হাজার বছর দীর্ঘ বৈদিক সভ্যতাকালীন সমাজ জীবনও একধারায় অগ্রসর হয়নি। আদি বৈদিক ও পরবর্তী বৈদিক সমাজ ব্যবস্থার নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর লক্ষণীয়। কোন কোন ক্ষেত্রে জীবনধারার অগ্রগতি যেমন দেখা যায়, তেমনি কিছুক্ষেত্রে প্রত্যাগতি লক্ষণীয়। ঋগ্বৈদিক সমাজ জীবন ছিল সহজ, সরল, জটিলতামুক্ত। কালক্রমে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি, বস্তুগত জীবনের রূপান্তর ইত্যাদি নানা কারণে পরবর্তী বৈদিক সমাজে জটিলতা বৃদ্ধি পায়।

ঋগ্বৈদিক সমাজের ভিত্তি ছিল কুল বা পরিবার। পরিবারগুলি ছিল সাধারণত যৌথ এবং বৃহদাকার। অন্তত তিন পুরুষের একান্নবর্তী পরিবারের অস্তিত্বের কথা ঋগ্বেদে উল্লেখ করা হয়েছে। পিতামহ, পিতামহী, কাকা, কাকিমা, ভগ্নী, ভাগ্না-ভাগ্নীসহ রক্তসূত্রে সম্পর্কিত অনেকেই এক একটি পরিবারের স্থায়ী সদস্য হতেন। এমন কি গৃহকর্তার শাশুড়ীও এহেন যৌথ পরিবারে সসম্মানে বসবাস করতে পারতেন। পরিবারগুলি ছিল ‘পিতৃতান্ত্রিক’। সুতরাং পরিবার পুরষ সদস্য দ্বারাই পরিচালিত থাকত। পরিবারের প্রধান বা পিতাকে বলা হত গৃহপতি। পরিবার পরিচালনা করা, শাসন করা ও নির্দেশ দেওয়ার সমস্ত ক্ষমতাই ছিল তার হাতে। পরিবারের সকলে তাঁর আদেশ বিনা প্রতিবাদে পালন করত। সমস্ত স্থাবর সম্পত্তির মালিক ছিলেন গৃহকর্তা। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র সম্পত্তির অধিকারী হতেন। কন্যাদের সম্পত্তিতে অধিকার স্বীকৃত ছিল। এ যুগে অতিথি সৎকারের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত। ঋগ্বেদে উল্লেখ আছে যে, অতিথি বিশেষ সম্মানীয় ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন।

পরিবার পিতৃতান্ত্রিক ও সমাজ পুরুষশাসিত হওয়ায় পুত্র-সন্তানের জন্মই কাম্য ছিল। কারণ পুত্র তার মৃত পূর্বপুরুষ ও পিতামাতার পারলৌকিক কর্ম সম্পাদনের অধিকারী ছিল। তাছাড়া পুত্র অধিক পরিমাণে খাদ্য ও সম্পদ আহরণ করে পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি করতে পারবে এবং দেশেরও শক্তিবৃদ্ধি করবে বলে মনে করা হত। এইজন্যই পিতা বৃদ্ধ ও অশক্ত হয়ে পড়লে সংসারের দায়িত্ব পুত্রের হাতে অর্পিত হত। কন্যা-সন্তানের জন্মকামনা করা না হলেও জন্মের পর কন্যা-সন্তানকে অবহেলা করা হত না। স্তোত্রের রচয়িতা হিসেবে এঁদের ‘ব্রষ্মবাদিনী’ বলা হয়েছে। এমনকি নারীর সভা সমিতির অধিবেশনে যোগ দিয়ে রাজনৈতিক কাজেও অংশ নিতে পারতেন। নারীরা যুদ্ধেও অংশ নিতেন। ইচ্ছানুসারে কোন নারী সারাজীবন কুমারী থাকতে পারতেন। স্ত্রীশিক্ষার সুযোগ ছিল ব্যাপক। বৈদিক যুগের নারী ঘোষা, অপালা, বিশ্ববারা প্রমুখ ছিলেন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিতা। এমনকি বহু স্তোত্রও তাঁরা রচনা করেছিলেন। বৈদিক সমাজে বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল না। বিবাহ মানবজীবনের এক পবিত্র ও অতি প্রয়োজনীয় কর্তব্য বলে বিবেচিত হত। সাধারণভাবে পিতামাতা কর্তৃক বিবাহ স্থির হলেও ঐ যুগে প্রেম ও অর্থমূল্যে বিবাহেরও প্রচলন ছিল। বহুবিবাহের প্রচলন প্রায় ছিলই না। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে পুরুষের একাধিক বিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর তার ছোট ভাইয়ের সাথে বিধবা ভ্রাতৃবধুর বিবাহের রেওয়াজ ছিল। তবে কেবল সন্তানহীনা বিধবা এই অধিকার পেতেন। লক্ষ্য ছিল পুত্র সন্তান লাভ করা। তাই এই প্রথাকে পুনর্বিবাহ বলা চলে না, ঋগ্বেদে এই প্রথাকে ‘নিয়োগ’ বলা হয়েছে। সতীদাহপ্রথা তাই প্রায় ছিলই না বা থাকলেও অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পর্দাপ্রথা ছিল না বললেই চলে। নারীদেরও সামাজিক, বিশেষত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেবার স্বাধীনতা ছিল। তবে সাধারণভাবে নারীর দায়িত্ব পিতা, স্বামী ও পুত্রের উপর অর্পিত থাকত।

ঋক্-বৈদিক যুগে জাতিভেদ প্রথা ছিল কিনা তা থাকলেও তা কিরুপে ছিল, তা সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। অনেকের মতে, ঐ যুগে জাতিভেদ ছিল না, তবে বর্ণভেদ ছিল। ঐতিহাসিক ব্যাসাম-এর মতে, বৈদিক যুগে বর্ণ বলতে জাতি বেঝাত না। একইভাবে রোমিলা থাপার মনে করেন যে বৈদিক যুগে জাতিভেদ সম্পর্কে সচেতনতার স্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। আর্যরা যখন ভারতে আসে তখন তাদের মধ্যে তিনটি সামাজিক শ্রেণী ছিল—যোদ্ধা বা অভিজাত, পুরোহিত এবং সাধারণ মানুষ। ডি. ডি. কোশাম্বী-এর মতে, ঋগ্বেদের যুগে উপজাতিদের মধ্যে জাতিভেদ বা শ্রেণীভেদ ছিল না। বৈদিক সমাজে বিভিন্ন পেশার কারিগররা উপজাতির স্বাধীন সদস্য বলেই গণ্য হতেন। কেউ কেউ মনে করেন জাতিভেদ প্রথা না থাকলেও ঋগ্বেদের যুগে বর্ণ প্রথার প্রচলন ছিল। এ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদের পুরুষ সুক্তের একটি সুক্ত উল্লেখ করা হয়। এটি হল— ‘ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীদ, বাহু রাজন্যকৃত; উরু তদস্য সদ বৈশ্যঃ’ পদভাং শূদ্রো অজায়ত।’ অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা পরমপুরুষের মুখ থেকে ‘ব্রাক্ষ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরুদ্বয় থেকে বৈশ্য এবং পদযুগল থেকে শূদ্রের সৃষ্টি করেছেন। আপাতভাবে এই বর্ণনা থেকে প্রাথমিকভাবে বর্ণ ব্যবস্থা এবং পরে পেশাভিত্তিক বংশানুক্রমিকতা থেকে জাতি প্রথার উদ্ভব হয়েছিল মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে ঋগ্বৈদিক সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে এবং বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে বর্ণভিত্তিক বিভেদের কঠোরতা ছিল না। বংশানুক্রমিক পেশা গ্রহণের বাধ্যবাধকতাও ছিল না। ঋগ্বেদের অন্য একটি সূক্তে বলা হয়েছে ‘আমি একজন কবি, আমার বাবা চিকিৎসক, আমার মা পাথরে শস্য পেশাই করেন। গোরু যেমন বিভিন্ন চারণক্ষেত্রে খাদ্য সংগ্রহ করে, আমরাও তেমনি বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত থেকে সুখ ও সম্পদ আহরণ করি।’ অর্থাৎ তখন পেশা গ্রহণের স্বাধীনতা ছিল। বংশানুক্রমিক পেশা গ্রহণের বাধ্যবাধকতা ছিল না। সবর্ণ বিবাহের বিষয়েও কঠোরতা ছিল না।

ঋগ্বেদের সুক্তটি দশম মণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ‍ পরবর্তী কালের সংযোজন। এটি মূলত গুণবাচক প্রশস্তি। মস্তিক অর্থাৎ‍ বুদ্ধির অধিকারী হিসেবে ব্রাহ্মণ, হস্তযুগল অর্থে পেশী শক্তির অধিকারী হিসেবে রাজন্য, উরুদ্বয় অর্থাৎ বাণিজ্য, কৃষি কাজ ইত্যাদি শ্রমসাদ্ধ কাজের উপযোগী এবং পদযুগল অর্থে শ্রমজীবী শ্রেণীকে বোঝাতে এটি রচনা করা হয়েছে। এখানে শ্রেণী, জাতি বা বর্ণভেদের কোন ইঙ্গিত খোঁজা সঠিক হবে না।

রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, বৈদিক সাহিত্য থেকে বংশভিত্তিক সামাজিক ভেদাভেদের কোন বিধান পাওয়া যায়নি। একই ভাবে ভি. এ. স্মিথ লিখেছেন, ‘আমি ঋগ্বেদে জাতিভেদের কোনও ইঙ্গিত পাইনি। সাধারণভাবে সমাজভুক্ত মানুষেরা চারটি দলে বিভক্ত ছিল কাজের ভিত্তিতে, যা ছিল প্রতীকী মাত্র (‘I do not find any indication of the caste in the Rigvedic times…. Mankind simply are roughly classified under four heads according to occupation, the mere honourable symbolic origin.”)

বর্ণ বিন্যাস প্রথম দেখা দিল যখন আর্যরা পরাজিত জনগোষ্ঠীকে (আর্য-অনার্য-দাস) নিজেদের সামাজিক গণ্ডির বাইরে গণ্য করতে শুরু করল। দাসদের সাথে একীভূত থেকে আর্যরা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিতে রাজী ছিল না। দাসদের গায়ের রঙ কালো, অন্যদিকে আর্যরা গৌরবর্ণ। এ-কারণে সমাজে যে ভেদাভেদটা এল তার ভিত্তি হল গাত্রবর্ণ। এইভাবে এল বর্ণভেদ। প্রথমে বর্ণভেদ এল আর্যদের মধ্যে-ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ ও বৈশ্য। পরে ‘দাস’ (আর্য-অনার্য) দের চতুর্থ বর্ণের অন্তর্ভুক্ত করে সমাজজীবনের শরিক করে নেওয়া হয়। কারণ প্রথম তিনটি বর্ণের জীবন ধারণের জন্য চতুর্থ বর্ণের সেবা অপরিহার্য ছিল।

পরবর্তী বৈদিক যুগে মানুষ পশুপালক অর্ধ-যাযাবর জীবন ধারা থেকে সরে এলে সামাজিক জটিলতা বৃদ্ধি পায়। কৃষির গুরুত্ব বৃদ্ধি এবং কারিগরি বৃত্তির বিকাশ সামাজিক ক্ষেত্রেও মানুষের অবস্থানগত সম্পর্কে জটিলতা বৃদ্ধি করে। এই সময় সমাজে বর্ণপ্রথার কঠোরতা বৃদ্ধি পায় এবং চতুবর্ণ প্রথা সামাজিক ভেদাভেদের তাত্ত্বিক নির্দেশিকা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। র‍্যাপসন গাত্রবর্ণের নিরিখে জাতিভেদপ্রথার যে তত্ত্ব উত্থাপন করেছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ গায়ের রঙ-এর নিরিখে ভেদাভেদ করা হলে সাদা ও কালো (গৌর ও কৃষ্ণ বর্ণ) এই দুটি ভাগ থাকত। কিন্তু বর্ণ ব্যবস্থায় চারটি বর্ণের উল্লেখ আছে। আবার এদের মধ্যে সাদা রঙ-এর অধিকারী আর্যদেরই তিনটি বর্ণে ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ ও বৈশ্য ভাগ করা হয়েছে। কার্যত পরবর্তী বৈদিক যুগের কৃষিজীবী স্থায়ী বসতি বিশিষ্ট সমাজে দায়িত্ব-কর্তব্য ও বৃত্তির ভিত্তিতে বর্ণপ্রথা সাংগঠনিক রূপ পেয়েছিল এবং জাতিভেদ প্রথার প্রাক্-পর্যায় হিসেবে সক্রিয় ছিল। রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় মনে করেন, আদি বৈদিক যুগের শেষ দিকে বর্ণপ্রথা এলেও, বৃত্তিগত জাতিভেদ প্রথা ছিল না। পরবর্তী বৈদিক যুগেই জাতিভেদের সূচনা ঘটেছিল। স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজের ওপরের স্তরে ছিলেন ব্রাক্ষ্মণ। ও ক্ষত্রিয়রা। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা ছিলেন দ্বিজত্বের অধিকারী। তবে বৈশ্যদের সামাজিক মর্যাদা প্রথম দুটি শ্রেণীর কাছাকাছিও ছিল না। আর শূদ্ররা ছিল ঘর থেকে অবহেলিত ও মর্যাদাহীন। প্রথম তিনটি শ্রেণীর সেবা করাই ছিল তাদের কাজ। ব্রাক্ষ্মণ ও ক্ষত্রিয় বর্ণের মধ্যে মর্যাদাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার চোরাস্রোত বহমান ছিল।

পরবর্তী বৈদিক যুগের প্রথমদিকে ব্রাহ্মণগণ সর্বাধিক গুরুত্ব পেতে শুরু করেন। এই সময় যাগযজ্ঞের ব্যাপকতা ও জটিলতা অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল। সেই জটিল যজ্ঞ প্রক্রিয়ায় একাধিক পুরোহিত শ্রেণীর মধ্যে ‘ব্রাক্ষ্মণ’ নামক গোষ্ঠীর ভূমিকা ছিল প্রধান ও নেতৃত্বমূলক। ধর্মাচরণের অনুসঙ্গ হিসেবে যজ্ঞের গুরত্ব বৃদ্ধির ফলে অনিবার্যভাবেই ব্রাহ্মণদের সামাজিক মর্যাদা ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যগুলিতে বৈদিক জ্ঞানের আধার হিসেবে ব্রাহ্মণদের গুরুত্ব বারবার উদ্ধারিত হয়েছে। এমনকি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্বে রাজন্যদেরও (ক্ষত্রিয়) ধর্মক্রিয়া সম্পাদনের জন্য ব্রাহ্মণদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হত। ব্রাহ্মণের পরেই ছিল ক্ষত্রিয় বর্ণের অবস্থান। ঋগ্বেদের যুগের রাজন্য এখন ‘ক্ষাত্র’ শক্তির অধিকারী হয়ে ক্ষত্রিয়তে পরিণত হয়েছেন। দেশ ও দেশবাসীর রক্ষক হিসেবে এঁরা বিশেষ মর্যাদা ও কর্তৃত্বের অধিকারী হন। ব্রাক্ষ্মণ ও ক্ষত্রিয় উভয়েই সামাজিক প্রাধান্য দাবি করায় উভয়বর্ণের মধ্যে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। ব্রাহ্মণের ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ ব্যতিত রাজার অভিষেক বা পূণ্যার্জন সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে ব্রায়ণ তাঁদের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ক্ষত্রিয় শ্রেণীর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে একটা সমঝোতা গড়ে উঠেছিল, যা উভয়ের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সহায়ক হয়।

বর্ণপ্রথার তৃতীয় স্থানে অবস্থিত বৈশ্যদের অবস্থার ক্রমশ অবনমন ঘটেছিল। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের মত ‘দ্বিজ’ত্বের অধিকারী হলেও, এদের সাথে ব্রাক্ষ্মণ-ক্ষত্রিয়ের পরিবর্তে শূদ্রদের সাথেই বেশী মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি এবং বিভিন্ন কারিগরি কাজ ছিল বৈশ্যদের পেশা। অর্থাৎ দেশের সম্পদ সৃষ্টির কেন্দ্রে ছিল বৈশ্যরা। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য থেকে এদের ক্রমবর্ধমান দুরবস্থার প্রমাণ পাওয়া যায়। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে যে, বৈশ্য অন্যের দয়ায় বাঁচে এবং তাকে যথেচ্ছ শোষণ করা যায়। বৈশ্য হল ‘বলিকৃৎ’ অর্থাৎ শাসকের জন্য রাজস্ব (বলি) সৃষ্টির আধার, ‘যথাকামোযোগ্য’ অর্থাৎ তাকে যখন ইচ্ছা উৎখাত করা যায়। ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের অবস্থান ছিল খাদক ও খাদ্যের সমতুল্য। এই কারণে বৈশ্যরা সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক সঙ্গতির দিক থেকে ক্রমশঃ পিছিয়ে পড়তে থাকে এবং বৈদিক যুগের শেষ দিকে বৈশ্য ও শূদ্ররা পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসে, সূদ্রের নির্দিষ্ট কোন বৃত্তি ছিল না। তাদের একমাত্র কাজ ছিল উচ্চতর তিন বর্ণের সেবা করা। শিক্ষা লাভ, বেদপাঠ কিংবা বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও শূদ্রদের ছিল না। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে যে, শূদ্র অন্যের সেবাদাস। প্রভুর ইচ্ছায় তাকে উৎখাত করা যায় এবং তার প্রাণ হরণ করা যায়। উচ্চতর দুটি বর্ণ উপলব্ধি করেছিল যে, সম্পদ উৎপাদনকারী বৈশ্য এবং শ্রমের উৎস শূদ্রদের বশীভূত রাখতে পারলেই সার্বিক সমাজজীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখা সম্ভব হবে। তাই পরবর্তী বৈদিক যুগের শেষ দিকে ব্রাক্ষ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের মধ্যে যেমন সমঝোতা বৃদ্ধি পায়, তেমনি বৈশ্য ও শূদ্র বর্ণভুক্তরা পরস্পরের সমব্যথী ও সহযোগী হয়ে উঠতে থাকে।

বর্ণপ্রথার কঠোরতার অনুসঙ্গ হিসেবে সামাজিক বিধি বিধানেও পরিবর্তন সূচিত হয়। ব্রাহ্মণগণ এই সময় বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়েন। সবর্ণে বিবাহ স্বীকৃত হয়, কিন্তু সগোত্র বিবাহ নিষিদ্ধ থাকে। তবে এর ব্যতিক্রম যে ঘটত পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য থেকে তা জানা যায়। বৈদিক সাহিত্যে ‘অনুলোম’ ও ‘প্রতিলোম’ বিবাহের উল্লেখ আছে। উচ্চতর বর্ণের পুরুষের সাথে নিম্নতর বর্ণের কন্যার বিবাহকে বলা হত অনুলোম বিবাহ। এই অসবর্ণ বিবাহ স্বীকৃত ছিল। অন্যদিকে নিম্নতর বর্ণের পুরুষ ও উচ্চতর বর্ণের কন্যার বিবাহ ছিল ‘প্রতিলোম’ বিবাহ। এই বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। তবে সাহিত্যে এর উল্লেখ থেকে অনুমিত হয় যে, বিচ্ছিন্নভাবে হলেও এমন বিবাহ ঘটত। এই প্রসঙ্গে পরবর্তী বৈদিক সমাজে নারীর অবস্থানের অবনমন প্রক্রিয়াটি লক্ষণীয়। এই সময় সমাজ কঠোরভাবে পুরুষতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। কন্যা সন্তানের জন্মকে ‘কষ্টের কারণ’ (কৃচ্ছং তু দুহিতা) হিসেবে অভিহিত করা শুরু হয়। রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়। ঋগ্বৈদিক যুগে ‘সভা’ নামক গণপরিষদে মহিলারাও উপস্থিত থাকতে পারতেন। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক নারীর সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। বিবাহিত জীবনেও নারীর অধিকারের সংকোচন ঘটে। এখন সংসার কর্ম এবং পতি সেবাকেই নারীর মূল কর্তব্য বলে প্রচার করা হয়। স্বামীর জৈব কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার মধ্যেই নারী জীবনের সার্থকতা বেঁধে দেওয়া হয়। যজ্ঞানুষ্ঠানে স্বামীর পাশে উপস্থিত থাকার অধিকার পত্নীকে দেওয়া হলেও আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নারীর বাল্য বিবাহ ও পুরষের বহু বিবাহ উৎসাহিত হয়। পুরুষের বহুবিবাহের রীতি স্ত্রীদের দুর্দশা বৃদ্ধির দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচ্য। বৈদিক শিক্ষাগ্রহণ এবং বেদ পাঠের অধিকার থেকেও এখন নারীদের বঞ্চিত করা হয়। গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রমুখ শিক্ষিতা নারীর ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বাদ দিলে, সাধারণ ভাবে পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীর অধিকার, মর্যাদা ও স্বাধীনতা পরিকল্পিত ভাবেই সংকুচিত করা হয়েছিল।

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য থেকে পোষাক-পরিচ্ছদের বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানা যায়। সিল্ক, পশম ও স্মৃতি বস্ত্রের পোষাক পরিধান করা হত। সাধারণভাবে তিনটি অংশে বিভক্ত পরিচ্ছদের প্রচলন ছিল—নিভি (অর্ন্তবাস), বাস (নিম্নঅংশ) এবং অধিবাস (উপরের অংশ)। রঙ্গীন ও সূচীশিল্প শোভিত পোষাক জনপ্রিয় ছিল। পুরুষেরা মস্তকে পাগড়ি পরিধান করতেন। অলংকার হিসেবে বাহুবন্ধ, অঙ্গুরীয়, নেকলেস ইত্যাদি জনপ্রিয় ছিল। অবসর বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নৃত্য, গীত, পোল নৃত্য, এ্যাক্রোব্যাট ইত্যাদির উল্লেখ যর্জুবেদে পাওয়া যায়।