বিংশ শতকের আগে পর্যন্ত প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি ও জীবনধারার উৎস হিসেবে বৈদিক সভ্যতাকে মান্যতা দেওয়া হত। দীর্ঘকালের সযত্ন লালিত এই ধারণাটি বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এক নতুন মোড় নেয়। প্রত্নতাত্বিকরা ১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দে উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রাক্ বৈদিক হরপ্পা সভ্যতার সন্ধান পান। মহেঞ্জোদড়ো ও হরপ্পার দুটি প্রধান কেন্দ্র সহ বালুচিস্থান থেকে গুজরাট পর্যন্ত অঞ্চলে হরপ্পা সভ্যতার অসংখ্য কেন্দ্র আবিষ্কৃত হলে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার কেন্দ্র ও উত্তরাধিকার সম্পর্কিত ধারনার মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কার সত্ত্বেও পরবর্তীকালীন বৈদিক সভ্যতার অবদান ও গুরুত্ব শিথিল হয়নি। কারণ হরপ্পাতে উন্নত নগর সভ্যতার সন্ধান পেলেও, ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির জীবনধারায় তার প্রভাবের ধারাবাহিকতা নেই। কিন্তু বৈদিক সভ্যতার ধারা নানা পরিবর্তন সত্ত্বেও আজও ভারতীয় জীবনধারার সাথে সম্পর্কিত। কেউ কেউ হরপ্পা সভ্যতার সাথে বৈদিক সভ্যতার উত্তরাধিকার সম্পর্ক খুঁজতে চেষ্টা করেন। কিন্তু সময়গত প্রভেদ, বৈশিষ্ট্যগত বৈপরীত্য ইত্যাদি নানা কারণে তাঁদের প্রয়াস মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে।
আর্য সমস্যা:
পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বেদকে ভিত্তি করে বৈদিক সভ্যতা শব্দ বন্ধটি তৈরী হয়েছে। এই সভ্যতার কেন্দ্রে আছে ‘আর্য’ নামক জনগোষ্ঠী বা ভাষা গোষ্ঠীর একটি অংশ। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে মানুষরা বেদকে প্রথম তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, সংস্কৃতকে প্রথম কথ্যভাষা এবং ইন্দ্রের নেতৃত্বাধীন একটি বিশেষ দেবগোষ্ঠীকে তাদের পূজ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিল—তারা নিজেদের ‘আর্য’ নামে অভিহিত করে। স্বভাবতই বৈদিক সভ্যতা ‘আর্য সভ্যতা’ নামেও পরিচিত। কিন্তু ‘আর্য’ শব্দটি জাতিবাচক কিংবা ভাষাবাচক’ এই বিতর্ক ‘আর্য-সমস্যা’র সৃষ্টি করেছে। আর্য সমস্যার দ্বিতীয় উপাদান হল—আর্যরা আদি ভারতীয় নাকি তারা বহির্ভারত থেকে আগত কোন জনগোষ্ঠি। বস্তুত এই দুই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে পণ্ডিত মহলে দীর্ঘ বিতর্ক আছে এবং তারা পরস্পর বিরোধ দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। ‘আর্য’ বলতে আমরা সাধারণভাবে একটি জাতির নাম বুঝি। বৈদিক সভ্যতাকে অনেকেই আর্য জাতির অবদান বলে স্মরণ করেন। সুদূর অতীতে ইন্দো-ইউরোপীয় সমাজে কিছু জনগোষ্ঠী জাতিগত অর্থে নিজেদের আর্যত্ব সম্পর্কে সোচ্চার ছিল। পারস্য সম্রাট প্রথম দারায়ু এই ধারার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। নিজের সমাধি ফলকে (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৬ অব্দ) দাবি করা হয়েছে যে, তিনি ছিলেন একজন পারসিক, পারসিকের পুত্র, আর্য বংশোদ্ভূত একজন আর্য। জাতীয়তাবাদী আবেগবশত কেউ কেউ আর্যদের একান্তভাবেই একটি ভারতীয় জনগোষ্ঠী বলে প্রতিপন্ন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এঁরা পুরান ও ঋগ্বেদের কিছু বর্ণনা ও শব্দবন্ধ থেকে ‘আর্য’ শব্দটিকে জাতিগত অর্থে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। কিন্তু পুরানের বিবরণ বহু পরবর্তীকালের রচনা এবং এর কাহিনী দ্বারা বহির্ভারতের সাথে আর্যদের সম্পর্কের বিষয়টি প্রমাণ করা সহজ। তাছাড়া ঋগ্বেদের উল্লেখিত ‘আর্য’ ও ‘দাস’ বা ‘দস্যু’ শব্দগুলির মাধ্যমে এঁরা প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে স্বতন্ত্র জাতি হিসেবেই এই সংগ্রামশীল গোষ্ঠীগুলির উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে জাতিবাচক অর্থে শব্দগুলি প্রয়োগ করা হয়নি। এগুলি দ্বারা সংস্কৃতি বা জীবনধারাগত প্রভেদ বোঝানো হয়েছে। যারা ‘মহান’, ‘সুজাত’, ‘মুক্ত’ তাদের বলা হয়েছে আর্য। অন্যদিকে যারা বেদজ্ঞান হীন, সুসভ্য নয়, স্বাধীন নয় তাদের বলা হয়েছে দাস বা দস্যু। সংস্কৃত ভাষা ও বেদ বিশ্বাসীদের বোঝাতেই ‘আর্য’ শব্দটি প্রযুক্ত হয়েছে।
জে. সি. পিচার্ড (J. C. Pitchard) এমন এক আদিম মানব গোষ্ঠীর উল্লেখ করেছেন, যারা সংস্কৃত, জার্মান, গথিক ইত্যাদি ভাষাভাষী মানুষের পূর্বপুরুষ। তাঁর মতে, এই মানবগোষ্ঠীর সদস্যরা কালক্রমে স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পিচার্ড-এর এই মতের প্রতিধ্বনি শোনা যায় নি। সি. ল্যাসেন-এর বক্তব্যে। তিনি আর্যদের একটি উদ্যমী ও সৃজনশীল জাতি বলে দাবি করেন। এই ভাবে আর্য শব্দের জাতিবাচক সংজ্ঞা জোরালো হয়।
ঊনবিংশ শতক থেকে পশ্চিমী পণ্ডিতরা আর্য শব্দটিকে ভাষাগত অর্থে ব্যবহার করার বিষয়ে জোর দিয়েছেন। এঁরা ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পর্কযুক্ত কিছু ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা যেমন সংস্কৃত, গ্রীক, ল্যাটিন, জার্মান, শ্লাভ, রোমান ইত্যাদি ব্যবহারকারীদের বোঝাতে ‘আর্য’ শব্দটি প্রয়োগের পক্ষপাতি। অর্থাৎ যারা এই সকল ভাষায় কথা বলেন তারাই ‘আর্য’। কোন বিশেষ জাতি গোষ্ঠী এর অন্তর্ভুক্ত নয়। ঊনিশ শতকের বহু আগে ষোড়শ শতকের শেষদিকে ফ্লোরেন্সের জনৈক বণিক ফিলিপো সসেটি, দীর্ঘ সময় গোয়াতে অবস্থান করেছিলেন। ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বলেন যে, তাঁর কথ্য ভাষা ল্যাটিন-এর সাথে ভারতের সংস্কৃত ভাষার প্রবল মিল আছে। অর্থাৎ তিনিই প্রথম ইউরোপীয় ভাষার সাথে সংস্কৃত ভাষার যোগাযোগের বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন। দীর্ঘ নিরবতার পর ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে স্যার উইলিয়াম জোন্স এশিয়াটিক সোসাইটিতে এক ভাষণে সংস্কৃত, জার্মান, ল্যাটিন, গ্রীক, রোমান ইত্যাদি ভাষার উৎপত্তিগত সাদৃশ্যের আভাষ দেন। ব্যাকরণ ক্রিয়াপদের ব্যবহার ইত্যাদির ভিত্তিতে তিনি মনে করেন যে এই ভাষাগোষ্ঠীর একটি সাধারণ উৎস (common origin) থাকা সম্ভব।
সংস্কৃতে ‘পিতর’ ও ‘মাতর’, ল্যাটিনে ‘পেটার ও মেটার’, গ্রীকে ‘পেটির ও মিটির’, ইংরাজিতে ‘ফাদার ও মাদার’ এবং জার্মান ভাষায় ‘ভেটার’ ও ‘মুট্টার’—প্রায় সমোচ্চারিত এই ভাষার একই অর্থ—বাবা ও মা। এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীই এশিয়া ও ইউরোপের আর্য ভাষাভাষী মানুষের পূর্বপুরুষ।
উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে এই ভাষাগুচ্ছ ‘ইন্দো-ইউরোপীয়’ ভাষা নামে অভিহিত হতে থাকে। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার আর্য কথাটির বহুল প্রচার ঘটান। তিনি দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেন যে আর্য নিঃসন্দেহে একটি ভাষার নাম এবং ভাষা ভিন্ন অন্ন কিছু বোঝায় না। আর্য বলতে যদি আমরা একটি জাতি বুঝি, তা শুধু এই কারণে যে সেই জাতি আর্য ভাষায় কথা বলে’ (Aryan, is scientific language is utterly inapplicable to race. It means language and nothing but language; and if we speak of Aryan race at all, we should know that it means no more than x+ Aryan speech)
অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা (D. N. Jha) লিখেছেন যে, “ইন্দো-ইউরোপীয় নামে পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ভাষাগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ করা চলে না। সংস্কৃত, আবেস্তার ভাষা (প্রাচীন ইরানীয়), ল্যাটিন, গ্রীক, জার্মান (জার্মানী, ইংরেজ, সুইডিশ), স্লাভ (রুষা, পোলিশ) এবং রোমক (ইতালীয়, স্পেনীয়, ফরাসী ও রুমানীয়) ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। অধ্যাপক ঝা সংস্কৃত ও ইরানীয় ভাষার গভীর সম্পর্কের নিরিখে এদের উৎস হিসেবে ইন্দো-ইরানীয় ভাষার নাম উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীকালে এই ভাষাটির পরিমণ্ডল সম্প্রসারিত হয়ে এক সম্ভ্রান্ত সম্ভাষণে পর্যবসিত হয়েছে যেমন ‘সৎ বংশজাত ব্যক্তি’, ‘মহান’, ‘মুক্ত’ ইত্যাদি।
Leave a comment