আর্যরা যখন ভারতে আসে তখন তাদের সমাজে কোনোরূপ। বর্ণব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল না। তারা ভারতে ‘সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে স্থায়ীভাবে নিজেদের বসতির প্রসার ঘটানাের পরে তাদের সঙ্গে ভারতীয় অনার্যদের দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
[1] বর্ণভেদপ্রথা বিষয়ক ধারণা: আর্যদের গায়ের রং ছিল ফরসা এবং অনার্যদের ছিল কালাে। এই ব্যবধানকে স্থায়ী করার উদ্দেশ্যে আর্যরা সমাজজীবনে বিভিন্ন পেশা বা বৃত্তি অনুসারে বিভিন্ন গােষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে। এভাবে বৈদিক সমাজে বর্ণভেদ প্রথার উত্থান ঘটে। তাই ইতিহাসবিদ র্যাপসন বলেছেন যে, আর্য সমাজে ‘বর্ণ শব্দটি গায়ের রং বােঝাতেই ব্যবহৃত হত। আর্যরা ভারতীয় কৃয়াঙ্গদের অনার্য বা দস্যু বলত। তারা নিজেদের বর্ণের শ্রেষ্ঠত্ব ও মৌলিকত্ব বজায় রাখার জন্য সামাজিক রীতিনীতি, বিবাহ প্রভৃতি সম্পর্ক নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল।
[2] চতুর্বর্ণের উৎপত্তি: ঋগবেদের দশম মণ্ডলের পুরুষসূত্তে সর্বপ্রথম আর্য সমাজের শ্রেণিভেদের উল্লেখ পাওয়া যায়। পুরুষসূক্তের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে যে, আদি পুরুষ ব্রহ্মার মুখমণ্ডল থেকে ব্রাহ্মণ, বাচ়ুদ্বয় থেকে ক্ষত্রিয়, উরুদেশ থেকে বৈশ্য ও চরণযুগল থেকে শূদ্রের উৎপত্তি হয়েছে। এভাবে আর্য সমাজে ব্রাহ্মপ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—এই চারটি বর্ণের সৃষ্টির কথা জানা যায়।
ঋগবৈদিক যুগে আর্যসমাজে বর্ণপ্রথার উদ্ভব ঘটে। পরবর্তী বৈদিক যুগ থেকে এই বর্ণপ্রথার তীব্রতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঐতিহাসিকদের মতে, আর্যসমাজে বর্ণভেদ প্রথার উদ্ভব ঘটার বিভিন্ন কারণ ছিল। এই কারণগুলি হল一
[1] অনার্যদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা: গৌরবর্ণ ও দীর্ঘকায় আর্যদের চোখে খর্বকায় ও কৃয়বর্ণ অনার্যরা ছিল হীন বা নিকৃষ্ট। ক্রমে কৃয়কায় অনার্যদের সঙ্গে গৌরবর্ণ আর্যদের সহাবস্থানের ফলে তাদের মধ্যে সামাজিক রীতিনীতির সংমিশ্রণ ঘটতে থাকে। সেই কারণেই অনার্যদের থেকে নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য আর্যরা তাদের সমাজে বর্ণভেদপ্রথা চালু করার প্রয়ােজন বােধ করে।
[2] শ্রমবিভাজনের প্রয়ােজন: আর্যদের বসতির ক্রমশ প্রসার ঘটতে থাকলে কোনাে একজন আর্য পুরুষের পক্ষে জীবন-জীবিকার প্রয়ােজনীয় সব কাজ করে ওঠা সম্ভব হচ্ছিল না। যে সারাদিন যুদ্ধের কাজে নিযুক্ত থাকত তার পক্ষে কৃষি বা বাণিজ্যের কাজ করা সম্ভব ছিল না। এভাবে প্রয়ােজনের তাগিদে আর্যসমাজে শ্রমবিভাজনের সূচনা হয় এবং এক একজন ব্যক্তি বংশানুক্রমিকভাবে নির্দিষ্ট একটি পেশা বা বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। এভাবে বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে সামাজিক ভেদাভেদ আরও বৃদ্ধি পায়। আর্যদের মধ্যে এভাবে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য নামে তিনটি শ্রেণির সৃষ্টি হয়। অনার্যরা শূদ্র বলে পরিচিত হয়।
উপসংহার: বর্ণভেদ প্রথার চালু হওয়ার পর আর্য সমাজের এই প্রথায় আরও নানা পরিবর্তন ঘটে। পরবর্তীকালে বর্ণ বা জাতিভেদ প্রথায় কঠোরতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তা সত্বেও বৈদিক সমাজের চারটি বর্ণের মধ্যে নানা ধরনের সামাজিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
Leave a comment