‘আর্য’ শব্দটি ভাষাবাচক এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও সমস্যার সম্পূর্ণ নিরসন ঘটে নি। এখন প্রশ্ন হল, আর্য যদি একটি ভাষা হয়, তাহলে এই ভাষাভাষী মানুষদের আদি বাসভূমি কোথায় ছিল। এক্ষেত্রেও দুটি প্রধান ভিন্নমত এবং একাধিক উপমত প্রকাশ্যে এসেছে। প্রাথমিক ভাবে প্রধান দুটি অভিমতের সমর্থকদের একটি গোষ্ঠী মনে করেন যে, আর্যরা ভারতেরই আদি অধিবাসী। হতে পারে যে ভারত থেকে এদের কোন কোন গোষ্ঠী বর্হির্ভারতে যাত্রা করেছিলেন। অন্যপক্ষ মনে করেন ইউরোপ আর্যদের আদি নিবাস ছিল। এখনো আর্য ভাষাভাষী অধিকাংশ মানুষ ইউরোপে বসবাস করেন। একটি ক্ষুদ্র অংশ ভারতে এসেছেন। আবার ভারতবর্ষ বা ইউরোপে আর্য ভাষীদের অবস্থান নির্দিষ্টকরণ প্রসঙ্গেও একাধিক উপমত উঠে এসেছে। পশ্চিমী পণ্ডিতদের অধিকাংশই আর্যদের বহিরাগত বলে মত প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে ভারতীয় পণ্ডিতদের একাংশ আর্যদের আদি ভারতীয় বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। এমনকি কোন কোন ধর্মীয় সংস্কারক ও রাজনীতিকও ভারতকে আর্যদের আদি বাসস্থান এবং পৃথিবীতে আর্য সভ্যতার প্রাধান্যকে ভারতীয় সংস্কৃতির বিশ্বায়ন বলে প্রচার করেন।

আর্যদের ভারতীয়তত্ত্বের প্রবক্তারা মূলত পুরাণের সাক্ষ্য ব্যাখ্যা করে নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। এই মতের একজন বড় প্রবক্তা এস. ই. পারজিটার। তাঁর মতে, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আর্যদের ভারত আক্রমণ কিংবা পশ্চিম থেকে পূর্ব মুখে আর্যদের সম্প্রসারণের কোন উল্লেখ ভারতীয় সাহিত্যে নেই। বরং পুরাণের বক্তব্য থেকে উত্তর-পশ্চিম দিক্ দিয়ে আর্যদের বহির্গমনের আভাস পাওয়া যায়। এমনকি ঋগ্বেদে নদী সমূহের বন্দনা থেকেও আর্যদের উত্তর-পশ্চিম মুখে অগ্রসরের প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখানে প্রথমে গঙ্গামাতা, পরে যমুনা এবং পরিশেষে সরস্বতী নদের নামোল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ নদী বন্দনা পূর্ব ভারত থেকে শুরু হয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে এসে সমাপ্ত হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের আগে খোদিত মেসোপটেমিয় লিপিগুলিতেও আর্য দেবতা ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র প্রমুখের নাম পাওয়া যায়, যা আর্যদের বহির্গমনের সাক্ষ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতীয় পণ্ডিতদের মধ্যে অবিনাশচন্দ্র দাশ, গঙ্গানাথ ঝা, এল. ডি. কাল্লা, ডি. এস. ত্রিবেদী প্রমুখ আর্যদের ভারতীয়তত্ত্বের পক্ষে জোর সওয়াল করেছেন। ড. দাশ তাঁর Rigvedic India গ্রন্থে বলেছেন যে, আর্যদের জীবনধারা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রামাণ্য গ্রন্থ হল ঋগ্বেদ। কিন্তু আর্যরা ভারতের বাইরে থেকে এদেশে প্রবেশ করেছিল, এমন কোন তথ্য ঋগ্বেদে নেই। পক্ষান্তরে ঋগ্বেদে আর্যদের বাসভূমি হিসেবে ‘সপ্ত সিন্ধু’ অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে। ভারতের পাঞ্জাব, কাশ্মীর সপ্তসিন্ধু অঞ্চলের অন্তর্গত বলেই স্বীকৃত। আবার পুরাণ গ্রন্থে ‘দেব-অসুর’ যুদ্ধের উল্লেখ আছে। পারসিক ধর্মগ্রন্থ ‘জেদ্দাবেস্তা’তেও অনুরূপ যুদ্ধের উল্লেখ পাওয়া যায়। ভারতবাসীরা মনে করেন এখানে আর্যদের সাথে পারসিকদের যুদ্ধের কথাই বলা হয়েছে। এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইরানীয়রা ভারত ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। মহামহোপাধ্যায় গঙ্গানাথ ঝা’র মতে গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গমস্থল ‘ব্রষ্মর্ষিদেশ’ আর্যদের আদি বাসস্থান ছিল। ডি. কান্না কাশ্মীর ও হিমালয়ের পাদদেশ অঞ্চলকে আর্যদের আদি বাসস্থান বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু ডি. এস. ত্রিবেদীর মতে, সুলতান অঞ্চলেই আর্যদের বসবাস ছিল।

আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য এঁরা একাধিক যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। যেমন, সাহিত-সূত্র থেকে প্রমাণ করা যায়না যে আর্যরা বিদেশী এবং বাসভূমি ত্যাগ করে ভারতে এসেছিল। দেশত্যাগী একটি জাতি সাধারণভাবে তাদের অতীত বাসস্থান, ভৌগোলিক পরিবেশ, আবহাওয়া ইত্যাদি স্মরণ করে। কিন্তু আর্যরা ‘সপ্ত-সিন্ধু’ অঞ্চল ছাড়া (পাঞ্জাবের ‘পঞ্চনদ’ শতদ্রু, বিপাশা, রাভি, চেনাব ও ঝিলাম এবং সিন্ধুনদ ও সরস্বতী) অন্য কোন স্থানের উল্লেখ ঋগ্বেদে করেনি। তাই ধরে নেওয়া যায় যে, এই অঞ্চলেই তাদের প্রাথমিক আবাস ছিল। দ্বিতীয়ত, ভাষার ভিত্তিতেও আর্যদের বহিরাগত তত্ত্ব প্রমাণ করা যায় না। কারণ সংস্কৃত যদি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা হত, তাহলে গ্রীক্‌, জার্মান ইত্যাদি অন্যান্য ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের অনুপ্রবেশ ঘটত। কিন্তু তা হয়নি। অথচ ভারতের বিভিন্ন ভাষায় সংস্কৃত শব্দের ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যায়। আর্যরা বহিরাগত হলে এমন বিপরীত প্রভাব কেন ঘটলো? তৃতীয়ত, আর্যরা ইউরোপ বা অন্যত্র থেকে ভারতে এলে তাদের আদি বাসভূমিতে ঋগ্বেদের অনুরূপ গ্রন্থের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত। কিন্তু তা পাওয়া যায় নি। কেবল ভারতেই এমন উচ্চমানের কাব্যিক গ্রন্থের সৃষ্টি ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে ভারত থেকে আর্যদের বহির্গমনের বিষয়টিও এঁরা ব্যাখ্যা করেছেন। আসলে ভারত থেকে আর্যগোষ্ঠীর নিম্নস্তরের কিছু মানুষ বাইরে গিয়েছিলেন। কিন্তু এঁদের পক্ষে ঋগ্বেদের মত উন্নতমানের সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব ছিল না। চতুর্থত, বিরোধীপক্ষের পণ্ডিতরা লিথুয়ানিয়া ভাষার প্রাচীনত্বকে আর্যদের বহির্ভারতীয় জনগোষ্ঠী হিসেবে প্রমাণের যে চেষ্টা করেন, এঁরা তাও খণ্ডন করেছেন। এঁদের মতে, একটি প্রাচীন ভাষার আদি বৈশিষ্ট্য রক্ষিত হয় নানা কারণে। যেমন সেই ভাষা ব্যবহারকারী লোকেদের সামাজিক অবস্থান, বিচ্ছিন্নভাবে ঐতিহ্য আঁকড়ে থাকার প্রবণতা ইত্যাদি। লিথুয়ানীয় ভাষার প্রাচীনত্ব বজায় থাকার পশ্চাৎপটে এই কারণগুলি দায়ী ছিল।

অন্যদিকে আর্যরা আদিতে ইউরোপের অধিবাসী এবং পরবর্তীকালে পরিযানের (migration) মধ্য দিয়ে তারা ভারতে প্রবেশ করেছেন, এই মতের স্বপক্ষে ঐতিহাসিকদের সংখ্যা কম নয়। এঁরাও নানা যুক্তি তথ্য দিয়ে প্রতিপক্ষের মত খণ্ডন করেছেন এবং নিজেদের অভিমত প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছেন। জন মার্শাল, ব্রান্ডেনস্টাইন, পি. সাইলস, ডি. ডি. কৌশাম্বি. এ. এল. ব‍্যাশাম, জ্যোতিবা ফুলে, ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ আর্যদের বর্হিভারতীয় বলে মত প্রকাশ করেছেন।

আর্যদের বহির্ভারতীয় তত্ত্বের প্রবক্তাদের যুক্তিগুলিও অকাট্য এবং তুলনামূলকভাবে অধিক যুক্তিগ্রাহ্য। যেমন, এঁরা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর দেশগত অবস্থানের পরিসংখ্যান থেকে দেখান যে, সাতটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার মধ্যে মাত্র দুটি, সংস্কৃত ও পারসিক, ইউরোপের বাইরে অর্থাৎ ভারত ও ইরানে প্রচলিত আছে। ভারতবর্ষ আর্যদের আদি বাসস্থান হলে ভারত ও নিকটস্থ দেশগুলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আর্য ভাষার প্রচলন থাকত, এটা আশা করা অযৌক্তিক নয়। দ্বিতীয়ত, ভারত আর্যদের আদি বাসভূমি হলে ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় আর্য সংস্কৃতির প্রভাব পড়া ছিল স্বাভাবিক। বহির্দেশে পরিযানের আগে আর্যরা নিশ্চয় ভারতের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ত এবং আর্য সংস্কৃতি প্রচার করত। কিন্তু বাস্তব চিত্র অন্য। ভারতের একটি বৃহত্তর অংশ এবং প্রায় গোটা দক্ষিণ ভারত দীর্ঘকাল আর্য-সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। এমন কি উত্তর-পশ্চিম ভারতেও ব্রাহুই উপজাতির অস্তিত্ব এবং অনার্য দ্রাবিড় ভাষার প্রচলন ছিল। তৃতীয়ত, সংস্কৃত ভাষায় ‘ন, ‘ং’ ইত্যাদি ধ্বনির বিশেষ প্রয়োগ দেখা যায়। কিন্তু অবশিষ্ট ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় এমন ধ্বনির ব্যবহার খুবই কম। এর কারণ সম্ভবত বহিরাগত আর্যভাষার ওপর ভারতীয় দ্রাবিড় ভাষার প্রভাব সংস্কৃত ভাষাকে একটা স্বতন্ত্র্য্য বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। চতুর্থত, সমাজতাত্ত্বিকরা আর্যদের সাথে পারস্য, গ্রীস প্রভৃতি দেশের ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির সাযুজ্য থেকে ইউরোপীয় তত্ত্বের ব্যাখ্যা করেছেন। আর্যদের যাগযজ্ঞ এবং অগ্নিতে আহুতি প্রদান, অগ্নিবেদীকে প্রদক্ষিণ করা, নববিবাহিত দম্পতিকে ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ ইত্যাদির অনুরূপ রীতি পারস্য ও গ্রীসে প্রচলিত আছে। একই এলাকার আদি-অধিবাসী হওয়ার কারণে এমন সাযুজ্য থাকা সম্ভব। পঞ্চমত, প্রাক্‌-বৈদিক সভ্যতা হিসেবে হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কার হলেও, হরপ্পা লিপির পাঠোদ্ধার করা এখনো সম্ভব হয়নি। তবে এ বিষয় স্পষ্ট যে সংস্কৃত ভাষার সাথে তার কোন মিল নেই। আর্যরা আদি ভারতবাসী হলে লিপি ও ভাষার মধ্যে কিছু মিল নিশ্চয় পাওয়া যেত। আর্যরা বহিরাগত, তাই প্রাক্‌বৈদিক সভ্যতার সাথে তার মিল খুঁজে পাওয়া যায় নি।

বন্যপশুর সাথে পরিচয় এবং খাদ্যাভাসের নিরিখে ইউরোপীয় আর্যতত্ত্বের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে একটি সুন্দর বিতর্ক আছে। ইউরোপবাদীদের মতে, ঋগ্বেদে বন্য পশু বাঘের উল্লেখ নেই। আবার হাতিকে বলা হয়েছে মৃগহস্তিন। আর্যরা আদি ভারতীয় হলে অবশ্যই বাঘের উল্লেখ থাকত এবং হাতি সম্পর্কে এমন অজ্ঞ অভিব্যক্তি ঘটত না। অবশ্য ভারতবাদী পণ্ডিতেরা এই বক্তব্যের প্রত্যুত্তরে বলেছেন যে, ঋগ্বেদে কোন একটি বস্তু বা প্রাণীর অনুল্লেখ থেকে সে-বিষয়ে তাদের অজ্ঞতা প্রমাণিত হয় না। যেমন, ঋগ্বেদে লবণের উল্লেখ নেই। কিন্তু এ থেকে এমন সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে, আর্যরা লবণ হীন খাদ্য গ্রহণ করত। অন্যদিকে হাতিকে ‘মৃগহস্তিন’ নামে উল্লেখ প্রসঙ্গে এঁদের যুক্তি হল সম্ভবত ঋগ্বেদে কাব্যিক অর্থে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

আর্যরা ইউরোপের আদি অধিবাসী, একথা আপাতত ইতিহাস গ্রাহ্য। কিন্তু আর্যদের বাসভূমি হিসেবে ঐতিহাসিকেরা ইউরোপের কোন একটি বিশেষ অঞ্চল স্থির করতে পারেন নি। ঋগ্বেদের বিবরণ, শব্দার্থ বিদ্যা বিশ্লেষণ, আর্য সংস্কৃতির অবস্থান ক্ষেত্র ইত্যাদি ব্যাখ্যা করে তাঁরা আর্যদের আদি বাসভূমি অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন। কোন কোন জার্মান পণ্ডিত জার্মানিতে প্রাপ্ত প্রাচীন যুগের মৃৎপাত্র বিশ্লেষণ করে ঐ অঞ্চলকে আর্যদের আদি বাসস্থান বলে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। কিন্তু নানা কারণে এই মত গ্রহণযোগ্য হয় নি। কোশান্তির মতে, আর্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মৃৎশিল্প, হাতিয়ার বা অস্ত্র বলতে নির্দিষ্ট কিছু নেই। তারা যখন যাদের সংস্পর্শে এসেছে তাদের কাছ থেকেই প্রয়োজনীয় উপাদান রপ্ত করতে চেষ্টা করেছে। তাছাড়া সম্ভাব্য আর্য বাসভূমি হিসেবে চিহ্নিত ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলির তুলনায় জার্মানির নিদর্শনগুলি অনেক কম প্রাচীন। কার্ল পেনকা স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দক্ষিণ ভাগে আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল বলে দাবি করেন। তাঁর যুক্তি হল যে, কোন বহিরাগত মানবগোষ্ঠী স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে বসবাসের জন্য আসেনি। তাছাড়া এখানকার অধিবাসীরা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাতেই কথা বলে। পরবর্তীকালে পেনকার সমর্থকরা প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষের দৃষ্টান্ত এনে দক্ষিণ-স্ক্যান্ডিনেভিয়া তত্ত্বকে সমর্থনের চেষ্টা করেন। তাঁরা ঐ অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের কিছু প্রত্নবস্তু ও পাথরের তৈজস আবিষ্কার করে দেখান যে সেগুলির সাথে আর্যদের ব্যবহৃত প্রত্নবস্তুর মিল আছে। কিন্তু প্রত্নবস্তুভিত্তিক এই মতটিও মান্যতা পায়নি। কারণ নিউজিল্যান্ডের ‘মাওরি’ (Maori) সংস্কৃতিতে যে সকল সমদর্শী বস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলি অনেক বেশী প্রাচীন।

অধ্যাপক পি. গাইল্স-এর মতে, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলিতে প্রকৃতি ও জীবজন্তুর যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা কেবল শীত প্রধান ও বিস্তীর্ণ স্তেপি অঞ্চলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আবার তাদের ভাষায় ‘সমুদ্র’ সংক্রান্ত কোন শব্দ পাওয়া যায় না। অর্থাৎ সমুদ্র তীরবর্তী কোন অঞ্চলের সাথে আদি ইন্দো-ইউরোপীয়দের পরিচিতি ছিল। ইন্দো-ইউরোপীয়রা উদ্ভিদের মধ্যে ওক্, উইলো, বার্চ ইত্যাদি এবং পশুর মধ্যে গাভী, শূকর, ঘোড়া, কুকুর ইত্যাদির কথা বার বার উল্লেখ করেছে। তাই ধরে নেওয়া যায় যে, এই সকল উদ্ভিদ ও প্রাণীর ঘন সন্নিবেশভুক্ত এলাকাতেই আর্যদের আদি বাসস্থান। গাইলস-এর মতে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরী ও বোহেমিয়া উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আর্যদের পরিচিত ও আর্থিক জীবন ধারার সাথে যুক্ত গাভী, ষাঁড়, ঘোড়া ইত্যাদির প্রতিপালনের উপযোগী পরিবেশ এই সকল অঞ্চলে যথেষ্ট ছিল। এই মতের সমর্থক করা বোখাজকোই অঞ্চলে আবিষ্কৃত কিছু তথ্য উপস্থাপন করেছেন। বোখাজকোই লিপিতে দেবতা হিসেবে ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, নাসত্য প্রমুখের নাম আছে, যা বৈদিক আর্যদের দেবতার নামের সাথে মিলে যায়। বালগঙ্গাধর তিলক তাঁর Arctic Home of the vedas গ্রন্থে উত্তর মেরু অঞ্চলকে আর্যদের আদি বাসস্থান বলে চিহ্নিত করেছেন। ঋগ্বেদে বর্ণিত আবহাওয়া বিশ্লেষণ করে তিনি সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, আদি আর্যরা উত্তর মেরুর মত কোন অতি শীত প্রবণ এলাকায় বাস করত। পরে তারা ইউরোপ, মধ্য এশিয়া ও ভারতে চলে আসে। কিন্তু অধিকাংশ পণ্ডিত তিলকের বক্তব্য বাতিল করে দিয়েছেন। বস্তুত উত্তরমেরু অঞ্চল মানুষের বসবাসের পক্ষে আদৌ উপযোগী নয় বলেই এঁরা মনে করেন।

অধ্যাপক হার্ট-এর মতে, আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল লিথুয়ানিয়া। সেখান থেকে ককেশাস পর্বত সংলগ্ন অঞ্চলে চলে আসে। পরে ককেশাস পার হয়ে তারা ইরানে প্রবেশ করে এবং একটি শাখা ইরান থেকে ভারতে চলে আসে। এই তত্ত্বের সমর্থনে তিনি জানান যে, খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দের বোখাজকোই লেখতে দেবতা হিসেবে ইন-দা-রা, ওয়া রু-না, মিথ্র, না-খ-অৎ-তি-আনা’ নামোল্লেখ আছে। এদের সাথে ঋগ্বেদের দেবতা ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র ও নাসত্যকে অভিন্ন বলে ধরে নেওয়া যায়। এছাড়া মিশরের তেল-এল-আর্মানা থেকে প্রাপ্ত আর একটি লেখতে কয়েকজন শাসকের নাম পাওয়া যায় যার অন্যতম হলেন তুসরও। এটি সম্ভবত সংস্কৃত দশরথ-এর সাথে তুলনীয়। এগুলি থেকে প্রমাণিত হয় যে, আর্যরা পশ্চিম-এশিয়া হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু হার্টের মতামত সন্দেহের ঊর্দ্ধে নয়। পণ্ডিতদের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দে পশ্চিম এশিয়ার আর্যভাষার যে নমুনা পাওয়া যায়, তাকে প্রাচীন ইরানীয় ও ঋগ্বেদের ভাষার আদি পর্যায় বলা যায়। এই পর্যায়ে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী অবিভক্ত অবস্থায় বসবাস করত। সেক্ষেত্রে ঋগ্বেদের রচনাকাল যদি ১৫০০ খ্রিস্টপূর্ব বলে মানা হয়, তাহলে প্রায় একশত বছর আগে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার বিভাজন কি ভাবে যুক্তিসিদ্ধ হতে পারে।

জার্মান পণ্ডিত অধ্যাপক ম্যাস্কমুলার মধ্য-এশিয়াকে আদি আর্য বাসভূমি হিসেবে নির্দিষ্ট করেছেন। স্থানীয় অধিবাসীদের ভাষার সাথে তিনি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। এখান থেকে তারা উত্তর-পশ্চিম মুখে যাত্রা করে। এদের একটি গোষ্ঠী কাসপিয়ানের উত্তর পথ ধরে এশিয়া মাইনর হয়ে গ্রীস, ইতালি প্রভৃতি দেশে চলে যায়। অন্য একটি শাখা উত্তর পশ্চিম গিরিপথ ধরে ভারতে প্রবেশ করে। এই মতটিও অনেকে বর্জন করেছেন। কারণ এই এলাকাটি পশুচারণকারী গোষ্ঠীর বসবাসের উপযোগী নয়। উপরন্তু এত বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর (বিভাজনের আগে) বসবাসের পক্ষে এই এলাকাটি ছিল খুবই সংকীর্ণ। ম্যাক্সমুলারের সমর্থনে স্ট্যাবো বলেছেন যে, বর্তমানে মধ্য এশিয়া যথেষ্ট উর্বর না হলেও, প্রাচীনকালে এ স্থান উর্বর ছিল। ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ভিত্তিতে এমন হওয়া স্বাভাবিক। তবে স্থান সংকুলান না-হওয়ার কারণেই মূলত আর্যরা গোষ্ঠীবিভক্ত হয়ে ইউরোপ ও এশিয়াতে পরিযায়ী হয়েছিল।

ব্রান্ডেনস্টাইন (W. Brandenstain) প্রয়োগিক শব্দার্থ বিদ্যার সাহায্যে আর্যদের আদি বাসস্থান খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, আর্যদের প্রথম দিকের শব্দ ভাণ্ডারের সাথে পরবর্তীকালের শব্দভাণ্ডারের বেশ প্রভেদ আছে। প্রথম পর্বের শব্দগুলিতে পশুচারণকারী, অশ্বপালক এক সমাজের ছবি ফুটে ওঠে। প্রবল গ্রীষ্ম, শীত বা বর্ষার উল্লেখ সেখানে অনুপস্থিত। অর্থাৎ কৃষিকাজের সাথে তাদের পরিচয় ততটা ছিল না। পশুপালনের উপযোগী তৃণভূমির সাথে তাদের তৎকালীন জীবন ধারা যুক্ত ছিল। প্রথম দিকের শব্দভাণ্ডার ব্যাখ্যার ভিত্তিতে ব্র্যান্ডেনস্টাইন মনে করেন যে কোন পর্বতমালার পাদদেশে শুষ্ক তৃণাবৃত সমভূমিতে (স্তেপি steppe) আদি ইন্দো-ইউরোপীয়দের অবস্থান ছিল। এই বিচারে তিনি উরাল পর্বতের (সোভিয়েত রাশিয়া) দক্ষিণে অবস্থিত ফিরঘিজ স্তেপি অঞ্চলকে আদি বাসভূমি রূপে চিহ্নিত করেছেন। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের পরবর্তীকালে ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর বিভাজিত সম্প্রসারণ ঘটে। মধ্য-এশিয়া থেকে পশ্চিম এশিয়ায় একটি গোষ্ঠী উপস্থিত হলে ঐ অঞ্চলে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা কিছুটা পরিবর্তিত ভাবে প্রয়োগ হতে শুরু করে। ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বের কিছু আগে ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠী আবার খণ্ডিত হয় এবং একটি গোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশে উপস্থিত হয়। এদের শব্দাবলীতে জলাভূমি, নতুন নতুন বৃক্ষরাজি ও জীবজন্তুর উল্লেখ পাওয়া যায়। শুল্ক স্তেপির সাথে যুক্ত শব্দরাজির পরিবর্তে জলাভূমির ইঙ্গিতবাহী শব্দচয়ন ঘটে। এইভাবে উরাল পর্বতের পাদদেশে স্তেপি অঞ্চল থেকে আর্যরা ভারতে উত্তর-পশ্চিমে পরিযায়ী হয়েছিল বলে ব্রান্ডেনস্টাইন মনে করেন।

এডোয়ার্ড মেয়ারের মতে, ইন্দো-ইরানীয় ভাষা ব্যবহারকারীরা মধ্য এশিয়ার পামির অঞ্চল থেকে ভারতে এসেছিল। তবে পর্বতমালা বেষ্টিত এই অঞ্চলকে একটি সুবৃহৎ ও পশুচারী জনগোষ্ঠীর বাসস্থানের উপযোগী নয় বলেই অনেক মনে করেন। আবার হাসফেল্ট রুশীয় তুর্কীস্থানের আমুদরিয়া ও সিরদরিয়া নদী বিধৌত সমভূমিকে ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর বাসস্থান বলে মত প্রকাশ করেছেন। কারণ বর্তমান তুরস্কের অন্তর্গত এশিয়া মাইনর অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে ঐ অঞ্চলে ইন্দো-ইরানীয় ভাষার অস্তিত্ব জানা গেছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বোঘাজকই লেখর কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি।

মারিয়া গিয়ামবুটাস-এর সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে আদি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর বাসভূমি হিসেবে দক্ষিণ রাশিয়াকে চিহ্নিত করা যায়। তাঁর মতে স্থানীয় ‘কুরগান’ সংস্কৃতির সাথে ইন্দো-ইউরোপীয় জীবন ধারার অনেক মিল আছে। উভয় সংস্কৃতিতেই পশুচারণ, অশ্বের গুরুত্ব, মৃতদেহ সমাধিস্থ করার রীতি ইত্যাদির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কুরগান সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে এবং কাম্পিয়ান সাগরের উত্তরাংশে এটির বিকাশ ঘটেছিল। যাযাবর বৃত্তির ফলে এরা ছিল পরিযায়ী। প্রথমে দক্ষিণ রাশিয়া থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত এরা এগিয়ে আসে। মধ্য এশিয়ায় পৌঁছানোর আগেই এদের একটি শাখা দক্ষিণ মুখে অগ্রসর হয়ে পশ্চিম এশিয়ায় চলে যায়। আর একটি অংশ পশ্চিম মুখে এগিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করে। তৃতীয় একটি গোষ্ঠী মধ্য এশিয়ায় উপস্থিত হয়। এখান থেকে একটি অংশ ইরানে অভিগমন করে। এরা ইন্দো-ইরানীয় (বা আর্য) নামে অভিহিত হয়। ইরানের মালভূমি অঞ্চলে কিছুকাল বসবাসের পর একটি অংশ আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিন্দুকুশ পর্বতমালার গিরিপথ দিয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতে চলে আসে।