিনি ‘রাধাভাবে’ ভাবিত হন। এই ‘রাধাভাবদ্যুতি সংবলিত নবীন সন্ন্যাসী প্রেমের বন্যায় সারা বঙ্গদেশ’ ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। সমালোচক ব্রজেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ভাষায়, “সেই প্রেমসিন্ধু হইতে পদাবলীরূপে কৌস্তভ মণির উদ্ভব। প্রেমের এই জীবন্ত মূর্তিকে প্রত্যক্ষ করিয়া বা কবি মানসে রাখিয়া বৈষ্ণব কবিরা রাধাকৃষ্ণের অপার্থিব প্রেমগীতি সার রচনা করিয়াছেন। কাজেই বৈষ্ণব কবিতাকে সাধারণ নরনারীর প্রেম বলিয়া গ্রহণ করা চলে না।” (বৈষ্ণব পদাবলী আলোচনা)

বৈষ্ণব কবিতার উপজীব্য রাধাকৃষ্ণের প্রেম। বৈষ্ণব সাধক নরনারী হৃদয়ের সম্বন্ধের মধ্যেই আপন সাধন সংকেত পেয়েছিলেন। তাই পিতারূপে, পুত্ররূপে, বন্ধুরূপে, প্রিয়রূপে তারা ভগবানকেই কামনা করেছেন। নরনারীর নিবিড় প্রেম সম্বন্ধে তারা ভগবান আরাধনার আদর্শকেই রূপ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ব্রজেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেছেন, “আমরা যাহাকে ভালোবাসি তাহাকেই জীবনের শেষ সম্পদ নিবেদন করি। কাজেই ভালোবাসি তাহারই মধ্য দিয়া যদি দেবতার সেবা করি তবে অপরাধ কোথায়? নরনারীর যে প্রেম তাহাই তো পরম বস্তু। প্রেমিকের প্রতি প্রেম নিবেদনের মধ্য দিয়াই কি ঈশ্বরের প্রতি প্রেম নিবেদন করা হইতেছে না?” (বৈষ্ণব কবিতা)

এ কারণে দেবতার উদ্দেশ্যে বৈষ্ণব কবিরা যে প্রেমগীতি উপহার দিয়েছেন, তার মধ্যে ধরণীর প্রেমতৃষ্ণার্ত নরনারীর স্নিগ্ধ সুকুমার মুখচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায়। আর এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,

“দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই

প্রিয়জনে- প্রিয়জনে যাহা দিতে চাই

তাই দিই দেবতারে, আর পাব কোথা।

দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।”

অর্থাৎ ‘বৃন্তহীন কুসুম যেমন অকল্পনীয়, তেমনি বৈষ্ণব কবিতাকে ধরণীর সাথে সম্পর্কচ্যুত অলৌকিক গোলকধামের বস্তু’ বলে চিন্তা করা অসম্ভব। কিন্তু বৈষ্ণব শাস্ত্রকারেরা এটা মানতে চান না। তাঁদের মতে দেহবুদ্ধি সম্পৃক্ত মানবিক প্রেম কখনো অলৌকিক প্রেমের মর্যাদা লাভ করতে পারে না। এ কারণে তাঁরা ‘বৈষ্ণব পদাবলীকে শুধুই বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাষ্য’ বলেছেন। তাঁদের মতে “শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান।”

এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, বৈষ্ণব কবিতায় মানবপ্রেমের চিত্র ও সৌন্দর্য উদ্ভাসিত হলেও এবং লৌকিকের পথ ধরে বৈষ্ণব পদাবলী অগ্রসর হলেও নিঃসন্দেহে এই কবিতা আমাদের মনে অলৌকিক আবেদন এনে দেয়। বৈষ্ণব কবিতায় লৌকিক রূপের অন্তরালে অরূপ প্রকৃতির সুর শোনা যায়। মানবপ্রেমের পশ্চাতে বিশ্ব প্রেমের সুরটি বাজতে থাকে। প্রায় বিহ্বল চিত্রের মধ্যে সাধকের তপস্যার বাণী শোনা যায়। এ কারণে সমালোচকগণ বৈষ্ণব কবিতার মধ্যে স্বর্গ ও মর্ত্যের মিলন দেখিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, “কবিরা পৃথিবী আঁকিয়াছেন এবং স্বর্গও আঁকিয়াছেন- কিন্তু বৈষ্ণব কবিরা পৃথিবী ও স্বর্গ এক করিয়া দেখাইয়াছেন।” (সূত্র: বৈষ্ণব কবিতা: ব্রজেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য)

সত্যি বৈষ্ণব পদাবলীতে লৌকিক জগতের প্রেক্ষাপটের ধূলিধূসরতায় নেমে এসেছে অলৌকিক অনুভূতি। এ কবিতার যদি কোন উদ্দেশ্য থাকে তবে সেই অলৌকিক রসস্বরূপ পরমপুরুষের অনুভূতি আমাদের মনে জাগ্রত করে দেওয়াই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। রাধাকৃষ্ণের প্রেম মানবিক প্রেমের আধারে রচিত হলেও তা ব্যাখ্যা করে বুঝানো যায় না। সেই প্রেমের অনুভূতি যার মনে জাগ্রত হয়েছে এই জগৎ সংসার তার কাছে মিথ্যা হয়ে যায়। তাইতো বিদ্যাপতির রাধা বলেছে,

‘সখি কি পুছসি অনুভব মোয়

সোই পিরীতি অনু- রাগ বাখানিতে

তিলে তিলে নূতন হোয়॥ (পদ-২৯১)

আবার চণ্ডীদাসের রাধার আত্মসমর্পণের যে সুর বেজেছে তাকেও সম্পূর্ণ মানবিক বলে মনে হয় না। এরূপ নিঃশর্ত দান, ব্যক্তিত্বের এই জাতীয় অবলুপ্তি মানবীপ্রেমে অসম্ভব। চণ্ডীদাসের রাধা কৃষ্ণপ্রেমে আত্মসম্বিত হারিয়ে বলেছে,

‘সই, কেবা শুনাইল শ্যাম-নাম

কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো

আকুল করিল মোর প্রাণ॥’ (পদ-৫৭)

কিংবা, কবি জ্ঞানদাস মিলনের তীব্র উৎকণ্ঠাকে যে ভাষায় প্রকাশ করেছেন তাও অধ্যাত্মভাব মণ্ডিত :

‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর। (পদ-৬১)

এমনি অসংখ্য বৈষ্ণব পদে অমর্ত্যলোকের সংগীত ধ্বনিত হয়েছে। সমালোচক আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের ভাষায়,

“বৈষ্ণব কবিতা সমুদ্রগামী নদীর ন্যায়। নদী চলিয়াছে, দুই দিকে তটভূমি, তাহার আনন্দকল-রবে মুখরিত হইয়া নদী চলিতেছে, দুই ধারে ফলফুল সমন্বিত তরুলতা, জনকোলাহল, পল্লীর অপূর্ব সৌন্দর্য, ফুলের বাগান। কিন্তু যখন নদী মোহনায় আসিল, তখন সেসব দৃশ্য সে পশ্চাতে ফেলিয়া আসিয়াছে। ………………….জন কোলাহল মুখরিত উদ্যান, সঙ্কুল, বনভূমি- এ সকলের কিছু নাই- সন্মুখে দুর্ভেদ্য প্রহেলিকার মত অসীমের প্রতীক মহাসমুদ্র। বৈষ্ণব কবিতা নানারূপ পার্থিব সৌন্দর্যের পথ বহিয়া চলিয়াছে কিন্তু তাহার লক্ষ্য সেই অজ্ঞেয় দুরধিগম্য মহাসত্য। ………………..বৈষ্ণব কবিতা এইভাবে জানা পথ ক্রিয়া লইয়া গিয়া অজানার সন্ধান দেয়।”

আর এ কারণেই বৈষ্ণব পদাবলীকে বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাষ্য বলা হয়। বৈষ্ণব কবিতার সৌন্দর্যচেতনা ও আধ্যাত্মিকতার স্বরূপ বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে তাই ব্রজেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেছেন,

“সীমা ও অসীমের সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া বৈষ্ণব কবিতা আমাদের মনে অপার রহস্যালোকের সন্ধান আনিয়া দেয়। পৃথিবীর কলকোলাহলের মধ্যে তাহার যাত্রা আরম্ভ। ক্রমশ সেই কোলাহল শান্ত হইয়া আসিতে থাকে; সীমার অতীত অসীমের অস্পষ্ট আভাস ‘আমরা পাইতে থাকি। বৈষ্ণব কবিতা সেই অস্পষ্টতাকেই স্পষ্ট করিবার সাধনা করে।” (বৈষ্ণব কবিতা)

পরিশেষে বলা যায়, বৈষ্ণব কবিতা যেমন বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাষ্য তেমনভাবে এটি মানবীয় রসেও সিক্ত। বৈষ্ণব কবিরা রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলাকে আধ্যাত্মিকতা যুক্ত করে ব্যাখ্যা করেছেন এবং সেই সাথে এর মধ্য দিয়ে রাধাকৃষ্ণের অপ্রাকৃত অথচ নিত্যলীলাকে প্রাকৃত নরনারীর প্রেমলীলার মানদণ্ডে রচনা করেছেন বলে এগুলোর আস্বাদ্যতা সর্বজনীনতা লাভ করেছে এবং লৌকিক জগতের প্রেক্ষাপটের ধূলিধূসরতায় নেমে এসেছে অলৌকিক অনুভূতি। এটাই বৈষ্ণব কবিতার আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যচেতনাকে প্রকাশ করেছে।