প্রশ্নঃ বেন্থামের উপযোগবাদ সমালোচনাসহ ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকাঃ জেরেমী বেন্থাম, জন স্টুয়ার্ট মিল ও হেনরি সিজউইকের দ্বারা প্রবর্তিত নৈতিকতার মানদণ্ড সম্পৰ্কীয় মতবাদ উপযোগবাদ নামে পরিচিত। এসব চিন্তাবিদ তাদের যুক্তিসমূহ উপস্থাপন করতে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করলেও তাদের বক্তব্যের মধ্যে একটা বিষয়ে মিল রয়েছে এবং সেটা হচ্ছে সর্বাধিক সংখ্যক লোকের জন্য সর্বাধিক পরিমাণ সুখ অন্বেষণ করা।
বেন্থামের উপযোগবাদঃ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক জেরেমী বেন্থাম মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদ থেকে সর্ববাদী সুখবাদ বা উপযোগবাদের কথা প্রচার করেছেন। মানব প্রেষণার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, সুখের অন্বেষণ ও দুঃখকে পরিহার করাই মানব প্রকৃতির একমাত্র উদ্দেশ্য। তিনি কতকগুলো নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন যেসব নিয়ন্ত্রণই মানুষকে তার নিজের সুখ বা স্বার্থ বর্জন করে সমাজের সর্বসাধারণের সুখ বা মঙ্গল চিন্তা করতে বাধ্য করে। যার ফলে মানুষ আত্মসুখের পরিবর্তে পরের সুখের কথা চিন্তা করে। সেই নিয়ন্ত্রণগুলো হলো-১. প্রাকৃতিক বা জাগতিক, ২. রাষ্ট্রীয়, ৩. নৈতিক বা লৌকিক যা প্রায়শ সামাজিক বলে বর্ণিত হয়ে থাকে এবং ৪. ধর্মীয়। বেন্থাম সুখের কোনো গুণগত পার্থক্যের কথা স্বীকার না করে কেবল পরিমাণগত পার্থক্যের কথা স্বীকার করেছেন। বেন্থাম সুখের পরিমাপ করার জন্য সাতটি রূপের কথা বলেছেন। নিম্নে সেগুলো দেখানো হলোঃ
১. তীব্রতাঃ সব সুখের তীব্রতা এক নয়। কোনো সুখের তীব্রতা কম আবার কোনো সুখের তীব্রতা বেশি হতে পারে।
২. স্থায়িত্বঃ বেন্থাম মনে করেন সুখের স্থায়িত্ব কম বা বেশি হতে পারে। আমাদের সর্ব সময় স্থায়িত্ব সুখ কামনা করা উচিত।
৩. নিশ্চয়তাঃ অনিশ্চিত সুখের পিছনে আমাদের দৌড়িয়ে লাভ নেই। নিশ্চয় সুখই আমাদের কাম্য হওয়া উচিত।
৪. নৈকট্যঃ ভবিষ্যতে আমরা কোনো সুখ পাব তানা ভেবে বর্তমানে আমরা কোনো সুখ ভোগ করছি সেটাই আমাদের দেখার বিষয়।
৫. উর্বরতাঃ উর্বর সুখ কখনো একা আসতে পারে না। তার সাথে অন্যান্য সুখও আমাদের হাতে ধরা দেয়। সেকারনে উর্বর সুখই আমাদের কাম্য হওয়া উচিত।
৬. বিশুদ্ধতাঃ বিশুদ্ধ সুখ বলতে বোঝায় এমন একটি সুখকে যেখানে দুঃখের কোনো স্থান নেই। শুধুমাত্র অনাবিল সুখই মানুষের প্রধান লক্ষ্য।
৭. বিস্তৃতিঃ সুখের বিস্তৃতি জনসংখ্যার অনুপাতের উপর নির্ভর করে। যে সুখ সর্বাধিক সংখ্যক লোক ভোগ করতে পারে সেই সুখই ভালো। বেন্থাম এসবের পাশাপাশি আরো কয়েকটি মৌলিক নিয়ন্ত্রণের কথা প্রচার করেছেন। যেমন- সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, নৈতিক ও ধর্মীয়। এ সকল নিয়ন্ত্রণের অন্তর্নিহিত মূল্য অপরিসীম।
সমালোচনাঃ বেন্থামের উপযোগবাদে বেশ কয়েকটি ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে সেগুলো দেওয়া হলোঃ
প্রথমত, বেন্থামের উপযোগবাদের ভিত্তি মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদ হওয়ার ফলে মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদের ত্রুটিসমূহ বেন্থাম মতবাদেও বর্তমান। সুখকে মানব কামনার একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদ। অর্থাৎ এ মতবাদ অশ্বের সম্মুখে শকট রাখার মতো দোষে দোষযুক্ত।
দ্বিতীয়ত, আত্মাবাদী সুখবাদ থেকে পরার্থবাদী সুখবাদ উত্তরণের ক্ষেত্রে বেন্থাম যে বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণের সাহায্য নেন তা যুক্তিসঙ্গত নয়। কেননা নৈতিক দায়িত্ববোধ বা বাধ্যবাধকতা বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় না।
তৃতীয়ত, বেন্থাম পরিমাণগত পার্থক্যের প্রেক্ষিতে সুখের যে বিচারের কথা বলেছেন, তাও সন্তোষজনক নয়। সুখ অনুভূতির ব্যাপার হওয়ায় তার পরিমাণ নির্ণয় কথা সম্ভব নয়।
চতুর্থত, বেন্থাম সুখের কেবল পরিমাণগত পার্থক্যের কথা বলে মানসিক বা মার্জিত সুখের পরিবর্তে দেহজ বা অমার্জিত সুখের কথা বলেন। অন্যদিকে বেন্থাম ভবিষ্যতের সুখের পরিবর্তে বর্তমান সুখের উপর যে গুরুত্বারোপ করেছেন তাও যুক্তিসম্মত নয়।
পঞ্চমত, বেন্থাম মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদ থেকে নৈতিক সুখবাদের উত্তরণ সম্পর্কে যা বলেন তা সন্তোষজনক নয়। মানুষ স্বাভাবতই সুখ কামনা করে- এ বক্তব্য থেকে সুখ মানুষের কাছে কাম্য হওয়া উচিত এ বক্তব্যে পৌঁছা যুক্তিসম্মত নয়৷
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বেন্থামের পরার্থবাদী সুখবাদ বা উপযোগবাদে নানা ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এ আত্মসুখবাদের পরিবর্তে পরার্থবাদী সুখবাদের কথা বলে মানব সভ্যতার ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছে, তার মূল্যকে একবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
Leave a comment