বৈষ্ণব সাধকদের কাছে বৈষ্ণব কবিতা বৈষ্ণবতত্ত্বের রসভাষ্য। তারা বৈষ্ণবপদাবলীকে শুধুমাত্র সাধারণ নরনারীর প্রেমকাহিনী বলে গ্রহণ করতে চান না। তাঁদের মতে ভগবান কৃষ্ণ জীবের প্রতীক রাধার সঙ্গে অপ্রাকৃতিক বৃন্দাবন ধামে লীলায় ব্রত। ভক্তবৈষ্ণব এই লীলা মানস ছবিতে প্রত্যক্ষ করে আনন্দরসে নিমগ্ন থাকেন। একদিকে ভগবান কৃষ্ণ অন্যদিকে চিরযৌবনসম্পন্না প্রকৃতি রাধার মধ্যে যে নিত্য প্রেমলীলা চলছে বৈষ্ণব কবিরা সেই লীলাকেই তাঁদের কাব্যে রূপায়িত করেছেন। শ্রীরাধা ভগবানেরাই হ্লাদিনী শক্তির অংশ। তত্ত্বতঃ রাধা ও কৃষ্ণ এক।
গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন গড়ে উঠেছে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর। চৈতন্যের দিব্য —জীবনকে কেন্দ্র করেই যেন রাধাকৃষ্ণের অপার্থিব প্রেমলীলা মূর্ত হয়ে উঠেছিল। চৈতন্যদেব যেন প্রেমের এক জীবন্ত মূর্তি। তার প্রচারিত প্রেমে কোনও কামগন্ধ ছিল না। এই চৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করেই বৈষ্ণব কবিরা সেই অপার্থিব রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার বর্ণনায় মেতে ওঠেন।
কিন্তু বৈষ্ণব সাধকের বৈষ্ণব কবিতায় যতই তত্ত্ব আরোপ করুক না কেন রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা আমাদের মানবিক প্রেমের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। মানবিক প্রেম শুদ্ধ প্রেম নয় ঠিকই—কারণ তাতে কামগন্ধঃ এসে যায় কিন্তু বৈষ্ণব কবিরা যেভাবে মিলন-বিরহ অভিসারের কথা বর্ণনা করেছেন তাতে—এই প্রেম লৌকিক ও বস্তু জগতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেইজন্য রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেছেন—
শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান
পূর্বরাগ, অনুরাগ, মান অভিমান
অভিসার প্রেমলীলা মিলন বিরহ
বৃন্দাবন গাথা—এই প্রণয় স্বপন
শ্রাবণের শর্বরীতে কালিনীর কূলে
চারি চক্ষে চেয়ে দেখা কদম্বের মূলে
শরমে সম্ভ্রমে-একি শুধু দেবতার।
বস্তুতঃ কান্নাহাসি বিজড়িত পার্থিব প্রেমের এমন উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে এই বৈষ্ণব কবিতায় যে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে নিশচয় কোনও বাস্তব জগতের প্রিয়াকে অবলম্বন করে বৈষ্ণব কবিরা এই প্রেমগীতি রচনা করেছেন—
হেরি কাহার নয়ান
রাধিকার অশ্রু আঁখি পড়েছিল মনে।
বিজন বসন্ত রাতে মিলন শয়নে
কে তোমারে বেঁধেছিল দুটি বাহুডোরে
আপনার হৃদয়ের অগাধ সাগরে
রেখেছিল মগ্ন করি। এত প্রেমকথা
রাধিকার চিত্তদীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতা
চুরি করি লইয়াছ কার মুখ কার আঁখি হতে।
রবীন্দ্রনাথ বলতে চান বৈষ্ণব কবিদের নিজ নিজ প্রেমলীলারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁদের কাব্যে। সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেমের নব নব বৈচিত্র্যের সন্ধানে বৈষ্ণব কবিরা এত মেতে উঠেছেন যে, বৈষ্ণব কাব্যকে বৈষ্ণবতত্ত্বের রসভাষ্য না বলে জীবনের রসভাষ্য বলেও অভিহিত করা যায়। ধর্ম ও দর্শনকে ছাড়িয়ে রোমান্টিক অনুভূতিই এখানে বড় হয়ে উঠেছে। রোমান্টিকতার যে কয়টি প্রধান লক্ষণ যথা সৌন্দর্যবোধ, রহস্যময়তা, দূরাভিসার তার সবগুলিই এখানে আছে। ব্যক্তি অনুভূতির সাহিত্যিক প্রকাশ যদি গীতিকবিতা হয় তাহলে বৈষ্ণব কবিতাকে শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতা বলতে বাধা নেই।
“নাম পরতাপে যার ঐছন করিল গো
অঙ্গের পরশে কিবা হয়।
যেখানে বসতি তার নয়নে দেখিয়া গো
যুবতী ধরম কৈছে রয়।”
পদটির মধ্যে যে রহস্যময়তা, যে অতীন্দ্রিয় ব্যাকুলতা এবং অনুভূতির যে নিবিড়তা রয়েছে—তা আধ্যাত্মিক তাৎপর্য অপেক্ষা রোমান্টিক প্রণয়গীতি হিসাবেই আমাদের মনে চিরন্তন প্রভাব বিস্তার করে।
কৃষ্ণের বিরহে রাধার অন্তঃদীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতা ফুটে উঠেছে নিম্নোক্ত পদটির মধ্যে—
“এ সখী হামারি দুখের ওর
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।”
বর্ষার পটভূমিকায় বেদনার রাগিনী আরও হৃদয়গ্রাহী হয়েছে। রোমান্টিক গীতি কবিতা হিসাবে নিম্নোক্ত পদগুলি শুধু বাংলা সাহিত্যে নয় বিশ্বসাহিত্যেও দুর্লভ—
১। “রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল
যৌবনে বনে মন হারাইয়া গেল।”
২। না জানি কতেক মধু শ্যাম নামে আছে গো
বদন ছাড়িতে নাহি পারে
জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো
কেমনে পাইব সই তারে।”
এগুলিতে অদ্ভরের আবেগ ও আকুলতা যেভাবে ফুটে উঠেছে তার তুলনা মেলে না। বৈষ্ণব কবিরা ভক্ত ছিলেন, তাদের কবিতায় বৈষ্ণবতত্ত্বের প্রকাশ ঘটেছে একথাও সত্য কিন্তু কবিতাগুলি পাঠ করলে তত্ত্বই মুখ্য হয়ে উঠেছে বলে মনে হয় না।
অবশ্য এ কথা মনে রাখতে হবে যে বৈষ্ণব কবিতা লৌকিক পথ বেয়ে অলৌকিক জগতে আমাদের পৌঁছে দেয়। রাধাকৃষ্ণের প্রেম মানবিক প্রেমের আধারে রচিত হলেও এ প্রেম স্বর্গীয়—
‘রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম
কামগন্ধ নাহি তায়।’
সুতরাং এ প্রেমের ভাব যার মনে একবার জাগরিত হয়েছে তার কাছে অন্য সবকিছুই মিথ্যা হয়ে যায়—
“সখি কি পুছসি অনুভব মোর
সেই পিরিতি তনু রাগ রাখানিতে
তিলে তিলে নূতন হোয়।”
যে প্রেম প্রতিক্ষণে নতুন হচ্ছে তার ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। তা অসীম ও অনস্ত। সেজন্য রাধা বলেছেন—
“কত মধু যামিনী রভসে গোয়াইলু—
না বুঝলু কৈছন কেল,
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু
তব হিয়া জুড়ন না গেল।”
এই অসীম অনন্ত প্রেমই বৈষ্ণব পদাবলীর বিষয়বস্তু। এর মধ্যে সুখ নেই, নেই কাম গন্ধ। আসলে বৈষ্ণব কবিতা লৌকিক ও অলৌকিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। সীমা ও অসীমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বৈষ্ণব কবিতা “আমাদের মনে অসীমের সন্ধান এনে দেয়। লৌকিক পরিচিত জগতের মাঝখানে দিয়ে যাত্রা শুরু করে শেষ পর্যন্ত আমাদের অপার রহস্যের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেয়।” সেইজন্য বলা হয়েছে বৈষ্ণব কবিতা সমুদ্রগামী নদীর ন্যায়—“নদী চলিয়াছে, দুই দিকে তটভূমি, তাহা আনন্দ কলরবে মুখরিত হইয়া নদী চলিয়াছে; দুই ধারে ফল ফুল সমন্বিত তরুলতা, জনকোলাহল, পল্লীর অপূর্ব সৌন্দর্য, ফুলের বাগান। কিন্তু যখন নদী মোহনায় আসিল, তখন সে সমস্ত দৃশ্য পশ্চাতে ফেলিয়া আসিয়াছে— আর সে বিহগ কুজন, জনকোলাহল মুখরিত উদ্যানসঙ্কুল বনভূমি এ সকল কিছু নাই— সম্মুখে দুর্ভেদ্য প্রহেলিকার মত অসীমের প্রতীক মহাসমুদ্র। বৈষ্ণব কবিতা নানারূপ পার্থিব সৌন্দর্যের পথ বাহিয়া চলিয়াছে—কিন্তু তাহার পরম লক্ষ্য সেই অজ্ঞেয় দুরধিগম্য মহাসত্য।”
বস্তুত, “কবিরা পৃথিবী আঁকিয়াছেন—স্বৰ্গও আঁকিয়াছেন—কিন্তু বৈষ্ণব কবিরা পৃথিবী ও স্বর্গকে এক করিয়া দেখাইয়াছেন…।”
সুতরাং বৈষ্ণব কবিতা তত্ত্বের রসভাষ্য হলেও এর মধ্যে যেহেতু মর্তলোকের প্রেমতৃষিত নরনারীর স্মিগ্ধ সুকুমার ছবি পাওয়া যায় সেহেতু বৈষ্ণব অবৈষ্ণব নির্বিশেষে সকল মানুষের পক্ষেই এর রসাস্বাদনে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। মানবিক আবেদনে ও রোমান্টিক প্রেমের সুর থাকায় বৈষ্ণব কবিতা পৃথিবীর যে কোন সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক গীতিকবিতার সমকক্ষতা দাবি করতে পারে।
Leave a comment