অথবা, বৈষ্ণব পদকর্তা হিসেবে জ্ঞানদাসের কবি প্রতিভা বিচার কর

উত্তর: চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণব পদকর্তাদের মধ্যে জ্ঞানদাস বিশিষ্ট। বাঙালি পদকর্তাদের মধ্যে উৎকর্ষের দিক থেকে চণ্ডীদাস। ও গোবিন্দদাসের সাথে তাঁর তুলনা চলে। তিনি ভাববিদ্ধ প্রাণতন্ময় কবি প্রতিভার অধিকারী। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের যে দার্শনিক ও তাত্ত্বিক দিক ছিল তার সাথে জ্ঞানদাসের সম্যক পরিচয় ছিল। তিনি বৈষ্ণব ধর্ম সাধনা এবং ভক্তিমার্গের অবিচল নিষ্ঠা নিয়ে পদ রচনা করেছেন।

বৈষ্ণব কবিদের মধ্যে জ্ঞানদাস ছিলেন লিরিক-প্রতিভার অধিকারী। তাঁর কবিতাকে লিরিক ভাবসম্পন্ন বলা যায়। তাঁর গাঢ় অনুভূতির আকুতি ছিল এবং তিনি জানতেন কেমন করে সেই অনুভূতিকে সংহত তীব্র আকারে প্রকাশ করতে হয়। জ্ঞানদাসের পদে ব্যক্তিক কবিসত্তার লিরিকধর্মী প্রেমবেদনার প্রকাশ ঘটেছে। তিনি ভাব বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণের ধর্মীয় জগতের ছবি আঁকতে গিয়ে তারই ফাঁকে ফাঁকে আপন মনের নিভৃত ভাবনার স্পর্শ ঘটিয়েছেন। দৃষ্টান্ত,

আলো মুঞি কেন গেলু কালিন্দীর জলে।

কালিয়া নাগর চিত হরি নিল ছলে ।।

…………………………………

জাতি-কুল-শীল সব হেন বুঝি গেল।

ভুবন ভরিয়া মোর ঘোষণা রহিল (পদ-৬০)

ছলনাকারী নাগর কানু কদম্বতলে রাধার মন চুরি করেছে- এই বিস্ময়কর প্রেমানুভূতির চিত্রাঙ্কনে জ্ঞানদাস আর নিছক বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণ লীলার রূপকার নন। সর্বকালের যৌবনের দূত, তরুণ-তরুণীর জীবনে অনুভূত আনন্দ রহস্যময় অনুভূতির সহৃদয় চিত্রকর।

জ্ঞানদাস বৈষ্ণব কবি এবং তাঁর একটি বিশিষ্ট কবিমন ছিল। তাঁর মধ্যে ভক্তি প্রবণতা আছে সত্য এবং তাঁর আত্মনিবেদনও চমৎকার। তথাপি জ্ঞানদাসের কাব্য মিস্টিক হয়ে পড়েনি। তাঁর কাব্যের একটি প্রধান ও মূল ধর্ম- রোমান্টিকতা। রোমান্টিক রহস্যময়তায় জ্ঞানদাসের কাব্য পূর্ণ। এই রহস্যময়তাটুকু কবির নিজস্ব সম্পদ এবং অন্যান্য বৈষ্ণব কবির সাথে তাঁর পার্থক্য এখানেই।

জ্ঞানদাসের পদ আস্বাদন করতে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে কবিতার রহস্যময় রোমান্টিকতা। তাঁর কণ্ঠে এক রোমান্টিক কবির কণ্ঠ স্পন্দমান হৃদয়ের উচ্ছ্বাস বেজে উঠেছে। অলঙ্কারের সাহায্য না নিয়ে জ্ঞানদাসের রাধা তার চিত্তের আকুলতাকে প্রকাশ করেছে এভাবে,

‘রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়া রহিল।

যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।। (পদ-৬০)

পদ্যাংশগুলোতে যে প্রেমার্তি ও যৌবনানুভূতির অতলান্ত নিবিড়তা প্রকাশ পেয়েছে কবি তা আশ্চর্যভাবে পরিস্ফুট করে তুলেছেন। উপমারূপকাদি অলঙ্করণের সীমা অতিক্রম করে কবির রূপচিত্র এখানে চিত্রকল্পের স্তরে সমুন্নত।

জ্ঞানদাসের রাধা ধ্যানময়ী। আপন উপলব্ধির গভীরে প্রবেশ করে সে আত্মহারা। জ্ঞানদাসের রাধার দুই রূপ। পূর্বরাগে রূপতন্ময় বালিকার ভাব ব্যাকুলতা, অনুরাগে পরিণত প্রেমের কাছে আপনাকে নিঃশেষ করে আত্মনিবেদন। চণ্ডীদাসের রাধার মতো জ্ঞানদাসের রাধাও অনেকখানি কবির অন্তর সত্তারই প্রতিফলন। আপন-সৃষ্ট রাধিকার সাথে কবি প্রায় একাকার হয়ে গিয়েছেন। তাই রাধার বেদনায় কবির হৃদয়ের সবকটি তারে ঝঙ্কার উঠেছে। এই অর্থেই জ্ঞানদাস লিরিক কবি।

জ্ঞানদাসের কাব্যে একটি রোমান্টিক বিষয়ের সুর আছে। রূপে-গুণে, সম্ভোগে-মিলনে রাধার তৃপ্তি আসেনি। তাইতো রাধা বলেছে,

‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।

হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।

পরাণ-পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে।। (পদ-৬১)

কৃষ্ণপ্রেমের কাছে রাধার এই পরাজয়ের গৌরব বর্ণনার চিত্র বৈষ্ণব রোমান্টিকতার সাথে স্বপ্নের একটি গূঢ় সম্পর্ক আছে। স্বপ্নময় রোমান্টিক পদ রচনায় জ্ঞানদাস শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছেন। দৃষ্টান্ত,

রজনী শাঙন ঘন ঘন দেয়া-গরজন

রিমি ঝিমি শবদে বরিষে।

পালঙ্কে শয়ন রঙ্গে বিগলিত চীর অঙ্গে

নিন্দ যাই মনের হরিষে।। (পদ-৮৩)

এমন আশ্চর্য শব্দমন্ত্র, রূপচিত্র, রহস্যময় বর্ষার আবেষ্টনী, এমন ভাষা-সুর-ছন্দের অনিবার্য মায়াবিস্তার- সত্যিই জ্ঞানদাসের কবি প্রতিভার শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন পাওয়া যায়।

রোমান্টিক রহস্য প্রিয়তার সাথে সাথে মাধুর্যতাও জ্ঞানদাসের কাব্যের আরেকটি লক্ষণ। এই মাধুর্যতার কারণে জ্ঞানদাসের পদে বা কবিতায় অনুভূতির তীব্রতা অপেক্ষা সুমিত লাবণ্য বেশি সঞ্চারিত হয়েছে। সমালোচকের ভাষায়,

“জ্ঞানদাসের কাব্যের সর্বব্যাপী এই মাধুর্যগুণ অনেক ক্ষেত্রে অনুভূতির তীব্রতাকে পরিহার করিয়া সুমিত লাবণ্যের সঞ্চার করে। ফলে সেখানে সর্বগ্রাসী হাহাকার, মর্মবিদারুণ, সেখানে জ্ঞানদাসের প্রতিভা অসার্থক।………………….. জ্ঞানদাসের বেদনায় এতখানি গভীরতা নাই, বেদনাকেও তিনি সুমিষ্ট করিয়া প্রকাশ করেন। তিনি বিদ্যাপতির মতো আনন্দের কবি নহেন, গোবিন্দদাসের মতো উল্লাসের কবি নহেন, তিনি মাধুর্যের কবি।” [মধ্যযুগের কবি ও কাব্য: শ্রীশঙ্করী প্রসাদ বসু]

এ কারণে মাথুর-বিরহের পদ রচনায় জ্ঞানদাস সাফল্য দেখাতে পারেননি। অভিসার পদেও তিনি বিশিষ্ট রসাবেদন ফোটাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে আক্ষেপানুরাগ পদে জ্ঞানদাসের রাধার বেদনা অন্তরময়ী। কৃষ্ণপ্রেমে রাধার তৃষ্ণা অপূর্ণ থেকে যায়। তার কারণ বিশ্লেষণ করে রাধা বুঝেছে যে, প্রেম পরবশ পরের উপর নির্ভরশীল,- অনেক দুঃখে এত সহজ অথচ মর্মভেদী সত্যটি রাধা হৃদয়ঙ্গম করেছে। সমস্ত ভালোবাসা তাই মায়া বলে মনে হয়। দীর্ঘকালের চিত্তবিনোদন ব্যর্থ বলে ধারণা জাগে। রাধা বলে:

সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু

অনলে পুড়িয়া গেল।

অমিয়া-সাগরে সিনান করিতে

সকলি গরল ভেল।। (পদ-১২৪)

এখানে আক্ষেপানুরাগের সুরটি চমৎকারভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বস্তুত আপেক্ষানুরাগের পদগুলোতেই জ্ঞানদাসের কবি সত্তার প্রেম তন্ময় নিভৃত অনুভূতিটি যত সূক্ষ্ম সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে অন্যত্র ততটা নয়।

জ্ঞানদাসের রাধার মধ্যে ‘আমিত্ব’ ছিল। আত্মনিবেদনের পদে জ্ঞানদাসের রাধাকৃষ্ণের প্রেমভাজন হলেও তাঁর আত্মগৌরবটুকু ছাড়তে পারেনি। জ্ঞানদাসের রাধা সব দেয়, গৌরবটুকু দিতে পারে না-

বঁধু, তোমার গরবে গরবিনী আমি

রূপসী তোমার রূপে।

হেন মনে করি ও দুটি চরণ

সদা লইয়া রাখি বুকে ৷৷ (পদ-৩১০)

এই ‘আত্মগৌরব’ বা ‘আমিত্ব’ টুকু রাধা চরিত্রে অঙ্কন করে জ্ঞানদাস স্বতন্ত্র দেখিয়েছেন।

জ্ঞানদাসের পদে অলঙ্কারের ব্যবহার একেবারে নেই, এমন নয়; রূপের বস্তুবিদ্ধ ছবিও তিনি অঙ্কন করেছেন। কিন্তু একান্ত লৌকিক, কিছু বা গ্রাম্য দু একটি শব্দের ব্যবহারে, রূপদর্শনজাত মানস হিল্লোল ব্যক্ত করায়, বিস্ময়রসে ডুবে যাওয়ার ব্যঞ্জনায় তার ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্য অভিবক্ত। তাঁর ভাষায় রূপ কম, রূপাস্বাদই প্রধান। দৃষ্টান্ত :

শীতল বলিয়া ও চাঁদ সেবিনু

ভানুর কিরণ দেখি।

……………………..

পড়িনু অগাধ জলে।

লছিমী চাহিতে দারিদ্র্য বেঢ়ল

মাণিক হারানু হেলে।। (পদ-১২৪)

জ্ঞানদাসকে জয়দেব, বিদ্যাপতি বা গোবিন্দদাসের মতো ‘ছন্দ-সচেতন কবি’ বলা চলে না। তবে স্বভাবদত্ত ছন্দ সৌকর্যে তাঁর পদগুলো সার্থক হতে পেরেছে। যেমনঃ মিশ্র পয়ার: ৮/৬ মাত্রা-

‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।’ (জ্ঞানদাস পদ-৬১)

পরিশেষে জ্ঞান দাসের কবি প্রতিভার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করে বলা যায়, জ্ঞানদাস বৈষ্ণব ভক্ত হলেও এবং সাধকের চেতনা নিয়ে কবিতা লিখলেও খাঁটি কবিপ্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তাই ভক্তি ও তত্ত্বের রাজ্যে পরিভ্রমণ করলেও তাঁর পদগুলোতে কবিচিত্তের অকৃত্রিমতার স্পর্শ ছিল। এদিক দিয়ে তিনি বৈষ্ণব কবিকুলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ব্যতিক্রমী কবিধর্মের অধিকারী ছিলেন এবং এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য।