বৈষ্ণব পদাবলী গীত কবিতা কিনা এনিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও এর গীতি ধর্মবিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। বাঙালি মানসে যে গীতি প্রবণতার সুর চর্যাপদের যুগ থেকে আরম্ভ করে সাহিত্য ধারায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রবাহিত হয়ে আসছিল, বৈক্ষ্ণব পদাবলীতে তা উত্তাল কলরোলে পরিণত হল, বৈক্ষ্ণব পদাবলীর গীতি কাব্যিক লক্ষণ বিচারের পূর্বে গীতি কবিতার স্বজন সম্পর্কে আলোচনা করে নেওয়া যাক—
লিরিক বা গীতি কবিতার উদ্ভব গেয় কবিতা হিসাবে। প্রাচীনকালে Lyre নামে একপ্রকার বাদ্যযন্ত্রের সাথে গীত কবিতাকে গীতি কবিতা বলা হত। Lyric poetry is the original meaning of the term, was poetry composed to be sung to the accom paniment of “Lyre or harp” সেই হিসাবে প্রাচীন Ballad এমনকি মহাকাব্যের গীতিকবিতা বলা যায়। এই নিরিখে বৈষ্ণব পদাবলী অবশ্যই গীতি কবিতা। কারণ মূলত গান হিসাবে এই কবিতার জন্ম হয়েছিল। সুনির্দিষ্ট রাগ রাগিনীর সাহায্যে গীত বৈষ্মব পদের আবেদন ও ব্যঞ্জনা স্রোতকে এক রহস্যময়তার আবেশ ভরা মাতুর্যের জগতে নিয়ে যায়। প্রতিটি বৈব পদের প্রারম্ভে গান্ধার, বরাড়ী, ভৈরবী, বসন্ত ইত্যাদি রাগ রাগিণীর উল্লেখ এর ধর্মেরই ইঙ্গিতবহ।
কিন্তু আধুনিক গীতিকাব্যের বৈশিষ্ট্য একেবারে স্বতন্ত্র। এখনকার গীতি কবিতার সাথে গানের কোনো সম্পর্ক নেই। আসলে গীতি কবিতা এমন এক বিশেষ রচনা যাতে “The poet is prinorcipally accupied with him self” কবির ব্যক্তি মনের নিবিড় অনুভূতি যখন ছন্দায়িত প্রকাশের মাধ্যমে বিশ্বমনের হয়ে ওঠে। তখনই হয় গীতি কবিতা। গীত কবিতা ও গেয় কবিতার পার্থক্য বঙ্কিমচন্দ্র অত্যন্ত সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন—“গীত হওয়াই গীতি কবিতার আদিম উদ্দেশ্য কিন্তু যখন দেখা পেল যে গীত না হইলেও কেবল ছন্দ বিশিষ্ট রচনা আনন্দদায়ক এবং সম্পূর্ণ চিত্তভাব ব্যঞ্জক তখন গীতদ্দেশ্য দূরে রহিল। অগেয় গীতিকাব্য রচিত হইতে লাগিল।”
গীতি কবিতায় একটিমাত্র ভাবের গাঢ়বদ্ধ প্রকাশ হয় সংক্ষিপ্ত পরিসরে। কারণ ভাবের অতিবিস্তার ঘটলে তার সংহতি গাঢ়ত্ব ও ব্যঞ্জনা অনেক পরিমাণে শিথিল হয়ে পড়ে। কোনো তত্ত্ব কথা নয় গভীর আবেগের সংযত প্রকাশেই গীতি কবিতার সার্থকতা। গীতি কবি হৃদয় থেকে হৃদয়ে তাঁর বক্তব্যকে সঞ্চার করেন এই যে হৃদয়ের সুরে গান গেয়ে ওঠা তাতে ব্যক্তির মনের অনুভূতিতে সর্বদলের সর্বদেশের মানুষের মনের কথা প্রতিধ্বনিত হয়।
লিরিকের উদ্দেশ্য-চিত্তে আনন্দরসের সঞ্চার। নিছক কোনো তত্ত্ব কথা নয় ব্যক্তি হৃদয়ের নিবিড় ও গভীর ভাবরসের সোনার কাঠির ছোঁয়ায় পাঠকের মনে যে বোধের উদ্বোতন হয় তা আনন্দের। নিবিড় রাখাল লব্ধির দ্বারাই এই আনন্দের আস্বাদন সম্ভব। গবেষকের ভাষার–“কিন্তু তত্ত্বসাল কথা শোনানো বা কোনো কিছু প্রতিপন্ন করতে যাওয়া লিরিকের কাজ নয়। তার কাজ হয়ে নিছক আনন্দ প্রকাশ করা আর সেই আনন্দের ধ্বনির দ্বারা অপরের মনের ভিতর আনন্দ জাগিয়ে তোলা।” [ বাংলা লিরিকের গোড়ার কথা ]
এইজন্যই গীতিকবিতায় আত্মভাবলীন মন্ময়তার প্রাধান্য।
বৈষ্ণব কবিতায় গীতি কবিতার সৌরভ, মাধুর্য, মুৰ্চ্ছনা স্পষ্টই অনুভব করা যায়। বিশেষ করে প্রাক-চৈতন্যযুগের কবি বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের পদে গোষ্ঠীগত ভাবনা প্রধান না হয়ে ওঠায় সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই কবিমানসের নিবিড় ভাবানুভূতির প্রকাশ লক্ষ্য করা যাবে। এমন কি চৈতন্য যুগের কবিরাও অলৌকিক রাধা কৃষ্ণপ্রেমকে মর্ত জীবনের পাত্রে পরিবেশন করেছেন। বৈষ্ণব পদকর্তা যখন রাঠীর কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন—“এ জমি হামারি দুখের নাহি ওর এভরা বাদর নাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর” তখন নিখিল বিয়হী হৃদয়ের নিদারুণ মর্মবেদনা দিকে দিগন্তে পরিপ্লাবিত করে তোলে। সেই শূন্যতার বেদনায় উপলব্ধি ভাব বৃন্দাবন অপেক্ষা মর্ত্যজীবন বেদনাকেই মনে করিয়ে দেয় রবিকে তখন মনে হয় নিখিল বিড়হী হৃদয়ের প্রতীক ত্যাগ বৈষ্ণব কবিতা গেয় কবিতা হিসাবে সার্থক একথা ঠিক। এর সংগীত মাধুর্যকে অস্বীকার করা যায় না। পাঠ্য গীত কবিতার রসমূল্যে ও বৈষ্ণব পদাবলীর সার্থক এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বৈষ্ণব পদাবলীর এই সার্বজনীন আবেগের দিকটি সমালোচক সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন—“বৈষ্ণব পদাবলী সর্বাংশে উৎকৃষ্ট গীতি কাব্যের লক্ষণাক্রান্ত” (সতীশ চন্দ্র রায়)। বঙ্কিমচন্দ্র ও উৎকৃষ্ট গীতি কবিতা হিসাবে বৈশুব পদাবলী উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করেছেন মানব জীবনের সুখ, দুঃখ মিলন বিরহের শাশ্বত বাণী চিত্র হিসাবে বৈব পদাবলী চিরন্তন রস ও ভাবমূল্য বহন করে।
তবু বৈষ্ণুব পদাবলীকে পুরোপুরি গীতি কবিতা বলতে আপত্তি আছে কারণ বৈষ্ণব পদাবলী বৈব তত্ত্বের রসভাষ্য। বৈশ্বব পদকর্তারা রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলা তত্ত্বরূপকে কাব্যকার প্রকাশ করেছেন। আপ্রাকৃত রাধী প্রেমকে ওঁরা প্রকৃত ভাষায় প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন। অন্য কোনো উপায় ছিল না। গীতি কবিতার কবিমনের বিশেষ অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। সেদিক থেকে ও বৈশ্তব পদাবলীকে গীতি কবিতা বলা চলে না, কারণ—গৌড়ির বৈব রসতত্ত্বের কাব্যকারে প্রকাশিত হয়েছে। কবিদের ব্যক্তিমনের উপলব্ধি প্রকাশের সুযোগ এখানে আদৌ ছিল না। কিন্তু গীতি কবিতা ভাব ও প্রকাশ ভঙ্গির দিক থেকে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল। গীতি কবিতার ভাব একান্তভাবেই তাঁর নিজের প্রকাশ ভঙ্গিও তাই। তাছাড়া পাঠ্য হিসাবে সব বৈক্ষ্ণব পদই উৎকৃষ্ট নয়। গেয় হিসাবে বৈষ্ণব পদাবলী রচিত। এমন কি তত্ত্ববাক্য অনেক ক্ষেত্রে সাত্মক কাব্য হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া গানের রচিত বলে অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ করে ব্রজবুলিতে লিখিত পদসমূহে ছন্দের মাত্রা হ্রাস বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে যা সুরের বিষয়ে মাঝে খাপ খেয়ে যায়, কিন্তু সাধারণভাবে পড়তে গেলে পাঠকের পক্ষে বিশেষ অসুবিধা ঘটে, “কিন্তু গায়কের কাঠের মুখাপেক্ষী হইয়া গীতি কবিতা রচিত হয় না। বৈষ্ণব পদাবলী অধিকাংশ রচিত হয়েছে সুরের দিকে লক্ষ্য করিয়া।” (কালিদাস রায়) তাছাড়া গীতি কবিতা ছোটো কী বড়ো হয়ে তার কোনও ধরা বাঁধা নিয়ম নেই—কবিমনের অন্তর্নিহিত ভাবটি সম্পূর্ণভাবে পরিস্ফুট হতে যতটা পরিসরের প্রয়োজন গীতি কবিতা সেই হিসাবে বড়ো হয়। তবে সংকীর্ণ পরিসয়ে ভাবটি নিটোল ঘনবদ্ধ ও পরে রসায়িত অধিক হয় এইমাত্র। সেই হিসাবেও বৈষ্ণব পদাবলী গীতি কবিতা নয়। কারণ গানের জন্য রচিত বলেই একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে তাকে শেষ করতে হত।
সুতরাং স্পষ্টই সিদ্ধান্ত নেয়। চলে যে আবেগ, গভীরতা আন্তরিকতা ও মর্মস্পর্শিতা এবং প্রকাশ ভঙ্গির অসামান্যতায় বৈব কবিতা প্রথম শ্রেণির গীতি কবিতার লক্ষণাক্রান্ত হলেও সঠিক অর্থে গীতি কবিতা একে বলা চলে না।
Leave a comment