উত্তর : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় অধ্যায় বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্য। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা অবলম্বনে এই অমর কবিতাবলির সৃষ্টি এবং বাংলাদেশে শ্রীচৈতন্যদেব প্রচারিত বৈষ্ণব মতবাদের সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে এর বিকাশ সাধিত হয়। বৈষ্ণব সমাজে পদাবলীসমূহ মহাযান নামে পরিচিত। তাঁদের মতে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক বিদ্যমান। এই সম্পর্ককে বৈষ্ণব অনুসারীগণ রাধাকৃষ্ণের রূপাশ্রয়ে ভক্ত ও ভগবানের নিত্য বিরহ ও নিত্য মিলনের অপরূপ আধ্যাত্মিক লীলা কীর্তিত হয়েছে। তাদের উপাস্য দেবতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর প্রেমময় প্রকাশ ঘটেছে রাধার মাধ্যমে। রাধা মানবী নয়, শ্রীকৃষ্ণরূপী পূর্ণ ভগবৎত্তত্ত্বের অংশ। ভগবানের লীলা চলে তাঁর স্বরূপভূতা শক্তি রাধার সাথে। বৈষ্ণবেরা ভগবান ও ভক্তের সম্পর্কের স্বরূপ নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণকে পরমাত্মা বা ভগবান এবং রাধাকে জীবাত্মা সৃষ্টির রূপক মনে করে তাঁদের বিচিত্র প্রেমলীলার মধ্যে ধর্মীয় তাৎপর্য উপলব্ধি করেছেন।
মহাপ্রভু চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) তাঁর আবির্ভাবের পূর্বেই রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার মাধুর্য পদাবলীর গানের উপজীব্য হয়েছিল। কিন্তু চৈতন্যদেবের প্রভাবে যে নতুন মানবীয় প্রেম- ভক্তিধারার বিকাশ ঘটে তার অবলম্বনই বিপুল ঐশ্বর্যময় পদাবলী সাহিত্যের সার্থকতার রূপায়ণ সম্ভবপর হয়। বৈষ্ণব পদাবলীতে কৃষ্ণের রূপ দেখে রাধার প্রেম তপ্ত হৃদয়ের সীমাহীন আকুলতা তাদের পূর্বরাগ অনুরাগ অভিসার প্রভৃতি বিচিত্র পর্যায় বাস্তব মানব মানবীর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। আধুনিক কবি রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব কবিতায় লিখেছেন-
“শুধুই বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান
পূর্বরাগ অনুরাগ মান অভিমান
অভিসার প্রেমলীলা বিরহ মিলন
………………………………..
প্রতি রজনীর আর প্রতি দিবসের
তপ্ত প্রেম-তৃষা?”
রাধাকৃষ্ণের প্রেমের আনন্দ ভাবটি বৈষ্ণব কবিদের কবিতার বক্তব্যকে কাব্য করে তুলেছে এবং তা গোষ্ঠীগত চেতনায় রূপ দিয়েছে। সেখানে ব্যক্তিগত অনুভূতির ভূমিকা স্পষ্ট না হলেও বৈষ্ণব কবিদের অন্যতম বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দ দাস, জ্ঞানদাস প্রমুখের অতুলনীয় পদাবলীতে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে গীতিকাব্যের স্বতন্ত্র মর্যাদা দান করেছে, এর কাব্যসুধার বিস্তার মুসলিম কবিদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে।
পরিশেষে সমালোচক ব্রজেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সাথে একমত হয়ে বলতে পারি “কবিরা পৃথিবী এবং স্বর্গও আঁকিয়াছেন-কিন্তু বৈষ্ণব কবিরা পৃথিবী আর স্বর্গ এক করিয়া দেখিয়াছেন, ভক্তি আর ভালোবাসা এখানে এক হয়ে আছে।”
Leave a comment