টিনের তলোয়ার নাটকের প্রধান চরিত্র বেণীমাধব চাটুজ্যে। তাকে নায়ক পদমর্যাদায় বিভূষিত করা যেতে পারে। নাটকের শুরুতে দেখা যায় ভোররাত্রে নটবর নামের এক শীর্ণ যুবককে নিয়ে বেণীমাধব শহরের দেয়ালে থিয়েটারের পোস্টার সাঁটায় ব্যস্ত। তখন সে মদের ঘোরে বেসালাম। এমন সময় এক মেথর ম্যানহোল থেকে ময়লা তুলে ওপরে ফেলছে। সেই ময়লা বেণীমাধবের গায়েও লেগে যায়। কিন্তু তাতে ক্রুদ্ধ হয় না সে। মেথরের সঙ্গে বেণী আলাপ শুরু করে থিয়েটারের প্রসঙ্গ নিয়ে। মেথর থিয়েটার দেখেনি। সে মধুসূদন দত্ত এবং তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যের নামও শোনেনি। তবুও বেণীমাধব অযাচিতভাবে জানায়, সে বাংলার গ্যারিক, ইন্ডিয়া মিরর পত্রিকা তার নাটক দেখে তাকে ওই আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু যখনই মেথর শোনে, বেণী জাতে চাটুজ্যে ব্রাহ্মণ, তখন ঘৃণায় তার পায়ের কাছে সে ময়লা ফেলে। সে ময়লা বেণীর গায়ে লাগে কিন্তু তাতে বেণী রাগ করেনি। উলটে মেথরের কাছে সে বিবৃত করে তার জীবন কাহিনি। সেই কাহিনি থেকে জানা যায়, বেণীমাধব থিয়েটারে আসার আগে যাত্রায় অভিনয় করত। শ্যামবাজারের চক্কোতিবাবুদের বাড়িতে বিদ্যাসুন্দর পালার অভিনয়ে তার ছিল কোটালের ভূমিকা। বেণীমাধব বলতে চায়, সে ব্রাহ্মণ নয়, থিয়েটারওয়ালা। অভিনয় বেচে খাওয়া তার পেশা। তার জন্য তার আত্মশ্লাঘার শেষ নেই।

বেণীমাধব তার থিয়েটারের নারী অভিনেত্রী পথ থেকে বেশ্যা পল্লি থেকে খুঁজে আনে। এইসব মেয়েরা কাদার তাল বা পাথরের চাংড়া। ওই কাদার তাল থেকে সে গড়ে তোলে থিয়েটারের নায়িকা। এইরকম অভিনেত্রীর নাম মানদা সুন্দরী। কিন্তু দুর্ভাগ্য বেণীর, সেই মানদা সুন্দরীকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে গেছে গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারের কর্তারা। বেণীমাধবকে এমন সব পালায় অভিনয় করতে হয় যাতে ইংরেজি সংলাপ আওড়াতে হয়। কিন্তু সে নিরক্ষর। ইংরাজি সংলাপ ঠিকভাবে উচ্চারণের জন্য সে জানবাজারের কোয়েল হো নামের এক ফিরিঙ্গির কাছে যায়। তার ফলে বেণীর ইংরেজির উচ্চারণ খুব নিখুঁত। নাট্যকার প্রিয়নাথ মল্লিক বেণীর ‘সধবার একাদশী’র নাটকের নিমচাঁদ চরিত্রের অভিনয় দেখে অবাক হয়ে বেণীকে জিজ্ঞাসা করে–“আচ্ছা আপনি বলেন ইংরেজি জানেন না, তাহলে নিমচাঁদ করেন কী করে ? স্টেজেতো ইংরিজির তুবড়ি ছোটে।” উত্তরে বেণী বলে—ইংরেজির উচ্চারণ সে নিখুঁতভাবে করলেও সেই ইংরেজির অর্থ তার জানা নেই। এদিকে মদ্যপানে বেণীর বড়ো আকর্ষণ। সে সব সময়ই প্রায়ই নেশার ঝোঁকে থাকে। কিন্তু তাতে থিয়েটার পরচিালনায় কোনো অসুবিধা হয় না। সে থিয়েটারের কাপ্তেন এবং নট ও নাট্য শিক্ষক। থিয়েটারের সর্বাঙ্গীণ ব্যাপারে বেণীর নজর তীক্ষ্ণ। সারারাত অভিনয়ের পর বেণী মদ্যপান করে এবং সকালে দেরি করে তার ঘুম ভাঙে।

থিয়েটারের মালিক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁর কাছে বেণীমাধব নতজানু হয়ে থাকে। কারণ বীরেন্দ্রবাবু যদি থিয়েটার তুলে দেয়, তবে থিয়েটারওয়ালার জীবন বিপন্ন হবে। থিয়েটার চললে, ভালো টিকিট বিক্রি হলে, থিয়েটার কর্মীদের পকেটে টাকা আসবে। তবেই থিয়েটার চলবে। সেইজন্য বেণীমাধব এমনসব নাটক বাছে, যাতে আছে রোমান্স, নাচ গানের বাড়াবাড়ি। তার সঙ্গে ইংরেজি বিরোধিতাকে সম্পূর্ণ বর্জন করার প্রমাণ যেসব নাটকে থাকবে সেইসব নাটকও বেণীমাধবের খুব পছন্দ। ফলে দি গ্রেট বেঙ্গলে অভিনীত দীনবন্ধুর ‘সধবার একাদশী’ বা ‘ময়ূর বাহন’ নাটক যেসব নাটকে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধক কাহিনি থাকবে এবং সেই সঙ্গে ইংরেজি বিরোধী মনোভাব ব্যক্ত হবে, সেইসব নাটকের দিকে বেণীমাধব ফিরেও তাকায় না। আবির্ভাব হয় নতুন নাট্যকারের। নাটক লেখেন ‘পলাশীর যুদ্ধ’। নাট্যকার প্রিয়নাথ মল্লিক। বেণীমাধব সে নাটক মনোনীত করেনি। নাট্যকার আবার একখানি নাটক লিখে জমা দেন- নাম ‘তিতুমীর’। এ নাটক বেণীর পছন্দ হয়। তিতুমীরের ভূমিকা নেয় সে নিজেই। বাদ সাধে থিয়েটার মালিক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ। অবশেষে ‘তিতুমী’রের পরিবর্তে অভিনয় হয়— “সধবার একাদশী’। বেণীর মধ্যে কিন্তু লুকিয়ে থাকে দেশপ্রেমের বীজ। আসলে বাইরে থেকে বেণীকে দেখে মনে হয় সে একজন নিরীহ, মদ্যপ, কিন্তু অন্তরে সে একজন মহান দেশপ্রেমী।

থিয়েটারে দেশপ্রেমের নাটক অভিনীত হলে ইংরেজরা থিয়েটার উঠিয়ে দেবে। বেণীমাধব দেশপ্রেমী হলেও এইসব হঠকারী ব্যাপারে মাথা গলাতে চায় না। গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার এই হঠকারী কাজ করতে গিয়ে বিপদ ডেকে এনেছে। ফলে নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন জারি হয়েছে। ফলে থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বেণীমাধব তার হতে গড়া নটী ময়নাকে পর্যন্ত থিয়েটারের মালিক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দার হতে তুলে দিয়েছে। ময়না রাস্তার মেয়ে। আলু বেগুন বেচে তার দিন চলত। কিন্তু তার গানের গলা চমৎকার। একদিন শেষরাত্রে কলকাতার রাস্তায় পোস্টার সাঁটতে গিয়ে অকস্মাৎ এক অচেনা মেয়ের গলায় গান শুনে বেণী মুগ্ধ হয়। সেই অচেনা মেয়েটিই হল ময়না। তাকে থিয়েটারের নায়িকা করা হবে, এই কথা দিয়ে বেণী তাকে থিয়েটারে নিয়ে আসে। তাকে সে মেজে ঘসে শিখিয়ে পড়িয়ে পাকা অভিনেত্রীতে পরিণত করে। ময়নার রূপ-যৌবনের প্রতি আকৃষ্ট হয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ। সে বেণীমাধবকে প্রস্তাব দেয়, শ্যামবাজারে তার প্রতিষ্ঠিত থিয়েটারে মালিক করে দেবে বেণীমাধবকে। বেণী এ প্রস্তাবে রাজি হয়। থিয়েটারের নটনটীরা বিশেষ করে বসুন্ধরা এবং নাট্যকার প্রিয়নাথ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কথা বলে। প্রিয়নাথ ও ময়না একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। কিন্তু বেণী দেখেছে ময়না প্রিয়নাথের জীবনের সঙ্গে জীবন মেলালে, সে আর্থিক দুর্গতিতে পড়বে। কারণ প্রিয়নাথ জীবিকা হিসাবে বেছে নিয়েছে আস্তাবলের রক্ষণা-বেক্ষণের চাকরি। এই চাকারির তো কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তার বদলে ময়না বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁর স্নেহাশ্রয়ে থাকলে ময়নাও যেমন স্বচ্ছলতার মুখ দেখবে তেমনি বেণীমাধবও একটি থিয়েটারের মালিক হবে। ময়না অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নেয় এই ব্যবস্থা।

সর্বোপরি, নাটকের অন্তিম লগ্নে দেখা যায়—বীরেন্দ্রবাবুর আপত্তিতে ‘তিতুমীর’ মঞ্চস্থ না হলেও তার প্রতি গভীর আসক্তি বশত ‘সধবার একাদশী’ অভিনয় করতে করতে পুলিশ অফিসার ল্যাম্বার্ট সাহেবকে দেখে বেণী তিতুমীরের পার্ট বলা শুরু করে। এই পরিবর্তনে যেমন বেণীমাধব চরিত্র ব্যক্তিত্ববান ও প্রতিবাদী হয়েছে, তেমনি নাট্যকার উৎপল দত্ত তাঁর বিপ্লবী থিয়েটারের স্বরূপ উদ্‌ঘাটন করেছেন। বেণী আপাত দৃষ্টিতে মাতাল, মালিকের ধামাধরা, প্রচলিত জীবনধারার প্রতি নিবেদিত প্রাণ হলেও, তার সমকালীন সাহিত্য ও থিয়েটারের জগৎ সম্পর্কে ছিলেন যথেষ্ট সচেতন। মধুসূদন, দীনবন্ধু, বঙ্কিমচন্দ্র প্রভৃতি কবি ও লেখকদের চেষ্টা সম্পর্কে সে সচেতন। যখন তখন সে মেঘনাদবধ কাব্যের অংশ বিশেষ আবৃত্তি করে। গিরিশচন্দ্র, অর্ধেন্দুশেখর, অমৃতলাল, ভুবনমোহন নিয়োগী প্রভৃতি নাট্য বক্তিত্বদের সম্পর্কে তার শ্রদ্ধা অটুট। রাস্তার মেথর-কে সে ঘৃণা করে না, তাকেও তার থিয়েটারের প্রতি আকৃষ্ট করতে চায়। নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন পাশ হবার পরেও বিপ্লবী থিয়েটারের ঝুঁকি নিয়ে সে শেষ পর্যন্ত ইংরেজ বিদ্বেষী তিতুমীর নাটক–অভিনয় করে। ফলে পূর্বোক্ত নাট্যব্যক্তিত্বদের তালিকাভুক্ত হওয়া তার পক্ষে সম্ভব। কাজেই বেণীমাধব যথার্থই তৎকালীন বাংলা থিয়েটারের গ্যারিক।