রবীন্দ্রনাথের ‘বৈষ্ণব কবিতা’টি পৃথিবীকে ভালোবাসার ঐকান্তিক আগ্রহে মমতাশ্রয়ী হয়ে উঠেছে। মায়া মোহ ভরা, স্নেহ প্রেম ভরা এ পৃথিবীতে যাঁরা মানবদেহধারী প্রেমময়, মায়াময়, প্রাণের ঠাকুরকে দেখেছিলেন, পেয়েছিলেন, সেই অমর কবিদের স্মরণ করলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতায় প্রথমেই তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন তুলেছেন— রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার চিত্রাদি বৈষ্ণব কবিরা কোথা থেকে পেলেন। একেবারে কল্পলোক থেকে তো কোনো সাহিত্য সৃষ্টি হয় না বাস্তব পটভূমিকা রূপ-রসের সংমিশ্রণে সাহিত্য হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। পূর্বরাগ অনুরাগ, মান-অভিমান, অভিসার, বিরহ-মিলন কি শুধু দেবতাদের জন্যই নির্দিষ্ট হয়ে আছে ? মানুষের কি তাতে কোনো অধিকার নেই ? পৃথিবীর মানুষ কি দূরে বসেই ভক্ত ও ভগবানের একান্ত হয়ে ওঠা সংগীত শুনবে? এই সংগীতেই দেবতার প্রেমলীলায় মানুষ যদি নিজেও প্রেমিক হয়, যদি দেবতার প্রেমে নিজের প্রেমকে উপলব্ধি করে তবে কি বৈষ্ণুব কবিরা অসুখী হবেন ? রাধাকৃষ্ণের এই প্রেম-চিত্রাদি এবং উহার নানারূপ কি বৈষ্ণব কবিরা মানুষের মধ্যে দেখেননি? এই মানব সংসার থেকে কি তা আস্বাদিত হয়নি ? কবির মনে হয় মানবীয় মুখ থেকে, চোখ থেকে, প্রেমের স্বাভাবিক গতি যা আভাসিত হয়েছে তা থেকেই বৈষ্ণুব কবিরা নানাভাবে কল্পনা করে বৈষ্ণবীয় রূপে রাধাকে সাজিয়েছেন। প্রিয়র মধ্যেই আমরা অনন্তকে, দেবতাকে দেখি—তাই প্রিয়র কাছ থেকে যা পাই তা দিয়ে থাকি দেবতাকে। দেবতার জন্যই রচিত প্রেমগীতি থেকে মানুষও সংগ্রহ করে যেটুকু সে চায়—এতে দোষও কিছু নেই, রোষেরও কোনো কারণ নেই। এভাবেই কবি বৈষ্ণব কবিতার মূল্যায়ন করেছেন।
বৈষ্ণুবরা ভগবানকে লীলাময় বলে বিশ্বাস করেন। জীব ও জগৎ সৃষ্টিকারী এই লীলাময় ভগবানের অনন্য শক্তিকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন তাঁরা। যথা—স্বরূপ শক্তি, তটস্থা বা জীবশক্তি আর মায়াশক্তি। স্বরূপ শক্তির দ্বারাই ভগবানের অস্তিত্ব, তটস্থা শক্তির দ্বারাই কোটি কোটি জীবের সৃষ্টি—এই শক্তি জীবকে ভগবানের দিকেও টানে। ভগবানের যে শক্তির দ্বারা জগতের সৃষ্টি—সেটাই মায়াশক্তি।
রবীন্দ্রনাথ ‘বৈষ্ণুব কবিতায় মানবীয় প্রেমকে দৈহিক ও আধ্যাত্মিক সাধনার চাইতেও মূল্যবান ও আকাঙ্ক্ষিত বস্তু বলে ঘোষণা করেছেন। কারণ মানুষের এই প্রেমের মধ্যেই দেবত্ব বিরাজিত, ভগবৎ প্রেমের জন্য বৃন্দাবন লীলার প্রয়োজন নেই। এক অনন্ত প্রেম-উৎস থেকে এই প্রেমধারা বয়ে চলেছে। ঊর্ধ্বমুখী যে ধারা দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত, আর নিম্নমুখী যে ধারা মানুষের উদ্দেশ্যে প্রবাহিত এই উভয়ের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। এই মানবীয় প্রেমের পথেই ভগবৎ প্রেমের তীর্থে পৌঁছতে হয়। তাই রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র বলেছেন, ‘জীবের মধ্যে অনন্তকে অনুভব করার অন্য নাম ভালোবাসা। সমস্ত বৈষ্ণব ধর্মের এই গভীর তত্ত্বটি নিহিত রহিয়াছে। বৈষ্ণব ধর্ম পৃথিবীর সমস্ত প্রেম সম্পর্কের মধ্যে ঈশ্বরকে অনুভব করিবার চেষ্টা করিয়াছে।” এখানে জগৎ ও জীবনের মধ্যে কবি তাঁর, চির আকাঙ্ক্ষিত সৌন্দর্যবোধক এবং দৈহিক বিশ্বাসের প্রতিরূপ দেখতে পেলেন।
কিন্তু বৈষ্ণব মহাজনেরা হয়তো একথা মানতে রাজি নন। কারণ তত্ত্বটাই তাঁদের মতে লৌকিক প্রেম কোনো ক্রমেই আলৌকিকত্ব দাবি করতে পারে না। তাঁরা মনে করেন ঈশ্বরকে ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোনো ভালোবাসা থাকতে পারে না। কিন্তু সত্যিকার প্রেম সব সময়ই স্বর্গীয় কারণ প্রেম মানুষকে উন্নত করে অশুভ থেকে শুভের জগতে উত্তরণ করে। প্রেমের অনুশাসনই ইচ্ছে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ অনুশাসন। তাই প্রেম মানুষকে ঈশ্বরমুখী করে। সুতরাং বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে মানবিক অবদানকে অগ্রাহ্য করলে বৈষ্ণব পদাবলীর মূল্য শাস্ত্রকারদের কাছে যতই মূল্য বৃদ্ধি পাক তা মানুষের কাছে কমতে বাধ্য।
প্রশ্নের শেষাংশে কবিতার বক্তব্য এবং বৈষ্ণব বিশ্বাস সম্বন্ধে প্রমথনাথ বিশীর মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য : “বৈষ্ণব কবিতাতে মানব সমাজের প্রতি কবির প্রীতি চিত্তে উদ্বেল হইয়া উঠিয়াছে। যাঁহারা বৈষ্ণব পদাবলীকে মানব সংসার হইতে বঞ্চিত করিয়া কেবল ভগবান ও ভক্তের উপভোগ নিয়োগ করিতে চান কবি তাঁহাদের সহিত এক মত নহেন। ভক্ত ও ভগবান সংসার। অতিক্রম করিয়া যান নাই। এই গানগুলির এমনই মোহ যে ইহাতে ভক্ত, ভগবান ও মানবসমাজ একীভূত হইয়া যায়—একের প্রেম হইতে অনেকের প্রেমে যাইবার সিংহদ্বার ইহাতে বন্ধ নয়। সেইজন্য যাঁহারা এ প্রেমকে মানুষের প্রয়োজন হইতে নির্বাসিত করিয়া রাখিয়া চান তাঁহার কৃপার পাত্র।”
এই কবিতার মাধ্যমে কবি বুঝিয়ে দিলেন বৈষ্ণব সাহিত্যের ভাববসই গড়েছে আমাদের হৃদয়ের ভাষা।
Leave a comment