অথবা, গীতিকবিতা হিসেবে বৈষ্ণব পদাবলির সার্থকতা নিরূপণ কর

“বৈষ্ণব কবিতা এক সীমিত অর্থে গীতিকবিতা।”

উত্তর : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদসাহিত্য এক গৌরবময় ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে। সেকালের হয়েও একালের প্রেমানুভূতির সাথে সেতুবন্ধ রচনায় কয়েকজন বৈষ্ণব কবির রচনা সৌকর্য ও আবেগ গভীরতা চমৎকার সাফল্যের সৃষ্টি করেছে। বৈষ্ণব ও কবিরা এক বিশেষ ধর্মীয় তত্ত্বের প্রেক্ষাপটে তাঁদের অপূর্ব সুন্দর পদগুলো রচনা করলেও এগুলোর সর্বজনীন আবেদন অনেক গভীর। স্বভাবত আধুনিককালের গীতিকবিতার সাথে এদের তুলনা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

বৈষ্ণব পদাবলীকে আমরা ‘বৈষ্ণব গীতিকবিতা’ নামে আখ্যায়িত করে থাকি। এ বৈষ্ণব কবিতা আমাদের মনে যে অনির্বচনীয় আস্বাদ ও ভাবাবেগের সৃষ্টি করে সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে এটি পৃথিবীর যেকোনো সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতার সমকক্ষতার স্পর্ধা দাবি করতে পারে। তবে বৈষ্ণব পদসাহিত্যকে গীতিকবিতা বলার যৌক্তিকতা কতখানি তা আলোচনার পূর্বে গীতিকবিতার স্বরূপটি জেনে নেওয়া দরকার।

‘গীতিকবিতা’ কথাটির অর্থ গান ও কবিতার সংমিশ্রণ। ইংরেজিতে একে বলা হয় Lyric। সংগীতমূলক এই কবিতাগুলো বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গীত হতো বলে এদের নাম হয়েছিল Lyric বা গীতিকবিতা। আদিতে গীতিকবিতা ছিল গীতাত্মক। বৈষ্ণব কবিতাও মূলত পাঠ্য কবিতা নয়, গেয় কবিতা। অতএব, মূল অর্থে বৈষ্ণব কবিতার Lyric বা গীতিকবিতা আখ্যাই বিধেয়। কিন্তু আধুনিককালে কাব্য বিচারের মান পরিবর্তিত হয়েছে; তাই আধুনিককালের বিচারে গীতিকবিতা হিসেবে বৈষ্ণব কবিতার মান নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

আধুনিককালে গীতিকবিতা বলতে বুঝা যায় মন্ময় কবিতাকে। এটি একান্ত ব্যক্তিনিষ্ঠ। বিশ্ব প্রকৃতির অপর সৌন্দর্যলীলা কবির মনে যে আবেগের সৃষ্টি করে সেই অনুভূতির উচ্ছ্বাস কবি যখন সংগীত মুখর ছন্দে রূপায়িত করেন তখনই হয় গীতিকবিতার জন্ম। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়, “বক্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটন মাত্র যাহার উদ্দেশ্য, সেই কাব্যই গীতিকাব্য।”

আধুনিককালে গীতিকবিতার প্রধান উপাদান কবির অনুভূতির বাত্ময় প্রকাশ। অর্থাৎ কবির একান্ত আপন হৃদয়ের ব্যক্তিগত ভাবোচ্ছ্বাস বা ব্যক্তিক অনুভূতি।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “যাহাকে আমরা গীতিকাব্য বলিয়া থাকি, অর্থাৎ যাহা একটুখানির মধ্যে একটি মাত্র ভাবের বিকাশ, ঐ যেমন বিদ্যাপতির- ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর’- সেও আমাদের মনের বহু দিনের, অব্যক্ত ভাবের একটি কোনো সুযোগ আশ্রয় করিয়া ফুটিয়া ওঠা।”

রবীন্দ্রনাথের এই গীতিকবিতার স্বরূপ বিশ্লেষণ থেকে আমরা বুঝতে পারি গীতিকবিতা আকারে ছোটো হবে এবং তাতে মূলভাব থাকবে একটাই। এখন আমরা দেখব, বৈষ্ণব পদাবলীতে গীতিকাব্যের স্বরূপ কতখানি প্রকাশ পেয়েছে।

বৈষ্ণব পদাবলী বাংলার প্রাচীন গীতিকবিতা। এগুলো মধ্যযুগীয় সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ফসল। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে আশ্রয় করে রচিত এ বৈষ্ণব কবিতা ‘আমাদের মনকে একে অলৌকিক জগতের স্বর্ণ দুয়ারে পৌঁছে দেয়।’ তবে বৈষ্ণব কবিতা রচিত হয়েছিল মূলত কীর্তনের গান। সেই হেতু এতে সুর ও সংগীতের মিশ্রণ রয়েছে। দৃষ্টান্ত:

ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর।

পর কৈনু আপন, আপন কৈনু পর ৷৷ (দ্বিজচণ্ডীদাস-পদ-১২২)

কিংবা, ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।

এ ভরা বাদর মাহ ভাদর

শূন্য মন্দির মোর। (বিদ্যাপতি পদ-২৪৯)

এগুলোতে অন্তরের অনুভূতি, আবেগ ও আকুলতা যেভাবে সুরের মধ্য দিয়ে প্রাণ পেয়েছে তার তুলনা পাওয়া ভার। গীতিকবিতা আদিম যুগে যেমন সুর ও তালে গীত হতো; বৈষ্ণব কবিতায় সেই লক্ষণ বিদ্যমান। এভাবে বৈষ্ণব কবিতা প্রাচীন গীতিকবিতার লক্ষণাকান্ত।

আবার বৈষ্ণবতত্ত্বকে অবলম্বন করে রচিত পদাবলীকে বৈষ্ণব পদাবলী নামে অভিহিত করা হয়। যাঁরা এই পদাবলী রচনা করেন, তাঁরা মহাজন। মহাজনগণ রাধাকৃষ্ণের প্রেমের লীলা ‘লীলাশুকের’ মত দর্শন করে ভক্ত গদগদ চিত্তে পদাবলী রচনা করেন। রচনাকালে তাঁরা বৈষ্ণবতত্ত্বের অনুশাসনকে মেনে চলেন। ফলে সেখানে তাঁদের স্বকীয় কল্পনার কোনো অবকাশ থাকে না। যদিও শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতার এটাই প্রধানতম লক্ষণ। কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলীতে একটি বিশিষ্ট গোষ্ঠীগত চেতনার প্রকাশ ঘটে। যেখানে গোষ্ঠীচেতনা সেখানে ব্যক্তিগত অনুভূতির কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। তবে বৈষ্ণব পদাবলী সম্পর্কে একথা। সর্বাংশে সত্য নয়। কেননা সাধন সংগীত জাতীয় দু’চারটি বৈষ্ণব কবিতায় কবির ব্যক্তিক উপলব্ধি কখনও গোষ্ঠিক চেতনাকে ছাপিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। অথবা ভাষারূপের সৃষ্টিতে গোষ্ঠীবোধকে ব্যক্তিত্বের রঙে ছাঁপিয়ে খাঁটি গীতিকবিতা করে তুলেছে। এর প্রপদাবলীর উরেবিদ্যাপতি। চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাসের পদাবলীর উল্লেখ করতে পারি। তাঁদের বৈষ্ণব কবিতায় আধুনিক অর্থে গীতিধর্মের প্রকাশ লক্ষ করা যায়। চণ্ডীদাসের রাধার বর্ণনা লক্ষ করলে দেখা যায় কবি চণ্ডীদাস প্রায় সম্পূর্ণত রাধার সাথে আপন কবিসত্তার সুগভীর বেদনাকে একাকার করে ফেলেছেন। রাধার আর্তি যেন চণ্ডীদাসের-

‘সই, কেবা শুনাইল শ্যাম-নাম।

কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো

আকুল করিল মোর প্রাণ॥’ (পদ-৫৭)

কিংবা, জ্ঞানদাসের পদে লক্ষণীয়-

‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর৷৷। (পদ-৬১)

এছাড়া বৈষ্ণব কবিতাগুলোর মানবিক অনুভূতিজাত রসাবেদন সাধারণভাবে এদের কাব্যমূল বৃদ্ধি করেছে। রাধাকৃষ্ণের প্রেমোপলব্ধি এ কবিতাগুলোতে আবেগ ও উচ্ছ্বাসে বিচিত্র রূপ ধারণ করেছে। কবির ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎ প্রকাশ না হলেও, রাধা বা কৃষ্ণের মানসিক নানা ভাব ও অনুভূতিকে এই কবিতাগুলো ধরে রেখেছে। বস্তুজগৎ এসব কবিতায় স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেনি, রাধা বা কৃষ্ণের মানস উল্লাস বা বেদনার বর্ণসম্পাতে রঞ্জিত হয়ে দেখা দিয়েছে। দৃষ্টান্ত,

সই, কেমনে ধরিব হিয়া।

আমার বধুয়া আন বাড়ী যায়

আমার আঙিনা দিয়া। (পদ-১৯০)

এখানে রাধার মানস প্রতিক্রিয়ার ঐ বিশেষ ধারাটি কবির অন্তর থেকেই রাধার উপরে আরোপিত। বস্তুর রূপান্তর এখানে কবিচিত্তের বর্ণসম্পাতের ফল। এদের গীতিধর্ম এখানে পরোক্ষ।

আবার গীতিকবিতার রূপরীতির দুটি দিক- চিত্রধর্ম ও সংগীত ধর্ম। বৈষ্ণব কবিতায় তা লক্ষ করা যায়। চণ্ডীদাস জ্ঞানদাসের সংগীত রীতি ও চিত্র কল্পের অস্পষ্ট রহস্যপ্রবণতা তাঁদের কবিচিত্তের অধিক গীতিধর্মেরই ফল। অন্যদিকে, বিদ্যাপতি গোবিন্দদাসের চিত্রধর্মের প্রাধান্য হেতু তাঁদের রচনাকেও গীতিকবিতার রাজ্য থেকে নির্বাসন দেওয়া যায় না।

রোমান্টিক সুদূরতা, অসীম অরূপের রহস্য ও তৃষ্ণা ব্যতীত সার্থক গীতিকবিতা রচিত হতে পারে না। বৈষ্ণব কবিতায় রোমান্টিকতার এ কবিতার মধ্যে একটি আকুলতা, একটি করুণ সেন রয়েছে রিবেশের পরিচয় আমরা লক্ষ করি। বৈষ্ণবতত্ত্বের মধ্যেই নিহিত আছে বেদনার আলিঙ্গন। সে তত্ত্বে বলা হয়েছে-

“ভক্ত ও ভগবান নিত্য প্রেমের সম্পর্কে সন্নিবিষ্ট। নিত্য মিলনের প্রয়াসে উভয়ের নিবিড় প্রেমের পরাকাষ্ঠা। ভগবানের সহিত লীন হইয়া যাইবার সাধনাই ভক্তের সাধনা। যতক্ষণ ভক্ত মিলিত হইতে পারিতেছে না, ততক্ষণ তাহার কেবল ছুটিয়া চলা, কেবলই উধাও হইবার মন্ত্রে বেদনার্ত ক্রন্দনের কলরোল।” (সূত্র : বৈষ্ণব পদাবলী আলোচনা: ব্রজেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য)

বৈষ্ণব কবিরা ঈশ্বরকে প্রেমিকরূপে কল্পনা করেছেন, তবে তাঁরা নিজেরা প্রেমিকার ভূমিকা গ্রহণ করেননি; প্রেমিকা স্বয়ং রাধা চন্দ্রাবলী, নিজেরা সখীরূপে দূর থেকে কল্পনার চোখে সেই লীলা প্রত্যক্ষ করেছেন। বৈষ্ণব কবিতায় রাধাকৃষ্ণের রূপাশ্রয়ে ভক্ত ভগবানের নিত্য বিরহ, নিত্য-মিলনের অপরূপ আধ্যাত্মিক লীলা কীর্তিত হয়েছে। বৈষ্ণব পদাবলীর মধুর রসের মধ্যে এই লীলাবৈচিত্র্যের সন্ধান মেলে। এ দিক হতে বৈষ্ণব পদাবলী আধুনিক গীতিকবিতার সমধর্মী।

বৈষ্ণব কবিতায় যে আকুলতা, অপ্রাপ্যকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, শুধুই পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলা- এর মধ্যেই তো আধুনিক গীতিকবিতার জীবন লক্ষণ বর্তমান। তাছাড়া রোমান্টিক গীতিকবিতার উপযোগী ভাষা এবং ছন্দ চয়নেও বৈষ্ণব কবিতা কত প্রচলিত তৎপর। ব্রজবুলির ভাষা তো একান্তভাবে গীতিকবিতারই ভাষা-বৈষ্ণব কবিতায় ব্যবহৃত ছন্দই তো এখন পর্যন্ত আধুনিক গীতিকবিতায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অধ্যাপক অমিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত,

“বৈষ্ণব কবিগণ রাধাকৃষ্ণের মিলন বিরহ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, আবেগ ও আর্তিকে যে শিল্প প্রকরণের সাহায্যে ব্যক্ত করিয়াছেন- তাহাকে রোমান্টিক আশ্রয়ী বলিতে হইবে। …………… বাক নির্মিত ছন্দকৌশল, শব্দ যোজনা ও আবেগের নিবিড়তা বিচার করলে বৈষ্ণব পদাবলীকে রোমান্টিক না বলিয়া পারা যায় না।”

পরিশেষে বলা যায় যে, বৈষ্ণব পদাবলী- রোমান্টিক গীতিকবিতা। তবে বৈষ্ণব পদাবলীকে শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতা না বলে সীমিত অর্থে গীতিকবিতা বলাই শ্রেয়। কেননা বৈষ্ণব পদাবলী প্রধানত রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে তার বিষয় বৈচিত্র্য স্বাভাবিক কারণেই নেই। তাছাড়া শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতার যে বিশিষ্ট লক্ষণ আবেগের সংযম, কল্পনার সূক্ষ্মতা ও সংস্কার মুক্তি- বৈষ্ণব কবিতায় অনেক সময় তা লক্ষিত হয়নি। গীতিকবিতায় রসের জগৎও বিচিত্র। বৈষ্ণব পদাবলীতে মাত্র ৫টি রসের উল্লেখ রয়েছে- শান্ত, হাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর।

এর মধ্যে আবার মধুর রসের প্রকাশ সর্বাপেক্ষা অধিক। নিছক তত্ত্বরূপে বিচার করলে বৈষ্ণব কবিতাকে রোমান্টিক আখ্যা দেওয়ার পক্ষেও কিছুটা বাধা রয়েছে। কেননা বৈষ্ণব কবিতা বৈষ্ণবতত্ত্বের রসভাষ্য, একটা বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের গোষ্ঠীবদ্ধ কাব্যকলা। গোষ্ঠী বহির্ভূত পাঠকের কাছে এর কোনো আবেদন নেই। আধুনিক গীতিকবিতায় ছন্দো বৈচিত্র্য ও বৈষ্ণব পদাবলীতে যে মানবরসের উৎসারণ তাতে ধর্মীয় চেতনার মিশ্রণ থাকাতে তা পদে পদে গন্ডিমুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় বিহ্বল হয়ে পড়েছে।

সুতরাং বৈষ্ণব পদাবলী শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতা না হলেও গীতিধর্মের পর্যায়ভুক্ত। অনেক সমালোচকই বৈষ্ণব পদাবলীকে গীতিকাব্যের লক্ষণাকান্ত বলে মন্তব্য করেছেন। কবিতা হিসেবে বৈষ্ণব কবিতা অর্ধসৃষ্টি, সুর সহযোগে এর পূর্ণত্ব প্রাপ্তি। বৈষ্ণব কবিরা ভক্ত ছিলেন, তাঁদের আচরিত ধর্মতত্ত্বও ছিল। কিন্তু তাদের রচিত কবিতায় তা মুখ্য হয়ে উঠেনি এবং একটি অনির্বচনীয় আস্বাদ ও ভাবাবেগ ছিল; যা বৈষ্ণব পদাবলীকে গীতিকবিতার সমকক্ষ করেছে।