উত্তর: গোবিন্দদাস কবিরাজ মুখ্যত ব্রজবুলি ভাষাতেই পদ লিখেছিলেন বলে মনে করা হয়। গোবিন্দদাসের ভণিতায় কিছুসংখ্যক বাংলা পদও পাওয়া গেছে। তার প্রায় সবকটিই গোবিন্দদাস চক্রবর্তী নামক অপর এক কবির রচনা বলে অনুমিত হয়। অন্য পক্ষে ভাষা এবং ভাবকল্পনার দিক থেকে কবিরাজ গোবিন্দদাসকে বিদ্যাপতির আদর্শের অনুসারী বলে মনে করা হয়:
“ব্রজের মধুর লীলা যা শুনি দরবে শিলা
গাইলেন কবি বিদ্যাপতি।
তাহা হৈতে নহে ন্যূন গোবিন্দের কবিত্বগুণ
গোবিন্দ দ্বিতীয় বিদ্যাপতি॥”
হয়তবা বিদ্যাপতির প্রতি গোবিন্দদাসের গভীর অনুরক্তির সুবিদিত পরিচয় রয়েছে- বিদ্যাপতির লেখা ‘ত্রিচরণ’-এর প্রাপ্ত হয়ে তার চতুর্থ পদ পূরণ করেছিলেন তিনি। তাছাড়া এ দুই কবির যুক্ত ভণিতাতেও একাধিক ব্রজবুলি পদ পাওয়া গেছে। তাহলেও বিদ্যাপতির সঙ্গে আসলে গোবিন্দদাসের প্রকাশ শৈলীরই সাদৃশ্য বেশি, ভাবের বিচারে তাঁর অনুভব বিদ্যাপতির চেয়ে নিঃসন্দেহে গভীরতর। আর তার মূলে ছিল কবি প্রাণের চৈতন্যভক্তি।
শ্রীনিবাস আচার্যের মন্ত্র-শিষ্য ছিলেন কবিরাজ গোবিন্দদাস; আর শ্রীনিবাস আপন স্বভাব বৈশিষ্ট্যে চৈতন্যের অবতার বলে পূজিত হয়েছিলেন।
বৃন্দাবনের গোস্বামীকুলের দর্শনাদর্শে বাংলাদেশে চৈতন্যধর্মের পুনরুজ্জীবনেরও তিনি ছিলেন প্রাণকেন্দ্র। সেই প্রাণের প্রদীপ্ততা যোগ্যতম শিষ্যে প্রকাশিত হয়েছিল। গোবিন্দদাস মহাপ্রভুকে প্রত্যক্ষ করবার সৌভাগ্য পাননি। সেই দুঃখের অনুভবে তাঁর কবি প্রাণ সর্বদা আর্ত হয়েছিল।
পদ লিখে, চৈতন্যলীলা কথা স্মরণ করতে গিয়ে তিনি আক্ষেপ করেছেন, সেই প্রেমজগৎ থেকে ‘গোবিন্দদাস বহু দূর’। কিন্তু কালের ব্যবধানের উপরে ভক্তমনের একান্ত নিষ্ঠা সেতুবন্ধন রচনা করেছিল। গোবিন্দাসের কবিকল্পনা যেন দূরগমনের তপস্যা করেছিল, ফলে কৃষ্ণ অথবা চৈতন্যলীলার যেকোনো অংশের রূপ- রচনা করতে গিয়ে কবি তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েছেন। রচনাবন্ধন ঘটিয়েছিলেন বৃন্দাবনীয় দার্শনিক আদর্শে।
মহাপ্রভুর দিব্যোন্মাদ মনের প্রেমাকুতি, রাধার অদম্য কৃষ্ণ- পিপাসা, কৃষ্ণের লীলা কৌতুকের মাধুরী-কবি তাঁর তত্ত্বনিষ্ঠ ব্যক্তিমনের নিবিড়তায় অনুভব করেছিলেন। পরিশীলিত মনের সেই ধর্মচিন্তা দুর্লভ কলাকৌশলের সূত্রে বাঁধা পড়ে অতুল্য শিল্প সম্পদ অর্জন করেছে গোবিন্দদাসের কবিতায়। বিদ্যাপতির ব্রজবুলি পদে প্রেমের লাস্যময় রূপ তরঙ্গায়িত হয়েছে, গোবিন্দদাসের রচনায় ব্রজবুলির চলিষ্ণু ছন্দস্রোতে ভাব ও ভাবনার ‘গভীরতা সঞ্চারিত হয়েছে। ফলে ধ্বনিমাত্রিক প্রকাশ বিভঙ্গের সঙ্গে অনুভবমগ্নতা যুক্ত হয়ে তাঁর পদের ভাবরূপে অনেক সময়েই যেন মন্ত্রের মহিমা সঞ্চার করেছে। গোবিন্দদাসের রচিত কৃষ্ণের রূপ সাধনার একটি পদ:
“শ্যাম সুধাকার ভুবন মনোহর
রঙ্গিনী মোহন নটবর ৷৷
সজল জলদ তনু ঘন রসময় জনু।
রূপে জিতল কত কোটি কুসুমধনু ৷৷
থল-কমলদল অরুণ চরণ-তল
নখমণি রঞ্জিত মঞ্জু মঞ্জীর-কাল ৷৷
প্রেম ভরে অন্তর গতি অতি মন্থর।
অধর মুরলি ধনি মন্মথ মন্তর ৷৷
অভিনব নাগর গুণমণি সাগর।
গোবিন্দদাস চিতে নিতি নিতি জাগর ৷৷”
Leave a comment