ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠী তাদের ইউরোপীয় বাসভূমিতে দীর্ঘকাল অবস্থান করার পর খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে নতুন নতুন এলাকায় পরিযায়ী হয়েছিল। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে মধ্যবর্তীকালে তাদের একটি অংশ সিন্ধুনদের পূর্ব তীরে উপস্থিত হয়েছিল এবং বসতি স্থাপন করেছিল। ঠিক কি কারণে তাদের দেশান্তরী কর্মসূচী গৃহীত হয়েছিল, তা পরিষ্কার নয়। কারণ তাদের সম্ভাব্য আদি বাসস্থানগুলিতে কোন রূপ অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বা বিপর্যয়ের প্রমাণ পাওয়া যায় না। সম্ভবত জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং পশুচারণের উপযুক্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল অনুসন্ধানের সূত্রেই তারা দেশান্তরী হয়েছিল, আর্যদের এই অভিপ্রয়ান (migration) কোন নির্দিষ্ট সময়ে কিংবা একসাথে ঘটেনি। একাধিক দলে বিভিক্ত হয়ে তারা নতুন নতুন এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে তাদের একটি দল ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে উপস্থিত হয়। আগেই দেখেছি যে আর্যদের একটি দল মধ্য এশিয়ার তৃণাবৃত অঞ্চল হয়ে ইরানে পৌঁছায় এবং তাদেরই একটি অংশ বিভাজনের মধ্য দিয়ে সিন্ধুনদের পূর্ব তীরে পৌঁছেছিল।
অধ্যাপক ইরফান হাবিব ও বিজয় কুমার ঠাকুর তাঁদের The Vedic Age শীর্ষক পুস্তকে বলেছেন যে, ভাষা ও আচার-আচরণের নিরিখে অনুমিত হয় আর্যদের ‘অতীত পূর্বজরা’ সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০-১৪০০ সময়কালে ভারতের সীমান্তে উপস্থিত হয়েছিল। এখানে তারা প্রথম অবস্থান করতে থাকে। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এঁরা মনে করেন যে স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে আগত জনগোষ্ঠীর সংঘাতের সম্পর্ক তৈরী হয়নি। উৎখননের ফলে স্থানীয়দের সৃষ্ট মৃৎশিল্পের বহমান অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। হাবিব ও ঠাকুরের মতে, অশ্ব ও রথের শক্তিতে বলীয়ান আর্যগোষ্ঠী স্থানীয় মানুষদের ওপর প্রভূত্ব বিস্তারের বহু আগেই স্থানীয় ও বহিরাগত দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছিল।
আর্যদের বসতি বিস্তারের ক্রম বিবরণ স্থির করার কাজে ঋগ্বেদের উল্লেখিত ভৌগোলিক পরিবেশের এবং বিশেষ করে নদীসমূহের উল্লেখ একটি নির্ভরযোগ্য উপাদান। ঋগ্বেদে বহু নদ-নদীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে কিংবা হয়নি। এ প্রসঙ্গে লক্ষণীয় হল ঋগ্বেদে নদীর উদ্দেশ্যে রচিত নদী-সূত্র। দশম মণ্ডলে নদীগুলির নামোল্লেখ থেকে অনুমান করা যায় যে, এটি বেশ পরবর্তীকালের সংযোজন। তবে নদীগুলির বার বার উল্লেখ থেকে ধরে নেওয়া যায় যে, এই সকল নদীবাহিত অঞ্চলের সাথে আর্যদের সুপরিচয় ছিল। বৈদিক আর্যদের নদীস্তুতির কেন্দ্রে আছে সিন্ধু নদী। সেখানে সিন্ধুকে নদীশ্রেষ্ঠ (নদীতমা) বা মাতাশ্রেষ্ঠ (অম্বিতমা) বলে সম্মান জানানো হয়েছে। ড. হাবিব ও ড. ঠাকুরের মতে, নদীর নাম থেকে তাদের সনাক্তকরণের কাজ কিছুটা কঠিন। কারণ নদীগুলির ঋগ্বেদিক নাম মাঝে মাঝে পরিবর্তিত হয়েছে। অবশ্য ঐতিহাসিকেরা এদের সনাক্তকরণের কাজে সহমত হতে পেরেছেন।
সিন্ধুর পশ্চিম দিকের উপনদী হিসেবে হরি-রুদ (সরজু) এবং অর্থদার হেলমন্দ (সরস্বতী) নদীর নাম ঋগ্বেদে উল্লেখ থাকলেও ইক্ষু (Oxus) বা আমুদরিয়া নদীর নামোল্লেখ না-থাকা কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। তবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রবাহিত উপনদীগুলির নাম পাওয়া যায়। এদের অন্যতম হল রসা (পণ্ডুসির) কুভা (কাবুল নদী), শ্বেতা বা সুবাস্তু (সোয়াট) কুমু (কুররম) এবং গোমতি (গোমাল)। এদের জলধারা সিন্ধুনদীতে পড়ে সমুদ্রগামী হয়েছিল। অন্যদিকে সিন্ধুনদের পূর্ব দিকের সাতটি নদী ও তাদের উপনদীগুলির নাম ঋগ্বেদে স্মরণ করা হয়েছে। এই সপ্তসিন্ধু হল সিন্ধুনদ এবং বিতস্তা (ঝিলাম), অসিকনি (চেনাব), ইয়াভ্যাবতি (ইরাবতি বা রাভি), বিপাশা (বিয়াস) এবং শুতুদ্রী (শতুদ্বু) ও সরস্বতী (সরসূতি)। তবে এই সরস্বতী নদীর পরিচয় সম্পর্কে বিতর্ক আছে। কেউ কেউ সরস্বতী ও সিন্ধুকে অভিন্ন বলে মনে করেন। ঋগ্বেদের নদীস্তুতিতে সিন্ধুনদের মতই সরস্বতীকেও নদীশ্রেষ্ঠ করা হয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন যে এই সরস্বতী আবেস্তায় উল্লিখিত হরখবৈতি নয় এবং সিন্ধুও নয়। এটি শতদ্রুর পূর্বদিকে প্রবাহিত সিন্ধুর একটি উপনদী। ঋগ্বেদে এই নদীর জলধারাকে সমুদ্রগামীও বলা হয়েছে। গবেষক ডি. এস.কে পুরী, বি. সি. ভার্মা মধ্য হিমালয়ে সরস্বতীর প্রাচীন গতিধারা অনুসধান করেছেন। শিবালিকা অঞ্চলে তাঁর পাঁচটি নদীর সন্ধান পান, যার অন্যতম টন্স নদীকে তাঁরা প্রাচীন সরস্বতীর চিহ্ন বলে মনে করেন। আবার অধ্যাপক যশপাল, ডি. পি. আগরওয়াল উপগ্রহ চিত্রের সাহায্যে প্রাচীন সরস্বতীর উৎস ও গতি অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন। এঁদের মতে, সরস্বতী শিবালিক পার্বত্য অঞ্চলে উৎপন্ন এবং বৃষ্টির জলে পুষ্ট এবং সমুদ্রগামী নয়। ইরফান হাবিব তাঁর Imagining River Saraswati : A Defence of Common Sense শীর্ষক প্রবন্ধে (২০০৩ খ্রিঃ) বলেছেন যে, সরস্বতী নদীর মাহাত্ম্য বিষয়ক সমস্ত বক্তব্য ও দাবি আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র। তাঁর বিচারে সরস্বতী ঋগ্বেদের ঋষিদের কল্পনায় মূর্ত হয়েছিল। যাই হোক এই বিতর্কের অবসান এখনও হয়নি।
ঋগ্বেদের নদীস্তুতিতে মরুদ্বধা ও সুশোমা নামে আরো দুটি নদীর বন্দনা করা হয়েছে। মরুদ্বুধা সম্ভবত কাশ্মীর ও জন্ম এলাকার মধ্যে প্রবাহিত। অন্যদিকে সুশোমার অবস্থান পাকিস্তানের রাওলপিণ্ডিতে। সমগ্র ঋগ্বেদে গঙ্গা-যমুনার উল্লেখ মাত্র একস্থানে করা হয়েছে এবং সেটিও ঋগ্বেদের শেষ পর্বে দশম মন্ডলে। তাই অনুমান করা যায় যে গঙ্গা-যমুনা বিধৌত অঞ্চলের সাথে ঋগ্বেদের যুগে আর্যদের পরিচয় ঘটে নি। এই আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, ভারতে প্রবেশ ও বসতিস্থাপনের প্রথম পর্যায়ে (ঋগ্বেদের সময়কালে) আর্যদের পরিচিত এলাকা ছিল বর্তমান আফগানিস্তান, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সমগ্র কাশ্মীর অবিভক্ত পাঞ্জাব ও নিম্ন সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চল।
উত্তর-পশ্চিম ভারতে বসতি স্থাপনের কাজ আর্যদের পক্ষে সম্পূর্ণ মসৃণ ছিল না। গবাদি পশু অপহরণ, জল ও তৃণভূমির দখলকে কেন্দ্র করে আর্যরা স্থানীয় আদি আধিবাসীদের সাথে (অনার্য/ দস্যু) যেমন সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল, তেমনি আর্যদের আন্তঃগোষ্ঠী সংঘর্ষও চলত। এমন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল ‘দশ রাজার যুদ্ধ’। ‘ঋগ্বেদের শেষ পর্যায়ে অনুষ্ঠিত এই ‘দশরাজ্ঞ’ যুদ্ধে একদিকে ছিল ভরতগোষ্ঠীর নেতা দিবোদাসের পুত্র সুদাস এবং অন্যপক্ষে ছিলেন দশটি গোষ্ঠীর নেতাগণ। এই দশটি গোষ্ঠী বা কৌম হল যদু, তুর্কশ, অণু, পুরু, দ্রুহ্য, ভলান, পখত, শিব ও বিশানিন। এদের মধ্যে কয়েকটি অনার্য গোষ্ঠীও ছিল। এদের বলা হয়েছে অনার্য তবে পবিত্র (সিবাসস)। ভরত গোষ্ঠীর নেতাদের নামের সাথে ‘দাস’ শব্দটি যুক্ত থাকার প্রেক্ষিতে কোশাম্বী অনুমান করেছেন যে, হয়ত অনার্য গোষ্ঠীকেও আর্য সমাজভুক্ত করে নেওয়া হয়েছিল। দশরাজার যুদ্ধের আশু কারণ ছিল জল সম্পদের অধিকার। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে (৭.১৮.৮) যে, সুদাস যে মুর্খদের নিধন করেন তারা পরুশ্মি (রাভি’র শাখা) নদীর গতিপথ ঘোরাতে চেয়েছিল। তাৎক্ষণিক কারণ ছিল রাজা সুদাস কর্তৃক বিশ্বমিত্রের পদচ্যুতি। পশ্চিম পাঞ্জাবে কর্তৃত্ব বিস্তারের কাজে ভরত গোষ্ঠীর প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন পুরোহিত বিশ্বামিত্র। কিন্তু সুদাস বিশ্বামিত্রকে সরিয়ে অধিক শাস্ত্রজ্ঞ বশিষ্ঠকে প্রধান পুরোহিত পদে নিয়োগ করতে চাইলে বিশ্বামিত্র ক্ষুব্ধ হন। তিনি দশটি উপজাতিকে সংঘবদ্ধ করে সুদাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে প্ররোচিত করেন। যুদ্ধে বিজয়ীহন সুদাস। এই ভরত গোষ্ঠী থেকে ‘ভারত’ নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। ঋগ্বেদে দিবোদাস ও সুদাসের বীরত্ব ও মহানুভবতার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। বৈদিক সুক্তে বলা হয়েছে যে, উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম দিকের শত্রুদের বিনাশ করে সুদাস ভরত গোষ্ঠীর মর্যাদা ও কৃর্তৃত্ব বর্ধিত করেছেন।
গোষ্ঠীগত কর্তৃত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে আর্যরা নিজেদের মধ্যে ঘন ঘন যুদ্ধে লিপ্ত হত। এর ফল শুভ হয় নি। কোশাম্বির মতে, যুদ্ধ দ্বারাই তারা নিজেদের অস্তিত্বকে ক্রমশ বিপন্নতার দিকে নিয়ে গিয়ে ছিল। শেষ পর্যন্ত এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পাবার লক্ষ্যে আর্যরা পূর্বমুখী অভিযানে লিপ্ত হয়ে ছিল। শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া এবং বিস্তীর্ণ চারণক্ষেত্র দখলের পক্ষে ভরত গোষ্ঠীর নেতৃত্বে পূর্বমুখী সম্প্রসারণের সূচনা হয়।
পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যেই আর্যদের বাসস্থানের দিগন্ত প্রসারিত হয়েছিল। ঋগ্বেদের ভৌগোলিক পরিবেশের সাথে পরবর্তী তিনটি বেদ-সামবেদ, যযুর্বেদ ও অথর্ববেদ এবং সংহিতা, ব্রাক্ষ্মণ ইত্যাদির বর্ণনার তুলনামূলক আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, পরবর্তী বৈদিক যুগে (খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০-৬০০ অব্দ) আর্যদের বাসভূমি ক্রমশ দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সম্প্রসারিত হয়েছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আর্য-অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে স্থানকে মধ্যদেশ (মধ্যম প্রতিষ্ঠা দিশ) বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই অভিপ্রয়াণের প্রাক্কালে ভরত ও পুরু জনগোষ্ঠী মিলিত হয়ে কুরু জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছিল। পরে এরা পাঞ্চাল কৌমের সাথে মিশে যায়। এদের পাশে পাশে এসেছিল ভাস ও উশীনব গোষ্ঠী। তৈত্তেরীয় আরণ্যকের বর্ণনা অনুযায়ী এদের বসবাসের এলাকাটি হল দোয়াব অঞ্চল থেকে আরো ওপরের দিকে কুরুক্ষেত্র অঞ্চল। কুরু গোষ্ঠী অধ্যুষিত হওয়ায় এমন নামকরণ। পাঞ্চাল কৌমের সাথে মিলিত হওয়ার পর এরা দিল্লী ও গঙ্গা-যমুনার বিভাজিকার মধ্যভাগ দখল করে। তৈত্তেরীয় ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে যে, গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে যারা বসবাস করে তারা বিশেষ সম্মানের অধিকারী। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে মধ্যদেশকে সরস্বতী (সরসূতি) এবং দৃষদ্বতী (সম্ভবত ছৌতং) নদী বিধৌত এলাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সময় সরজু নদীর সাথে আর্যদের পরিচয় ঘটেছিল। ইরফান হাবিব শতপথ ব্রাহ্মণের উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, সদানীরা নদী (ঘর্ঘরা) কুরু ও পাঞ্চাল এলাকাকে কোশ ও বিদেহদের এলাকা থেকে পৃথক করে রেখেছিল। অর্থাৎ এই দুটি আর্যগোষ্ঠী উত্তরপ্রদেশের উত্তর পূর্বে এবং উত্তর বিহারে বসতি গড়েছিল কৈশিকতি উপনিষদে বর্ণিত কাশী (বারাণসী) ও বিদেহদের মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক এই অনুমানকে সমর্থন করে।
পূর্বমুখী সম্প্রসারণের কালে আর্যরা তাদের পুরানো বাসস্থান পাঞ্জাবের সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলে। এই অভিপ্রয়াণের সময় তারা তামা ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর সাথে পরিচিত হয়েছিল। এরা গেরুয়া রঙের এক ধরনের মৃৎপাত্র ব্যবহার করত। পরবর্তী পর্যায়ে লাল-কালো মৃৎপাত্রের নির্মাণকারীদের সাথেও আর্যদের পরিচয় ঘটে। নতুন এলাকা সম্পর্কে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে প্রশংসা ধ্বনিত হয়েছে, পক্ষান্তরে উত্তর-পশ্চিমে তাদের পুরানো বাসস্থান সম্পর্কে অনাস্থা প্রকাশ পেয়েছে। একাধিক ব্রাহ্মণসূত্রে কুরুক্ষেত্রকে পুণ্যভূমি বলা হলেও, পাঞ্জাবকে অপবিত্র ভূমি বলে নিন্দা করা হয়েছে।
আর্যদের পূর্বমুখী সম্প্রসারণ গঙ্গানদীর পূর্বমুখী ধারা বরাবর উত্তর ও দক্ষিণ উভয় তীর ধরেই ঘটেছিল বলে মনে করা হয়। গঙ্গার উত্তর ধরে হিমালয়ের পাদদেশ বরাবর যেমন সম্প্রসারণ ঘটেছিল, তেমন নদীর দক্ষিণ তীর ধরেও তারা মধ্য-পূর্ব ভারতের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। শতপথ ব্রাহ্মণের শ্লোকে বিদেঘ মাথব-এর অগ্নিদেবকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাওয়ার কাহিনীটি এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। জনৈক ব্রাহ্মণ নৃপতি মাথব পবিত্র অগ্নিকে অনুসরণ করে সরস্বতীর তীর থেকে (অর্থাৎ হরিয়ানার কোন এক স্থান) পূর্ব দিকে এগোতে এগোতে সদানীরা (বর্তমান গণ্ডক) নদীর তীরে উপস্থিত হন। চলার পথে অগ্নির স্পর্শে সকল বন-জঙ্গল থেকে ভূমি মুক্ত হয়েছিল। ব্রাহ্মণ বিদেষ মাথবের নামানুসারে স্থানটির নাম হয় বিদেহ। এটি বর্তমানে বিহারের মিথিলা ও সন্নিহিত অঞ্চল বলে চিহ্নিত হয়। প্রশ্ন হল মাথব বিদেহ’র আরো পূর্ব দিকে এগোলেন না কেন। এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে অগ্নি বৈশ্বানর বিদেহর আরও পূর্ব দিকের এলাকা স্পর্য করেন নি। অর্থাৎ ঐ এলাকা উপনিবেশ স্থাপনের উপযোগী তখনই ছিল না। তাই বলা যায় যে, পরবর্তী বৈদিক সংস্কৃতির পূর্বতম সীমানা ছিল মিথিলা (বিদেহ)। ড. রোমিলা থাপার, ডি. এন. ঝা প্রমুখ বিদেঘ মাথবের এই কাহিনীকে নিছক উপনিবেশ সম্প্রসারণের দৃষ্টান্ত না বলে, পরবর্তী বৈদিক যুগের আর্থ-সামাজিক রূপান্তরের সাক্ষ্য বলে মনে করেন। এই কাহিনীকে আগুন জ্বেলে জমিকে বন-জঙ্গল মুক্ত করার প্রয়াস বলা যায়। আগুন দিয়ে বন ধ্বংস করার সাথে সাথে লৌহ কুঠার দ্বারা জঙ্গল-মুক্ত ভূমি উদ্ধারের প্রক্রিয়াটিও এই সময় ঘটেছিল। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে এই ধাতুটিকে বলা হয়েছে শ্যাম আয়স বা কালো বর্ণের ধাতু। লোহা ব্যবহারের সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের আগে স্থির করা যায় না। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ অব্দে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ ও অত্রঞ্ঝিখেরাতে উৎখননের ফলে এই ধাতুটি পাওয়া গেছে। যাই হোক, লোহার ব্যবহার খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতক ও পরবর্তীকালে আর্যদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। আর্যদের স্থায়ী কৃষিজীবী সামজে রূপান্তর এবং শক্তিশালী রাজতন্ত্রের উদ্ঘাটনের পশ্চাৎপটে লৌহ সরঞ্জামের ব্যবহারটি ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতে আর্যদের উপনিবেশ বিস্তার প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক হোয়েনল, গ্রীয়ারসন প্রমুখ দু’দফায় ইন্দো-ইরানীয়দের অভিপ্রয়াণের কথা বলেছেন। এঁদের মতে, আর্যদের প্রথম দলটি ‘সপ্ত-সিন্ধব’ এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিল। পরবর্তী পর্যায়ে দ্বিতীয় দলটি গিলঘিট ও চিত্রলের মধ্য দিয়ে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলে (মধ্যদেশ) প্রবেশ করেছিল। এঁদের মতে, প্রথম অভিপ্রয়াণের সময় ইন্দো-ইরানীয়দের মধ্যে ধর্মীয় আচারসর্বস্বতা, জাতিভেদ প্রথা কঠোরভাবে মান্যতা পেত। তাই এদের ঋগ্বৈদিক সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক বলা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে আর্যরা অনেকটাই পরিণত ও বাস্তববাদী সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়েছিল। তাই এদের ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রতিনিধি বলা যায়। উপনিষদ ও কর্মফলতত্ত্ব ঋগ্বৈদিক ও পরবর্তী বৈদিক সংস্কৃতির প্রভেদ স্পষ্ট করে দেয়। তবে এই মতটি সর্বজন গ্রাহ্য হয়নি। অনেকে মনে করেন ইন্দো-ইরানীয়দের প্রথম অভিপ্রয়াণটি ছিল নতুন বাসভূমি দখলের যুদ্ধমুখী প্রয়াস এবং দ্বিতীয় প্রয়াসটি ছিল উপনিবেশ সম্প্রসারণ কর্মসূচী মাত্র।
শেষ পর্যায়ে দক্ষিণভারতেও আর্য-সংস্কৃতির প্রসার ঘটে। তবে উত্তর ভারতের মত ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে নয়, আর্য ঋষিদের প্রভাব এই কাজে অনুঘটকের কাজ করেছিল। পুরাণ কাহিনী অনুসারে দক্ষিণে আর্য প্রভাব সম্প্রসারণে মূখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন অগস্ত মুনি। তিনি তামিলভাষীদের প্রতিনিধি বলেই দক্ষিণীদের দাবি ছিল। আর্যগোষ্ঠী যদুদের মাধ্যমে মহারাষ্ট্র ও বেরার সংস্কৃতিভুক্ত হয়েছিল। অন্ধ্রের তেলেগুভাষী জনগণ সরাসরি আর্য সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হন নি।
Leave a comment