“বৈষ্ণব কবিতা সমুদ্রগামী নদীর ন্যায়।…. বৈষ্ণব কবিতা নানারূপ পার্থিব সৌন্দর্যের পথ বাহিয়া চলিয়াছে – কিন্তু তাহার পরম লক্ষ্য সেই অজ্ঞেয় দুরধিগম্য মহাসত্য।”–আলোচনা করো।

বৈষ্ণব পদাবলীর স্রষ্টা জয়দেব গোস্বামী। তাঁর রচিত ‘গীতগোবিন্দ’ গ্রন্থেই সর্বপ্রথম রাধাকৃষ্ণের লীলাকাহিনীকে অবলম্বন করে পদাবলী সাহিত্যের সূত্রপাত। অবশ্য এর পূর্বে বিভিন্ন সংস্কৃত এবং প্রাকৃত প্রকীর্ণ কবিতায় রাধা কৃষ্ণ লীলার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণাদিতে রাধাকৃষ্ণের যে বিস্তৃত কাহিনী পরিবেশিত হয়েছে, একদিকে তাকে যেমন ‘পদাবলী সাহিত্য’ সংজ্ঞায় অভিহিত করা চলে না, তেমনি এর উদ্ভব ঘটেছিল জয়দেবোত্তর যুগে- সম্ভবত এই অনুমান অযৌক্তিক নয়। এর পরই বাংলা ভাষায় বড়ু চণ্ডীদাস রচনা করেন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বা ‘শ্ৰীকৃষ্ণসন্দর্ভ’ নামক পালাকীর্তন তথা নাট-গীতি এবং ব্রজবুলি ভাষায় কবি বিদ্যাপতি রচনা করেন রাধাকৃষ্ণ লীলাসুচক বিভিন্ন রসপর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত কিছু বিচ্ছিন্ন পদ। কিন্তু এঁরা কেউ বৈষ্ণব পদাবলীকে নিয়ে কোনো আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারেননি। চৈতন্যদেবের আবির্ভাব এবং তার সাধন জীবন মুটিত হয়ে খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় সৃষ্টি করে এবং এই বৈষ্ণবগণই চৈতন্যদেবের মধ্যে যুগপৎ রাধাকৃষ্ণের লীলা অনুভব করে নানা রসাত্মক বৈষ্ণব পদাবলী রচনায় প্রবৃত্ত হন। ফলত তাদের এই উদ্যোগ স্বল্পকালেই এক বিরাট আন্দোলনে পরিণত হয়। আধ্যাত্মিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এই বৈষ্ণব পদাবলী একটা মুক্ত উদার সর্বজনীন রসবিগ্রহে পরিণত হয়। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন এ বিষয়ে অতিশয় যুক্তিযুক্ত মন্তব্য করে বলেছেন, “বৈষ্ণব কবিতা সমুদ্রগামী নদীর ন্যায় নদী চলিয়াছে, দুই দিকে তটভূমি, তাহা আনন্দ-কলরবে মুখরিত করিয়া নদী চলিতেছে….. কিন্তু নদী যখন মোহনায় আসিল, তখন সে-সমস্ত দৃশ্য সে পশ্চাতে ফেলিয়া আসিয়াছে…. সম্মুখে দুর্ভেদ্য প্রহেলিকার মতো অসীমের প্রতীক মহাসমুদ্র। বৈষ্ণব কবিতা নানারূপ পার্থিব সৌন্দর্যের পথ বাহিয়া চলিয়াছে—কিন্তু তাহার পরম লক্ষ্য সেই অজ্ঞেয় দুরধিগম্য সত্য।… বৈষ্ণব কবিতা এইভাবে জানা পথ দিয়া লইয়া গিয়া অজানার সন্ধান দেয়।”

এই কারণেই বৈষ্ণব পদাবলীকে বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাষ্য বলা হয়। বৈষ্ণব দর্শনে যে পঞ্চরসের কথা বলা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে যে মধুর রসকে শ্রেষ্ঠ স্থান দান করা হয়েছে বৈষ্ণব – কবিতায় রয়েছে তারি অসংখ্য সার্থক নিদর্শন। এই কারণে ভক্ত বৈষ্ণবের নিকট বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্য-রসোচিত হওয়া সত্ত্বেও এর প্রধান আবেদন ধর্মীয়, পক্ষান্তরে সাধারণ পাঠকের নিকট প্রধান আকর্ষণ এর ভাবের সৌরভ এবং গঠনের সৌন্দর্য। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “বৈষ্ণব ধর্ম পৃথিবীর সমস্ত প্রেমসম্পর্কের মধ্যে ঈশ্বরকে অনুভব করিতে চেষ্টা করিয়াছে।” এই সমস্ত পরমপ্রেমের মধ্যে একদা সীমাতীত লোকাতীত ঐশ্বর্য অনুভব করিয়াছে।” বৈষ্ণবপদকর্তাগণ রাধাকৃষ্ণের অপ্রাকৃত অথচ নিত্যলীলাকে প্রাকৃত নরনারীর প্রেমলীলার মানদণ্ডে রচনা করেছেন বলেই এগুলোর আস্বাদ্যতা সর্বজনীনতা লাভ করবার সুযোগ পেয়েছে। লৌকিক জগতের প্রেক্ষাপটের ধূলিধূসরতায় নেমে এসেছে অলৌকিক অনুভূতি।

জয়দেবের পূর্বেই প্রাকৃত প্রেমের আদর্শে প্রাচীন ভারতে যে কাব্য রচিত হত, সেই ধারা মধ্যযুগে বৈষ্ণব কবিতার সঙ্গে মিশে যাওয়াতেই নিছক কাব্য রচনার তাগিদেও যে কেউ কেউ রাধাকৃষ্ণের কাহিনী অবলম্বনে ব্রতী হয়েছিলেন, তার প্রমাণ বহু মুসলমান কবিও বৈষ্ণবপদ রচনা করেছিলেন। কাজেই বৈষ্ণব কাব্যের অসাম্প্রদায়িকতাও অবশ্য স্বীকার্য। তাই দেখা যায়, অসংখ্য কবি—যাঁদের অনেকেই ছিলেন সম্ভবত অবৈষ্ণব তাদেরও অগণিত পদ রচিত হয়েছে। এদের সংখ্যা এত বেশি যে আজ পর্যন্ত কোনো একটি মাত্র সঙ্কলন গ্রন্থে সমগ্র বৈষ্ণব পদের সমাহার সম্ভবপর হয়নি। এই কারণেই কাব্যধর্মী বৈষ্ণবপদগুলিকে বসস্তের অপর্যাপ্ত পুষ্পমঞ্জরীরূপে কল্পনা করা চলে–সংখ্যার অতিশয়তায় এবং গুণের উৎকর্ষে বৈষ্ণব কবিতা বিষয়ে অনুরূপ কল্পনা সঙ্গতিপূর্ণই বিবেচিত হয়। চণ্ডীদাসের ‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম / কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো / আকুল করিল মোর প্রাণ। অথবা বিদ্যাপতির ঈ ভরা বাদর মাহ ভাদর / শূন্য মন্দির মোর’ কিংবা জ্ঞানদাসের ‘রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়ে রহিল। যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেলু।।’ অথবা ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর। প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।’ অথবা গোবিন্দদাসের ‘রূপে ভরল দিঠি সোডরি পরশ মিঠি / পুলক না তেজই অঙ্গ।’ প্রভৃতি পদে যে অপূর্ব ভাবানুভূতি আত্মপ্রকাশ করেছে তার সৌরভ দেশ-কাল-ব্যক্তির সীমাকে অতিক্রম করে যায়। শুধু এই কটি পদই নয়, বৈষ্ণব সাহিত্যে এমন অসংখ্য পদ রয়েছে যা সৌরভ সর্বজনমনোগ্রাহিত্ব লাভ করে থাকে।

বৈষ্ণবপদগুলো যে শুধু ভাবের দিক থেকেই উৎকর্ষ লাভ করেছে তা নয়, গঠন-সৌন্দযে‌দিক্‌ থেকেও এদের বৈচিত্রা এবং মাধুর্য স্বীকার করে নিতে হয়। পয়ার, ত্রিপদী, দিগক্ষরা, একাবলী আদি বিভিন্ন পদবন্ধ রচনা করে বৈষ্ণব কবিরা গতানুগতিকতা পরিহার করেছেন। সমগ্র বাংলা সাহিত্যে একমাত্র বৈষ্ণব কবিতাতেই বাংলা ছাড়াও ‘ব্রজবুলি’ নামক অপর একপ্রকার ভাষারীতি ব্যবহার করা হয়েছে। বিদ্যাপতি এর প্রথম শিল্পী, পরে গোবিন্দদাস এবং আরো অনেকেই বৈষ্ণবপদ রচনায় এই ব্রজবুলি ভাষা সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন। বিভিন্ন ছন্দে পদ রচনায়ও বৈষ্ণব কবিদের কৃতিত্ব অসাধারণ। তাঁরা বাংলা ভাষায় রচিত কবিতাগুলোতে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ এবং ব্রজবুলির পদে প্রত্নমাত্রাবৃত্ত ছন্দ ব্যবহার করেছেন। আবার লোচনদাস এবং আরো কেউ কেউ লৌকিক ছন্দ তথা স্বরবৃত্ত ছন্দেও কিছু সার্থক পদ রচনা করেছেন।

বৈষ্ণব পদাবলীর এই সর্বাঙ্গীণ অসাধারণত্ব লক্ষ্য করেই অধ্যাপক শ্রীপরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন, “সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে যদি এমন কোনো শাখার নাম উল্লেখ করিতে হয়, যাহা বিশ্বসাহিত্যে স্থানলাভের যোগ্য, তবে নিশ্চিতই বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের কথাই বলিতে হইবে। ধর্মের সহিত ইহার কিছু সম্বন্ধ বর্তমান থাকিলেও এই সাহিত্য যে রসের বিচারে দেশকালের সীমাকে অতিক্রম করিয়া গিয়াছে, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। কোন গুণে বৈষ্ণব সাহিত্য কালকে জয় করিবার শক্তি অর্জন করিয়াছিল, তৎসম্পর্কে বলিতে গিয়া রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব কবিতার প্রেমের দিকটাই বিশেষভাবে দেখিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, … এই প্রেমের শক্তিতে বলীয়সী হইয়া আনন্দ ও ভাবের এক অপূর্ব স্বাধীনতা প্রবলবেগে বাংলা সাহিত্যকে এমন এক জায়গায় উত্তীর্ণ করিয়া দিয়াছে যাহা পূর্বাপরের তুলনা করিলে হঠাৎ খাপছাড়া বলিয়া বোধ হয়। তাহার ভাষা, ছন্দ, ভাব, তুলনা, উপমা ও আবেগের প্রবলতা সমস্তই বিচিত্র ও নূতন।… দেখিতে দেখিতে দশে মিলিয়া এক অপূর্ব সঙ্গীতপ্রণালী তৈরি করিল, আর কোনো সঙ্গীতের সহিত তাহার সম্পূর্ণ সাদৃশ্য পাওয়া শক্ত। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য ও অনুবাদ সাহিত্যের যুগে এইভাবে বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে আপনার পথ করিয়া লইয়াছিল।” (বাঙলা সাহিত্যের পরিচয়)

বৈষ্ণব পদ রচনায় মধ্যযুগের বহু কবিই অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করলেও এ বিষয়ে বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাসই অপরদের আদর্শ বা গুরুস্থানীয় বলে বিবেচিত হন। স্বয়ং মহাপ্রভু চৈতন্যদেবও যে এঁদের কাব্যের আস্বাদগ্রহণ করে পরম পুলকিত হতেন, তার সাক্ষ্য রেখে গেছেন চৈতন্য জীবনীকারগণ, এঁদের মধ্যে বিদ্যাপতি রসের দিকে ছাড়াও আঙ্গিকের তথা বহিরাচরণের দিনে ছিলেন যতটা মনোযোগী, চণ্ডীদাসও ততটাই মনোযোগী ছিলেন ভাবের গভীরতা ও আন্তরিকতা প্রকাশে। বস্তুত বৈষ্ণব সাহিত্যের ইতিহাসে এই দুই মহাজনপদকর্তাই কাব্যকে সামগ্রিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলেছিলেন। এই প্রসঙ্গে একালের কবিদের মধ্যেও যে বৈষ্ণব কবিদের প্রভাব কতটা দৃঢ়মূল, তার দু’টি বিশিষ্ট দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত মাইকেল মধুসুদন দত্তের ব্রজাঙ্গনা কাব্য এবং বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ব্রাহ্মমতাবলম্বী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ যে বৈষ্ণবপদের অনুকরণেই রচিত হয়েছিল, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বৈষ্ণব কবিতার এই কাল ও ধর্মবন্ধন মুক্তির প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্তই তার উৎকর্ষের শ্রেষ্ঠ পরিচায়ক।