বৃহৎ সমাজে রাষ্ট্রের স্থান সম্পর্কিত আলোচনা: বৃহৎ সমাজে রাষ্ট্র কোন একক প্রতিষ্ঠান নয়। এই সমাজে অন্যান্য বহু প্রতিষ্ঠান আছে। রাষ্ট্রের স্থান তাদের মধ্যে একটি। বৃহৎ সমাজের একটি অংশ হল রাষ্ট্র। তবে রাষ্ট্র হল এই বৃহৎ সমাজের একটি অত্যন্ত মূল্যবান অংশ। ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে, “The State is the keystone of the social arch.” বস্তুত রাষ্ট্রের যথার্থ স্বরূপ অনুধাবনের স্বার্থে বৃহৎ সমাজের পটভূমিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা পর্যালোচনা করতে হবে। এবং এই উদ্দেশ্যে বৃহৎ সমাজকে এবং সমাজে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভূমিকাকে জানতে হবে। রাষ্ট্রের ভৌগোলিক এলাকা এবং আইনগত এক্তিয়ারের মধ্যে বহু ও বিভিন্ন সংঘ-সমিতি আছে। এই সমস্ত সামাজিক সংগঠন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশে সাহায্য করে। তাই এই সমস্ত সংগঠনের সঙ্গে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গ নানাভাবে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু সমাজের সঙ্গে ব্যক্তিবর্গের এই সম্পর্ক কোন রকম বৈধতার আনুষ্ঠানিকতার দ্বারা আবৃত নয়। এতদ্‌সত্ত্বেও এই সম্পর্ক বৈধ সম্পর্কের থেকে কোনক্রমে শিথিল নয়। অপরদিকে রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক বিধি-শাসিত। এই বৈধতার সম্পর্ক ব্যক্তি ছিন্ন করতে পারে না। এর কারণ হিসাবে ল্যাস্কি বলেছেন: “It ( State) is the final legal depository of the social will.” একই ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠিত হয়। এই কারণে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গ কেবলমাত্র রাষ্ট্রের কাজকর্মের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রাখতে পারে না। এই সমস্ত কারণের জন্য বৃহৎ সমাজে রাষ্ট্রের স্থান বা ভূমিকা সম্পর্কিত আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা: বৃহৎ সমাজে রাষ্ট্রের প্রকৃত ভূমিকা সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য বর্তমান। এ প্রসঙ্গে মূলত তিন ধরনের মতবাদ পরিলক্ষিত হয়। এই মতবাদগুলি হল ভাববাদ, বহুত্ববাদ ও মার্কসবাদ। ল্যাস্কি এ ক্ষেত্রে বহুত্ববাদী বক্তব্যের দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হয়েছেন। তবে বৃহৎ সমাজে রাষ্ট্রের সঠিক স্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে ল্যাস্কি নিম্নোক্ত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি পর্যালোচনা করেছেন। এই সমস্ত দৃষ্টিকোণগুলি হল: 

  • (১) ব্যক্তির আনুগত্যের ভিত্তি, 

  • (২) নাগরিকের অধিকার এবং 

  • (৩) সমাজের যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতি।

(১) ব্যক্তির আনুগত্যের ভিত্তি

ব্যক্তির আনুগত্য বহুধা বিভক্ত: একচ্ছত্র আনুগত্য লাভের ব্যাপারে রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ দাবিকে অধ্যাপক ল্যাস্কি স্বীকার করেন নি। এ ক্ষেত্রে ল্যাস্কির উপর বহুত্ববাদী প্রবণতার প্রভাব সুস্পষ্ট। মানবসমাজে রাষ্ট্র ছাড়াও অন্যান্য বহু প্রতিষ্ঠান বর্তমান। এই প্রতিষ্ঠানগুলিও এই বৃহৎ সমাজের অংশ। মানুষের স্বার্থসাধনকারী এই সমস্ত সংস্থার সঙ্গে প্রত্যেক ব্যক্তি নানাভাবে সম্পর্কযুক্ত। ব্যক্তিগত স্বার্থ সাধনের জন্য স্বার্থসাধনকারী বহু ও বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে প্রত্যেক ব্যক্তিকে জড়িত থাকতে হয়। এই অবস্থায় ব্যক্তি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্ত সংস্থার প্রতিও আনুগত্য দেখায়। অর্থাৎ এই বৃহৎ সমাজে ব্যক্তির আনুগত্য রাষ্ট্র ও অন্যান্য সামাজিক সংঘ-সংগঠনের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এখন রাষ্ট্রের সঙ্গে কোন সামাজিক সংগঠনের যদি বিরোধ বাধে তখন ব্যক্তির আনুগত্য প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সমস্যার বা সংশয়ের সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় কার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করবে এবং কার প্রতি করবে না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে ব্যক্তি নিজে।

ব্যক্তি অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আনুগত্য স্থির করে: প্রকৃত প্রস্তাবে ব্যক্তির আনুগত্য প্রদর্শন ও প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া তার অভিজ্ঞতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সমাজে ব্যক্তির কাছে রাষ্ট্র হল সর্বোচ্চ সংস্থা। ব্যক্তি রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত আইনের মাধ্যমে তার চাহিদা পূরণের চেষ্টা করে থাকে। রাষ্ট্রকে একটি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসাবে যদি ধরা হয়, তা হলে ব্যক্তিবর্গের জীবনে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের ফলাফলের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রের যথার্থতা নির্ধারিত হবে। আইনের ফলাফলের ভিত্তিতে ব্যক্তি আনুগত্য প্রদর্শন বা প্রত্যাহারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ব্যক্তিমাত্রেই তার অভিজ্ঞতা এবং রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও কার্যাবলীর ফলাফল বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে আনুগত্যের ব্যাপারে মতামত ঠিক করে। “An Introduction to Politics শীর্ষক গ্রন্থে ল্যাস্কি বলেছেন: “His own experience counts. He judges what the State does.”

জনস্বার্থে রাষ্ট্রের ভূমিকার উপর আনুগত্যের দাবি নির্ভরশীল: রাষ্ট্র ও আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নাগরিকদের উপরই নির্ভরশীল। কারণ নাগরিকদের উপরই আইন প্রযুক্ত হয়। সুতরাং কেবল নাগরিকরাই আইনের ফলাফল, গুণাগুণ ও সার্থকতা বিচার-বিবেচনা করতে পারে। এবং আনুগত্যের বিষয়টি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলীর ফলাফল পর্যালোচনার উপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব যে আনুগত্য দাবি করে তা ব্যক্তি জীবনের স্বার্থে রাষ্ট্র কি ভূমিকা পালন করে তার উপর নির্ভরশীল। An Introduction to Politics শীর্ষক গ্রন্থে ল্যাস্কি বলেছেন: “Its claim to obedience, depends what does to the lives of individual citizens.” প্রত্যেক নাগরিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও কাজকর্ম সব সময় বিচার-বিবেচনা করে দেখে। রাষ্ট্রের সকল কাজকর্ম কল্যাণকর বলে প্রতিপন্ন হলে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তা নাগরিকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়। আইনের ফলাফল পর্যালোচনার পর নাগরিকদের অভিজ্ঞতায় যদি প্রতীয়মান হয় যে, তাদের কার্যকর চাহিদা পূরণ করতে আইন সমর্থ, তখনই নাগরিকরা আইনের প্রতি আনুগত্য দেখায়। A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে ল্যাস্কি বলেছেন: “The experience of citizens, in other words, is the true maker of law. What they find true to that experience will have authority for them.” অর্থাৎ আইনের ফলাফলের অভিজ্ঞতাই হল আইনের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তি। ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে আইনের ফলাফলের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আইনের প্রতি আনুগত্যের দাবি বৈধতা লাভ করে। তিনি বলেছেন: “Law therefore, is a claim to obedience validated by the experience of its result.” জনগণের কল্যাণসাধনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কাজকর্মের উপর ব্যক্তির কাছ থেকে রাষ্ট্রের আনুগত্যের দাবি নির্ভরশীল। রাষ্ট্র বলেই রাষ্ট্র ব্যক্তির আনুগত্য দাবি করতে পারে না। রাষ্ট্র ব্যক্তির আনুগত্য লাভের অধিকারী তা রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হবে। এবং তখনই রাষ্ট্র ব্যক্তির আনুগত্য আদায় করতে পারে। ল্যাস্কি বলেছেন: “It ( State) wins his allegiance not by being the state, but because of what, as the State, it is seeking to do.” অর্থাৎ ল্যাস্কির কথায়, “Loyalty is won from us, it cannot be imposed upon us. It must grow spontaneously out of our experience.” জনসাধারণের স্বার্থ সাধনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সেবামূলক ভূমিকাই রাষ্ট্রকে জনগণের আনুগত্য আদায়ের অধিকারী হিসাবে প্রতিপন্ন করে। রাষ্ট্রকে যে ভাবেই হোক প্রমাণ করতে হয় রাষ্ট্রের আইনানুগ অনুজ্ঞাসমূহ জনগণের কার্যকর দাবি পূরণের জন্যই প্রণীত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় আইন কি রকম দাবি পূরণ করতে পারে তার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রীয় আইনের যথার্থতা নির্ধারিত হয়। নাগরিক জীবনে আইনের কার্যকারিতা ও ফলাফলের ভিত্তিতে আইনের ন্যায্যতা ও অন্যায্যতা নির্ধারিত হয়। নাগরিকরা তাদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে কোন আইনকে ন্যায্য বা সার্থক বলে স্বীকৃতি জানালে সংশ্লিষ্ট আইনটি ন্যায্য বলে গণ্য হয়। এ প্রসঙ্গে ল্যাঙ্কি বলেছেন: “Law, in short, as made, is inherently neutral, its just quality is contributed to it by those who receive it.” রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ন্যায্যতা ও বৈধতার মাত্রা নির্ভর করে একটি বিষয়ের উপর। বিষয়টি হল রাষ্ট্র নাগরিকদের কত বেশি পরিমাণ চাহিদার পরিতৃপ্তি সাধন করতে পারে। ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে, রাষ্ট্রের আনুগত্যের দাবি সর্বাধিক সামাজিক চাহিদা পূরণের ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “The State, so to say, acts always in an atmosphere of contingence.”

আনুগত্য প্রকাশের শর্ত: ল্যাস্কির মতানুসারে আইনের প্রতি আনুগত্য নিঃশর্ত নয়। এই আনুগত্য শর্তাধীন। এ ক্ষেত্রে ল্যাস্কি নাগরিকদের বিচার-বিবেচনার উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, নাগরিকরা যখন বুঝতে পারে যে রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে তাদের সুখ-সমৃদ্ধি সাধিত হয়, তখনই নির্দ্বিধায় নাগরিকরা আনুগত্য প্রকাশ করে। রাষ্ট্র তার কাজকর্ম এমনভাবে পরিচালনা করবে, যাতে নাগরিকদের পক্ষে অনুধাবন করতে অসুবিধা না হয় যে রাষ্ট্রীয় কল্যাণের সঙ্গে নাগরিকদের কল্যাণও সম্পর্কযুক্ত। রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের আনুগত্য প্রদর্শনের শর্ত হল, ‘রাষ্ট্রের লক্ষ্য যেন নাগরিকদের নির্ধারিত উদ্দেশ্য। সাধনের সহায়ক হয়। রাষ্ট্র সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। কিন্তু এই শক্তির প্রয়োগ নাগরিকদের সম্মতির উপর নির্ভরশীল। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও আইনের সামর্থ্যের উপর রাষ্ট্রের আনুগত্য লাভের দাবি নির্ভরশীল। নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্র কি করতে চায়, তার উপরই আনুগত্যের এই দাবি ভিত্তিশীল। তা না হলে কেবল রাষ্ট্র বলেই রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা হয় না। অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের শর্ত হল এই যে, রাষ্ট্র নাগরিকদের লক্ষ্যসমূহ পূরণ করে। আবার নাগরিকদের সম্মতির উপরই রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ নির্ভরশীল। An Introduction to Politics শীর্ষক গ্রন্থে ল্যাস্কি বলেছেন: “We give, that is to say, our allegiance to the state always upon the condition that its end, as a State, satisfies the end we set before ourselves. Its sovereignty is contingent upon our agreement to its exercise.”

আনুগত্য শর্তসাপেক্ষ: আইনের জন্যই আইন প্রণয়ন করা হয় না। আইন প্রণয়নের একটা উদ্দেশ্য থাকে। আইন প্রণয়নের প্রধান উদ্দেশ্য হল ব্যক্তির কল্যাণ সাধন। রাষ্ট্র নাগরিক জীবনের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যেই আইন প্রণয়ন করে। ল্যাস্কি বলেছেন: “The State maintains rules not for the sake of the rules, but for what they do to individual lives.” ব্যক্তির আনুগত্য প্রদর্শনের ক্ষেত্রে একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হল রাষ্ট্রীয় আইন জনগণের কল্যাণ সাধনে সমর্থ কিনা বা জনকল্যাণের ইচ্ছাযুক্ত কিনা। তবে রাষ্ট্রীয় আইন নাগরিককে সরাসরি সুখী করতে সক্ষম নয়। আবার সকল নাগরিককে রাষ্ট্র প্রয়োজনমত সুখী করতে পারে না। মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের স্বার্থে একটা অনুকূল পরিবেশের প্রয়োজন। আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্র এই পরিবেশটি গড়ে তোলার ব্যবস্থা করে, এবং এটাই হল রাষ্ট্রের মূল কর্তব্য। আবার মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আশা-আকাঙ্ক্ষা অশেষ। সুতরাং এক্ষেত্রে ব্যক্তিবর্গকে সন্তুষ্ট করা রাষ্ট্রের সাধ্যাতীত। তবে সার্থক সমাজজীবনের একটা ন্যূনতম মান আছে। রাষ্ট্র এই রকম এক সমাজজীবনের ভিত্তি প্রস্তুত করার চেষ্টা করে। ল্যাঙ্কি An Introduction to Politics নামক গ্রন্থে বলেছেন: “These, at least the State must secure to its members, if it is to count upon their continuous obedience, to its rules,” অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় আইন ও তার প্রয়োগ হল শর্তসাপেক্ষ। রাষ্ট্রীয় আইন বলতে এমন কোন নিয়ম -কানুনকে বোঝায় না, যা বাধ্যতামূলক ও শর্তহীনভাবে প্রযুক্ত হয়। ব্যক্তির আনুগত্য লাভের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দাবি তথা রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগ হল শর্তাধীন। আইনের প্রতি আনুগত্যের শর্ত হল এই যে, জনগণের কল্যাণ সাধনে আইন সক্ষম হবে। ল্যাস্কি বলেছেন: “…the Legal imperatives of any State must always be conceived, if they are to be capable of justification, in terms of the end it seeks to serve; they are so to say, a permanent essay in the conditional mood.” বস্তুত জনগণের কার্যকর চাহিদা পুরণের সামর্থ্যের উপর রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের যৌক্তিকতা নির্ভরশীল। জনগণের চাহিদা পূরণে রাষ্ট্র সক্ষম হলে, তাদের উপর ক্ষমতা প্রয়োগের বা তাদের আনুগত্য লাভের অধিকার রাষ্ট্র অর্জন করে। ‘রাষ্ট্রীয় আইন ব্যক্তির সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সহায়ক’—এই বোধ নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় আইন মান্য করে চলতে অনুপ্রাণিত করে। A Grammar of Politics গ্রন্থে ল্যাস্কি বলেছেন: “Law, therefore, is a claim to obedience validated by experience of its resluts.” তাঁর আরও অভিমত হল: “Law, therefore, to be found adequate must be built upon an induction from the widest possible experience it can know.”

আইনের বিরোধিতা করার অধিকার: অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ হল মানুষের স্বভাব। সাধারণত স্বতঃস্ফূর্তভাবে নাগরিকরা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। ল্যাস্কির মতানুসারে এই আনুগত্য প্রদর্শন হল মানব প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রবণতা। কিন্তু ল্যাস্কি রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইনের বিরোধিতার অধিকারের কথাও বলেছেন। রাষ্ট্র নাগরিকদের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হলে বিরোধিতার প্রশ্ন উঠে। নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ দাবি পূরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইন যদি ব্যর্থ হয় তা হলে রাষ্ট্র ও তার আইনের বিরোধিতা করা হয়। ল্যাস্কি তাঁর Authority in the Modern State শীর্ষক রচনায় বলেছেন: “Whenever in a state a group of persons large enough to make its presence felt, demands the recognition of certain claims; it will not recognise a law which attempts defiance of them, nor will it accept the authority by which the law is enforced.”

বিরোধিতার অধিকার বৈধ: সমাজের বিশেষ কোন শ্রেণী বা অংশের স্বার্থের সঙ্গে আইন সম্পর্কযুক্ত হলে আইনের বিরোধিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। রাষ্ট্রীয় আইন যাদের দাবিকে উপেক্ষা করে, তারাই এই অবস্থার পরিবর্তন সাধনের জন্য আইন অমান্য করতে উদ্যোগী হয় সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের যে অংশের চাহিদা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব পূরণ করতে অসমর্থ হয় তারা আইনের বিরোধিতার অধিকার বৈধভাবে প্রয়োগ করতে পারে। সমাজের প্রাধান্যকারী ব্যক্তিদের চাহিদার প্রতি রাষ্ট্রীয় আইন সংবেদনশীল হয়। যাদের দাবি পূরণে আইন ব্যর্থ হয়, তারাই আইনের বিরোধিতা করে। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইনের বিরোধিতা হল সর্বশেষ হাতিয়ার। সুতরাং এ রকম ক্ষেত্রে এই অস্ত্রের প্রয়োগের বৈধতাকে অস্বীকার করা যায় না। কারণ তখন বিকল্প কিছু থাকে না। প্রকৃত প্রস্তাবে অধ্যাপক ল্যাস্কি রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইনের বিরোধিতা করার বৈধ অধিকারকে স্বীকার করেছেন।

সংরক্ষিত ক্ষমতা: আইনের ন্যায্যতা বা যৌক্তিকতা বিচার-বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তি আনুগত্য প্রদর্শনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ব্যক্তির সমাজজীবনের ক্ষেত্রে আইনের ভূমিকার উপর আনুগত্যের সিদ্ধান্ত নির্ভরশীল। আইনের বিরোধিতা করার ক্ষমতা সাধারণত ব্যবহৃত হয় না। এ হল এক সংরক্ষিত ক্ষমতা। সমাজের একটি সংরক্ষিত ক্ষমতা হিসাবে আইন অমান্যের ক্ষমতাকে গণ্য করা হয়। যাদের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে তারা বৈধভাবে এই সংরক্ষিত ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। An Introduction to Politics শীর্ষক গ্রন্থে ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন: “The right to resist the law is the reserve power in society by which men whose demands are denied may legitimately seek to alter the balance of forces in the State.” রাষ্ট্র আনুগত্য দাবি করার জন্য এই যুক্তির অবতারণা করতে পারে যে, আইনের বিরোধিতা অরাজকতা ডেকে আনবে। এই যুক্তির সারবত্তাকে একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। এই কারণে ল্যাস্কি বলেছেন: “Registance ought always, from the cost it involves, to be a weapon of last instance.”

আনুগত্যের ভিত্তি সম্পর্কিত তত্ত্বের সমালোচনা: ব্যক্তির আনুগত্যের ভিত্তি সম্পর্কিত ল্যাস্কির অভিমত বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। এক্ষেত্রে সমালোচকরা ল্যাস্কির মতবাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত যুক্তিগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

  • (১) ল্যাস্কির মতবাদে রাষ্ট্রকে অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের সমপর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের আনুগত্য অর্জনের জন্য রাষ্ট্রকে সমাজের বিভিন্ন সংঘ-সংগঠনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সামিল হতে হবে।
  • (২) তত্ত্বগত ও আইনগত বিচারে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা হল চরম, চূড়ান্ত এবং অবাধ ও অসীম। কিন্তু ল্যাস্কির তত্ত্বে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে নিছক একটি আনুষ্ঠানিক বিষয় হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
  • (৩) ল্যাস্কি ন্যায়বিচার থেকে আলাদা করে রাষ্ট্রীয় আইনকে প্রতিপন্ন করেছেন। অর্থাৎ আইন ও ন্যায়বিচারের মধ্যে তিনি কোন স্বতঃসিদ্ধ সম্পর্কের কথা স্বীকার করেননি।
  • (৪) সর্বোপরি ল্যাস্কির আলোচ্য তত্ত্বে রাষ্ট্রীয় আইনের বিরোধিতার অধিকারের কথা বলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার পিছনে ইন্ধন যোগানো হয়েছে। সুতরাং এই মতবাদ বিপজ্জনক।

সমালোচনার জবাবে ল্যাস্কি: ল্যাস্কি উপরিউক্ত বিরূপ সমালোচনাসমূহের সারবত্তাকে স্বীকার করেননি। তিনি বহুত্ববাদী বক্তব্যের ভিত্তিতে বলেছেন যে মানবসমাজে রাষ্ট্র ছাড়াও আরও অনেক সংঘ-সংগঠন আছে। মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে এই সমস্ত সামাজিক সংগঠনের সহায়ক ভূমিকা বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সুতরাং ব্যক্তির আনুগত্য লাভের অধিকার এই সমস্ত সংগঠনেরও আছে। তা ছাড়া আইন ও ন্যায়-বিচারের মধ্যে পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যকে অস্বীকার করা যায় না। আইন মাত্রেই ন্যায়-বিচারসম্মত বলে বিবেচিত হতে পারে না। উদ্দেশ্য ও কার্যাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিকরা আইনকে ন্যায়-বিচারসম্মত বলে মেনে নিলে, আইন ন্যায়সঙ্গত বলে প্রতিপন্ন হবে। অন্যথায় নয়। আবার রাষ্ট্রের সকল আইন বা কার্যকলাপকেও সমর্থন করা যায় না। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা স্বীকার করতেই হবে। সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের দাবি-দাওয়া ও স্বার্থ বিভিন্ন এবং ক্ষেত্রবিশেষে পরস্পর-বিরোধীও হয়। সুতরাং তেমন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইনের বিরোধিতার অধিকারকেও অস্বীকার করা যায় না।

(২) নাগরিকদের অধিকার

অধিকারের ধারণা: উদ্দেশ্যের দ্বারাই রাষ্ট্রের কর্তব্য সীমাবদ্ধ থাকে। আবার প্রণীত আইনের মধ্যেই রাষ্ট্রের কর্তব্য বর্তমান থাকে। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিকে সুখী করা। এবং এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে। সুতরাং রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের উদ্দেশ্য হল ব্যক্তি জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা। এইভাবে রাষ্ট্র কর্তৃক স্থিরীকৃত উদ্দেশ্য ব্যক্তির কাছে অধিকার হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব হল নাগরিককে সুখী করা। নাগরিকের সুখ অধিকারের উপর নির্ভরশীল। এবং নাগরিকের সুখের সহায়ক পরিবেশই অধিকার হিসাবে বিবেচিত হয়। এই পরিবেশ সৃষ্টি ও সংরক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Every State is known by the rights it maintains.” ব্যক্তির সকল সুখ-সুবিধার ব্যবস্থা রাষ্ট্র করতে পারে না। তবে সকলের সুখের স্বার্থে সাধারণভাবে কতকগুলি সুযোগ-সুবিধা প্রত্যেকের জন্যই প্রয়োজন। অধিকার ছাড়া ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশ বা আত্মোপলব্ধি অসম্ভব। অধিকার হল সমাজজীবনের সেই সমস্ত শর্তাদি যেগুলির অনুপস্থিতিতে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ অসম্ভব। ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics গ্রন্থে বলেছেন “Rights, in fact, are those conditions of social life without which no man can seek, in general, to be himself at his best.” ব্যক্তির সুখ-সুবিধার জন্য অধিকারের অনুশীলন আবশ্যক এবং রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে অধিকার অনুশীলনের সুযোগ নাগরিক লাভ করে থাকে। আবার অধিকার হল রাষ্ট্রীয় নির্দেশের প্রতি নাগরিকের আনুগত্যের শর্ত। এবং এই বিচারেও অধিকারের স্বীকৃতি আবশ্যক। তা ছাড়া অধিকারের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে আর একটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। ব্যক্তিজীবনকে পরিপূর্ণতা প্রদানের জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকা এককভাবে যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র বৃহৎ সমাজের ভূমিকাকে উপেক্ষা করতে পারে না। বৃহৎ সমাজে রাষ্ট্র কোন একক প্রতিষ্ঠান নয়; এ হল অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান। তাই বৃহৎ সমাজের ভূমিকার উপর গুরুত্ব আরোপ না করে উপায় নেই। এবং এদিক থেকেও অধিকারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। বস্তুত অধিকার কেবল ব্যক্তিগত সুখের নয়, সামাজিক মঙ্গলেরও শর্ত। প্রকৃত প্রস্তাবে ল্যাস্কির রাজনীতিক দর্শনের অন্যতম ভিত্তি হল তার অধিকারের তত্ত্ব।

অধিকারের প্রকৃতি: ল্যাস্কি অধিকারের প্রকৃতি প্রসঙ্গেও আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে অধিকারের ধারণা স্থান ও কালের আপেক্ষিক, স্থিতিশীল নয়। দেশ ও কাল নির্বিশেষে অধিকার অনড় বা অচল নয়। সুতরাং অধিকারের ধারণাটিকে স্থান ও সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আপেক্ষিক অর্থে বিচার-বিবেচনা করা দরকার। দেশ ও কাল ভেদে অধিকার সম্পর্কিত ধারণার পরিবর্তন ঘটে। আগে কোন দিন যা অধিকার হিসাবে বিবেচিত হত না, এখন তা অধিকার হিসাবে গণ্য হতে পারে। অনুরূপভাবে এক দেশে যা অধিকার নয়, অন্য দেশে তা অধিকার হতে পারে। তা ছাড়া অধিকারের প্রকৃতি প্রসঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে, রাষ্ট্র কর্তৃক অধিকার স্বীকৃত হওয়া দরকার। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে অধিকার স্বীকার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। তা না হলে অধিকারকে কার্যকর করা যায় না। আবার অধিকারের ধারণার সঙ্গে আনুগত্যের বিষয়টিও ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। রাষ্ট্রীয় আইন অধিকার স্বীকার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। তাই ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। কারণ অধিকার ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও আত্মোপলব্ধিতে সাহায্য করে। তাই অধিকারের স্রষ্টা ও সংরক্ষক হিসাবে রাষ্ট্র আনুগত্য অর্জনের অধিকারী।

ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার: ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশ, আত্মোপলব্ধি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের স্বার্থে অধিকারের অস্তিত্ব অপরিহার্য। ল্যাস্কি এ প্রসঙ্গে কতকগুলি অধিকারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। নিরাপত্তার অধিকারের উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার হল স্বচ্ছন্দ জীবন-যাপনের প্রধান শর্ত। এই শর্ত পূরণ করা না গেলে নাগরিকের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের নিশ্চয়তা বিপন্ন হয়ে পড়তে বাধ্য। নিরাপত্তার অধিকারের প্রকারভেদ আছে। বিভিন্ন সুযোগ বা দাবি এই অধিকারের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয়। যে সমস্ত অধিকার নিরাপত্তার অধিকারের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হয় সেগুলি হল: আক্রমণের হাত থেকে নিজের সুরক্ষার অধিকার, কাজের ও ন্যায্য পারিশ্রমিক লাভের অধিকার, অমানবিক পরিশ্রমের চাপ থেকে নিষ্কৃতি লাভের অধিকার, অবকাশ যাপনের অধিকার, সভ্য জীবন-যাপনের অধিকার প্রভৃতি। কর্মের অধিকার প্রসঙ্গে ল্যাস্কি বলেছেন: “(A man) is born into a world where if rationally organised, he can live only by the sweat of his brow. Performance of function is implicit in the nature of social life.” অবসর বিনোদনের অধিকার সম্পর্কে ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন : “The right to leisure, therefore, is one of the legal imperatives upon which a well-ordered State must insist.” উপরিউক্ত অধিকারগুলি ব্যক্তিকে নিরাপত্তাহীনতার নিরন্তর আশঙ্কা থেকে মুক্তি দেয়; উদ্বেগহীন সুখী ও স্বচ্ছন্দ সমাজজীবন সম্ভব করে তোলে।

শিক্ষার অধিকার: ল্যাস্কি শিক্ষার অধিকারের উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য শিক্ষার অধিকার একান্তভাবে অপরিহার্য। আত্মোপলব্ধির ক্ষেত্রে এই অধিকারটি হল ব্যক্তির কাছে একটি বড় অস্ত্র। বৃহৎ সমাজে রাষ্ট্রের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা অনুধাবন, আত্মশক্তির বিকাশ, স্বীয় অভিজ্ঞতার বিচার-বিশ্লেষণ প্রভৃতির স্বার্থে নাগরিকের শিক্ষার অধিকার অনস্বীকার্য। সুস্থ সমাজজীবনের স্বার্থে শিক্ষিত নাগরিক একান্তভাবে দরকার। কারণ সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সহযোগিতামূলক ও সম্মানজনক সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার এবং তার জন্য মনোভাবের সঠিক পারস্পরিক আদান-প্রদান আবশ্যক। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকা দরকার। এই জ্ঞান অর্জনের জন্য আবশ্যক হল শিক্ষার অধিকার। বস্তুত সভ্য সমাজজীবনকে সম্ভব করে তোলার জন্য নাগরিকদের দিক থেকে ব্যাপক ইতিবাচক ভূমিকা আবশ্যক। প্রয়োজনীয় শিক্ষা-দীক্ষা ছাড়া ব্যক্তির পক্ষে এই ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয় না। অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে অশিক্ষিত ব্যক্তি হল অজ্ঞ এবং আধুনিক জটিল সমাজব্যবস্থায় অন্ধের মত। তিনি তাঁর An Introduction to Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “The uneducated man amid the complexities of the modern civilisation is like a blind man….” রাষ্ট্র যদি ব্যক্তিকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তা হলে ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ থেকে ব্যক্তি বঞ্চিত হয়। এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কির অভিমত হল: “…the State which denies education to its citizens deines them the means of realizing their personality.”

মত প্রকাশের এবং সংঘ সমিতি গঠনের অধিকার: ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার এবং শিক্ষার অধিকার ছাড়াও ল্যাস্কি মত প্রকাশের অধিকার, সংঘ-সমিতি সংগঠনের অধিকার, সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রভৃতি অন্যান্য অধিকারেরও উল্লেখ করেছেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বার্থে সর্বজনীন ভোটাধিকারের স্বীকৃতি অপরিহার্য। এই অধিকারের স্বীকৃতি ছাড়া নাগরিক স্বাধীনভাবে সরকার গঠন বা সরকার পরিস্তনের সুযোগ পায় না। অথচ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বাস্তবায়নের জন্য এই সুযোগ থাকা দরকার। তা ছাড়া শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জিত হয়। এই অর্জিত জ্ঞান ব্যবহারের সুযোগ থাকা দরকার। তা না হলে শিক্ষার অধিকার অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। আবার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাফল্যের স্বার্থে সুস্থ ও সুগঠিত জনমত একান্তভাবে প্রয়োজন। এবং জনমত গঠন ও প্রকাশের জন্য দরকার বাক্য ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংঘ ও সমিতি গঠনের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে ল্যাস্কি সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: “The limits of freedom are always set by the imminence of a threat to social peace. Where there is no such urgency, interference by the State is a denial of right.” মত প্রকাশের স্বাধীনতার গুরুত্ব সম্পর্কে ল্যাস্কির অভিমত হল: “To allow a man to say what he thinks, is to give his personality the only ultimate channel of full expression and his citizenship the only means of moral adequacy.”

ধর্মীয় স্বাধীনতার ও বিচার বিভাগীয় সংরক্ষণের অধিকার: ল্যাস্কি ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন। প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীনভাবে নিজের খুশীমত ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার আচরণের সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। জনসাধারণের স্বার্থের বিরোধী না হলে ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারে হস্তক্ষেপ করা রাষ্ট্রের দিক থেকে উচিত হবে না। তা ছাড়া তিনি বিচার বিভাগীয় সংরক্ষণের অধিকারের কথাও উল্লেখ করেছেন। নাগরিকের বিচার বিভাগীয় সংরক্ষণ লাভের অধিকার থাকা আবশ্যক। এই অধিকারের অস্তিত্ব ব্যতিরেকে অন্যান্য অধিকারগুলি সংরক্ষণহীন হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কির অভিমত হল: “No State can be free unless its courts are accessible and swift and certain.”

বিরোধিতার অধিকার: ল্যাস্কি আইনের বিরোধিতা করার অধিকারের কথাও বলেছেন। এবং অন্যতম গণতান্ত্রিক অধিকার হিসাবে বিরোধিতা করার অধিকারের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে, বিরোধিতা করার অধিকার থেকে যদি ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা হয় তা হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে; গণতন্ত্রের আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। প্রকৃত প্রস্তাবে আলোচ্য অধিকারটির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করার মাধ্যমে ল্যাস্কি গণতান্ত্রিক অধিকারের সম্পূর্ণ ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করেছেন।

অধিকার অবাধ নয়: ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে কোন অধিকারই অবাধ নয়। তিনি ব্যক্তির আত্মোপলব্ধি ও সুখ-সমৃদ্ধির স্বার্থে অধিকারের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন, কিন্তু অধিকারকে অবাধ বলে গণ্য করেননি। অধিকার সীমাহীন হতে পারে না। রাষ্ট্রের কাছে বৃহৎ সমাজের স্বার্থ ও শান্তি হল বড়। এই বৃহৎ সমাজের স্বার্থ-শান্তি বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হলে রাষ্ট্র চুপচাপ থাকতে পারে না। এ রকম ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হয়। শান্তি-শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে কাজ করলে রাষ্ট্র ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সমষ্টির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। রাষ্ট্রকে বৃহৎ সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। বৃহৎ সমাজের স্বার্থ ও শান্তি বিঘ্নিত হলে রাষ্ট্র নীরব থাকতে পারে না। সামাজিক শান্তি সংরক্ষণের স্বার্থে রাষ্ট্র প্রয়োজনবোধে অধিকার বা স্বাধীনতার উপর বাধা-নিষেধ আরোপ করতে পারে। সামাজিক শান্তির প্রতিকূল পরিস্থিতি ছাড়া ব্যক্তির কাজকর্ম বা অধিকারে রাষ্ট্র যদি হস্তক্ষেপ করে, তা হলে অধিকারের অস্বীকৃতি বলে বিবেচিত হবে। এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কির অভিমত হল: “The limits of State are always set by the imminence of a threat to social peace. Where there is no such urgency interference by the State is a denial of right.”

সুযোগের সমবণ্টন: সমাজের কোন বিশেষ অংশের অনুকূলে রাষ্ট্রীয় আইন কোন বিশেষ বা বৈষম্যমূলক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করবে না। তা করা হলে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা অর্থাৎ বৈষম্যমূলক আচরণ রাষ্ট্রীয় লক্ষ্যকেই ব্যাহত করে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য সুযোগ-সুবিধার সমবণ্টন অত্যন্ত জরুরী। নিজের রাজ্যক্ষেত্রের মধ্যে রাষ্ট্র ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সুযোগ-সুবিধার সমবণ্টনের ব্যবস্থা করবে। এ ক্ষেত্রে কোন রকম পক্ষপাতমূলক আচরণ করবে না। আইনানুগ অনুজ্ঞা (legal imperative)-র মাধ্যমে রাষ্ট্র নাগরিকদের মধ্যে সুযোগ-সুবিধার সমবণ্টনের ব্যবস্থা করে। তবে বৃহৎ সমাজের সামগ্রিক স্বার্থে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এ রকম ক্ষেত্রে বাড়তি সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা বা বৈষম্যমূলক আচরণ ন্যায়সঙ্গত বলে বিবেচিত হবে। সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য বৃহৎ সমাজের সাধারণ কল্যাণের স্বার্থে হওয়া চাই। এবং রাষ্ট্রকে তা প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অকারণে বা অসঙ্গতভাবে আইনানুগ অনুজ্ঞা যদি সুযোগ দানের ক্ষেত্রে পৃথকাচরণ করে তা হলে সমাজের পক্ষে তা অনিষ্টকর হবে। এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কি তাঁর An Introduction to Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Any system of legal imperatives which results in differential advantage to somebody of citizens is an invasion of the purpose of the State, a denial of its end, unless it can be shown that there is a direct and usual relation between such differential advantages and the well-being of the society as a whole.”

ধনবৈষম্যমূলক সমাজে সমবণ্টনের নীতি অচল: ধনবৈষম্যমূলক সমাজে সুযোগের সমবণ্টনের নীতি অর্থহীন হয়ে পড়ে। যে সমাজ ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত সেখানে সুযোগের সমবণ্টনের নীতিকে বাস্তবে রূপায়িত করা অসম্ভব। অর্থাৎ শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সুযোগের সমবণ্টনের ব্যবস্থা হল এক অসম্ভব পরিকল্পনা। সমাজ ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে বিভক্ত থাকলে ধনীরাই সকল সুযোগ-সুবিধার সিংহভাগ ভোগ দখল করে। কারণ ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রয়োগ করে সকল ক্ষেত্রে বণ্টনযোগ্য সুযোগ-সুবিধাকে তারা করায়ত্ত করে। এ রকম ক্ষেত্রে ধনিক শ্রেণীর স্বার্থেই রাষ্ট্রীয় আইন কাজ করে। এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কির অভিমত হল: “The division of society into rich and poor makes the legal imperatives of the state work to the advantage of the rich.”

সাম্যের প্রতিষ্ঠা আবশ্যক: যে সমাজে ধনী ও দরিদ্র মূলত এই দুটি শ্রেণী বর্তমান, সেই সমাজ ধনীদের স্বার্থে ধনীদের দ্বারাই শাসিত হয়। এ ধরনের সমাজ হল যাবতীয় অনৈক্য ও অকল্যাণের উৎস। ধনবৈষম্যমূলক সমাজে অধিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অভাব-অনটন বা দারিদ্র্যের মধ্যে নিমজ্জিত থাকে। রাষ্ট্রীয় আইন তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। সমাজের যে অংশ দরিদ্র তারা রাষ্ট্রীয় আইনের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। এই দরিদ্র শ্রেণীর কাছে রাষ্ট্রের আইনানুগ অনুজ্ঞা অর্থহীন বলে প্রতিপন্ন হয়। এইভাবে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দারিদ্র্যের মধ্যে থাকলে রাষ্ট্রের লক্ষ্য পূরণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে যদি ব্যাপক বৈষয়িক তারতম্য থাকে, তা হলে রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে না। তিনি বলেছেন: “…the end of the State cannot be realised where the power to make the demand effective is seriously different among its members and such differences is a matter of economic arrangement.” বৃহৎ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বৈষয়িক সুবিধার তারতম্য থাকলে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইন বিত্তবানদের স্বার্থ রক্ষা করে এবং রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য বিকৃত হয়ে পড়ে। নাগরিকদের মধ্যে পৃথকাচরণ বা সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে দুস্তর বৈষয়িক তারতম্য থেকে নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে থাকে। একটি জাতি ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়লে গৃহবিবাদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। ল্যাস্কি বলেছেন: “A nation divided into rich and poor is a house divided against itself.” এ রকম পরিস্থিতি যে-কোন জাতির পক্ষে অভিশাপস্বরূপ। এর থেকে নিষ্কৃতির ব্যবস্থা করা দরকার। তারজন্য ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য দূর করা আবশ্যক। সাম্যের প্রতি আকাঙ্ক্ষা মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি হিসাবে পরিচিত। এই কারণে বৈষম্য প্রতিরোধের ব্যাপারে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে এক স্বাভাবিক প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। নিজের স্থায়িত্ব সংরক্ষণের স্বার্থে অসাম্য দূর করে সাম্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে হবে। অসাম্যের অবসান এবং সাম্যের প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব বিপন্ন হয়ে পড়তে বাধ্য।

সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বৈষয়িক তারতম্যের পরিপূর্ণ অবসান একরকম অসম্ভব। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে যাবতীয় বৈষম্যের বিলুপ্তি সহজে সম্ভব নয়। তবে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রকে ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তা হলে নাগরিকদের মধ্যে সামাজিক অবস্থানগত বৈষয়িক তারতম্য হ্রাস করা সম্ভব হবে। রাষ্ট্রকে তার কাজকর্মের দ্বারা প্রমাণ করতে হবে যে তার লক্ষ্য হল নাগরিকদের মধ্যে ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

রাষ্ট্র কর্তৃক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা: বিশেষ একটি ন্যায়-বিচারের ধারণার উপর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর রাষ্ট্রনৈতিক দর্শন অনুসারে ন্যায়-বিচারের ধারণার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সম্পত্তির ব্যবস্থার সুরক্ষাকে সুনিশ্চিত করা। এ হল বুর্জোয়া রাষ্ট্রনৈতিক দর্শন অনুযায়ী ন্যায়-বিচারের ধারণা। এই কারণে সমসাময়িক রাষ্ট্র ছিল মূলত পুলিশী রাষ্ট্র। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। নতুন আর্থনীতিক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তার ফলে রাষ্ট্রীয় আইনানুগ অনুজ্ঞার প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটেছে। অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে বর্তমানে সামাজিক ন্যায়বিচার ও আইনের পরিধি বিস্তৃততর হয়েছে। তাঁর মতানুসারে এই রাষ্ট্র ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্যকে যথাসম্ভব বিলুপ্ত করে সমাজে সংঘাতের সম্ভাবনাকে দূর করতে এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তুলতে কাজ করে চলেছে। এই রাষ্ট্র হল জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র। তবে ল্যাস্কির অভিমত অনুযায়ী এমন কথা বলা যায় না যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্রমবিবর্তনের পথে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। এর কারণ হল সমাজের ক্ষমতাসীন অংশ আইনানুগ অনুজ্ঞাকে নিজেদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এই ক্ষমতাসীন শ্রেণী কখনই সহজে ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। তার ফলে রাজনীতিক ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটে থাকে।

(৩) সমাজের যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতি

বিগত শতাব্দী পর্যন্ত পুলিশী রাষ্ট্রের ধারণা প্রচলিত ছিল। রাষ্ট্রের কাজকর্মের পরিধি ছিল অতিমাত্রায় সীমাবদ্ধ। বর্তমানে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি বিশেষভাবে প্রসারিত। এই বিশাল দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা রাষ্ট্রের একার পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। বর্তমানে সামাজিক জীবনের পরিধি বিশাল ও ব্যাপক। সবকিছু এককভাবে পরিচালনা করা রাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব। এই অবস্থায় বৃহৎ সমাজের কতকগুলি দায়িত্ব সামাজিক সংঘগুলিকে সম্পাদন করতে হয়। সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের দাবি-দাওয়া বহু ও বিভিন্ন। আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনীতিক প্রভৃতি বিভিন্ন রকমের দাবি বা অভাব-অভিযোগ মানুষের থাকে। এইসবের পরিতৃপ্তির জন্য মানুষ একাধিক সামাজিক সংঘ-সমিতির সদস্য হয়। পেশাগত স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য মানুষ পেশাগত সংঘ-সমিতির সদস্য হয়। সমাজে এ রকম অনেক পেশাগত সংগঠন আছে। যেমন, শিক্ষক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, মালিক সংগঠন, কৃষক সংগঠন প্রভৃতি। এইভাবে সমাজে ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনীতিক প্রভৃতি সংঘ-সংগঠনের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি সামাজিক সংগঠনের স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আছে। এবং ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিটি সংগঠনের সহায়ক ভূমিকার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। বস্তুত মানবসমাজের প্রকৃতি হল জটিল। এবং প্রকৃতিগত বিচারে এই সমাজ বহুত্ববাদী। ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Society as a complex whole is pluralistic. “

সামাজিক সংঘের অস্তিত্ব: অধুনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সামাজিক সংগঠনের সংখ্যা যত বেশি হবে, সংগঠনগুলি যত বেশি বিচিত্র প্রকৃতির হবে, নাগরিকদের অভাব-অভিযোগ পরিপূরিত হওয়ার সম্ভাবনা তত বৃদ্ধি পাবে। সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের বিভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ও পরিতৃপ্তি ঘটে এই সমস্ত সামাজিক সংঘের মাধ্যমে। নাগরিক জীবনের বহুবিধ অভাব সামাজিক সংঘগুলি পূরণ করে। তাই বৃহৎ সমাজে এদের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য।

এককভাবে রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা এখন জনকল্যাণ-বিরোধী বলে বিবেচিত হয়। তাই বহুত্ববাদীদের মত ল্যাস্কি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতানুসারে বৃহৎ সমাজের এই সমস্ত অংশের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক ও সুস্থ হওয়া দরকার। এবং এইজন্য রাষ্ট্রের আইনানুগ অনুজ্ঞাগুলি বিশেষভাবে আনুষ্ঠানিক হওয়া আবশ্যক। এই আনুষ্ঠানিকতা অধিক হলে নাগরিক জীবনের কল্যাণের সম্ভাবনা তত বৃদ্ধি পাবে। তবে বৃহৎ সমাজে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণই শেষ কথা নয়। ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে রাষ্ট্র ও সামাজিক সংঘসমূহের মধ্যে সৃজনশীল সম্পর্ক গড়ে ওঠা দরকার।

বহুত্ববাদী ল্যাস্কি: বৃহৎ সমাজে রাষ্ট্র এক ও অদ্বিতীয় সংগঠন নয়। সমাজের যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতি আলোচনার প্রাক্কালে ল্যাস্কি ভাববাদী দার্শনিকদের চিন্তাধারাকে অনুসরণ করেননি। আবার তিনি একত্ববাদীদের বক্তব্যকেও সমর্থন করেননি। উদারনীতিক চিন্তাধারার দ্বারা ল্যাস্কির রাজনীতিক দর্শন বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছে। তবে ল্যাস্কির চিন্তাধারার উপর বহুত্ববাদী ভাবধারার প্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ল্যাস্কিকে কিন্তু গোঁড়া বহুত্ববাদী বলা যাবে না। ল্যাস্কির উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রের অপ্রতিরোধ্য আধিপত্যের ও চরম কর্তৃত্বের বিরোধিতা করা। রাষ্ট্রের একক সার্বভৌমত্বকে তিনি স্বীকার করেননি। রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের অনন্য ও অখণ্ড আনুগত্যকেও মেনে নেননি। ল্যাস্কি বহুত্ববাদীদের মত বৃহৎ সমাজে স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনগুলির অস্তিত্বের উপর জোর দিয়েছেন। মানুষের সমাজজীবনে এই সমস্ত সংঘ-সংগঠনগুলির ভূমিকার তাৎপর্যের কথা তিনি গুরুত্বসহকারে ব্যাখ্যা করেছেন।

সরকার হল অছি: নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমত অনুসারে নাগরিকরা সরকারের কার্যাবলী ও আইনানুগ অনুজ্ঞাসমূহের ন্যায্যতা বিচার-বিবেচনা করে দেখে। এই সমস্ত অনুজ্ঞার লক্ষ্য ও ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করার এবং প্রয়োজনে আন্দোলন করার সুযোগ নাগরিকদের আছে। বস্তুত সরকারের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব নাগরিকদের এই আলোচনা ও আন্দোলনের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ সরকারের কাছ থেকে যারা সুযোগ-সুবিধার প্রত্যাশী তাদের মনোভাব ও ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর সরকারের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব নির্ভরশীল। এই কারণে ল্যাস্কির মতে সরকার হল একটি অছি (Trust)। সরকারকে অছি হিসাবে অভিহিত করে ল্যাস্কি সমস্ত বিষয়ের চূড়ান্ত নির্ধারক হিসাবে নাগরিকদের ইচ্ছার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং সরকারী ক্ষমতার স্বৈরাচারের পথ রুদ্ধ করেছেন।

সংঘ-সমিতির সৃষ্টি: এই বৃহৎ সমাজে নাগরিকদের বক্তব্যকে বলবৎ করার জন্য সংঘ-সমিতি গঠন করতেই হয়। এ ছাড়া কোন উপায় থাকে না। কারণ ব্যক্তিগত উদ্যোগ আয়োজনের মাধ্যমে প্রয়োজন পূরণ করা যায় না। আধুনিক অধিকাংশ রাষ্ট্রই হল বৃহদায়তনবিশিষ্ট। আধুনিক এই বৃহৎ রাষ্ট্রে বিচ্ছিন্ন বা এককভাবে ব্যক্তিমাত্রেই অত্যন্ত অসহায়। তার কথায় কেউ কর্ণপাত করে না। এই অবস্থায় কোন একজন নাগরিকের চেঁচামেচি বাস্তবে অরণ্যরোদনে পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন: “The very size of the modern State makes the individual citizen a voice crying in the wilderness.” এককভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাই বিচ্ছিন্নভাবে অসহায় ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন সংঘ-সমিতিতে নিজেদের সংগঠিত করে। নিজেদের দাবি-দাওয়াকে ফলপ্রসূ বা কার্যকর করার জন্য ব্যক্তি অন্যের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হতে চায় এবং হয়। এইভাবে বৃহৎ সমাজে বহু ও বিভিন্ন সংঘ সমিতির সৃষ্টি হয়। এই কারণে সামাজিক সংঘ-সমিতিগুলির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে।

সংঘ-জীবনের প্রয়োজনীয়তা: তা ছাড়া মানুষ হল সমাজবদ্ধ জীব। সংঘবদ্ধ জীবন-যাপনের প্রবণতা মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই বর্তমান। কেবল রাষ্ট্রের মধ্যেই মানুষের এই প্রবণতা নিঃশেষ হয়ে যায় না। A Grammar of Politics গ্রন্থে ল্যাস্কি বলেছেন: “The State does not exhaust the associative impulse of the individuals.” মানুষের বৃহত্তর সমাজজীবনে অন্যান্য সংঘ-সংগঠনেরও যে প্রয়োজন আছে তা অস্বীকার করা যায় না। সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গ তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের সুযোগ-সুবিধা সামাজিক গোষ্ঠীসমূহের কাছ থেকে পায় এবং সামাজিক গোষ্ঠীসমূহের মাধ্যমেই মানুষ তার লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার পথে অগ্রসর হয়। এই কারণে নাগরিক একই সঙ্গে বহু ও বিভিন্ন গোষ্ঠী বা সংঘের সদস্য হয়। সামাজিক গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই সম্পর্ক রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কের থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই কারণে এই সমস্ত সামাজিক সংঘ-সংগঠনকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের কথা ভাবা যায় না। বস্তুত ব্যক্তি জীবনে রাষ্ট্রের মতই সামাজিক গোষ্ঠী বা সংঘগুলি হল বাস্তব সত্য। তাই ল্যাস্কি বলেছেন: “The group is real in the sense that state in real.”

সংঘের অস্তিত্ব ও ব্যক্তিত্ব: ল্যাস্কি ব্যক্তির মত সামাজিক সংঘের অস্তিত্ব ও ব্যক্তিত্বের কথা বলেছেন। এই সামাজিক সংঘের অস্তিত্ব ও ব্যক্তিত্ব সংঘের সদস্যদের কার্যাবলীর মাধ্যমে প্রতিপন্ন হয়। ব্যক্তিবর্গের বিচ্ছিন্ন কাজকর্মকে সংঘ এক ঐক্যবদ্ধ আচরণের ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করে। প্রত্যেক সামাজিক সংঘ তার সদস্যদের সুনির্দিষ্ট প্রকৃতির আচরণ-পদ্ধতির সঙ্গে সংযুক্ত করে। এই রকম নির্দিষ্ট ধরনের আচরণ পদ্ধতিতে সংঘের ব্যক্তিত্ব পরিণত হয়। এবং এদিক থেকে বিচার করলেই সামাজিক সংঘের স্বতন্ত্র সত্তা ও ব্যক্তিত্বের কথা বোঝা যায়। বিশেষ একটি প্রক্রিয়া বা সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক গোষ্ঠীর বিশেষ সত্তা বা ব্যক্তিত্ব প্রতীয়মান হয়। A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে ল্যাস্কি বলেছেন যে, সদস্যরা তাদের সংঘের মাধ্যমেই সন্তোষজনক কাজকর্মের সুযোগ-সুবিধা লাভ করে থাকে। ব্যক্তি সামাজিক সংঘের মধ্যেই তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে অপরের অভিজ্ঞতার সমন্বয় সাধন করতে পারে। এবং এইভাবে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের সম্মুখে উন্নতমানের কাজকর্মের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

গোষ্ঠী রাষ্ট্রের দয়ার উপর নির্ভরশীল নয়: সামাজিক সংঘ বা গোষ্ঠীগুলি ব্যক্তির খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশ, স্বার্থের সংরক্ষণ, অভাব-অভিযোগের পরিতৃপ্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে সামাজিক গোষ্ঠীগুলি তৎপরতার সঙ্গে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে থাকে। সুতরাং ব্যক্তির দাবি-দাওয়া পূরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের থেকে এই গোষ্ঠীগুলির ভূমিকা অধিকতর অর্থবহ বলে প্রতিপন্ন হয়। এই কারণে ব্যক্তিজীবনে এদের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম এবং এদের অস্তিত্ব রাষ্ট্রের দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভরশীল নয়। ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “The authority of any group is based upon the living and spontaneous trust it can command.”

গোষ্ঠীগুলির গুরুত্ব: ল্যাস্কির অভিমত হল মানুষের রাজনীতিক জীবনই সব নয়। মানবজীবনের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি অন্যান্য দিকও আছে এবং এগুলির গুরুত্বও কম নয়। রাষ্ট্রকে তা স্বীকার করতে হবে। রাষ্ট্রের এলাকার মধ্যে বহু ও বিভিন্ন সংঘ-সমিতি গঠনের সুযোগ থাকা দরকার। এবং ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ আবশ্যক। তা হলে প্রশাসনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নাগরিকের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে এবং প্রশাসনিক বিভিন্ন পর্যায়ে নাগরিকদের বক্তব্য পৌঁছে দেওয়ার সুযোগও বাড়বে। এর ফলে নাগরিকদের নির্লিপ্ততার অভিশাপ কাটিয়ে ওঠা যাবে। নাগরিকদের দায়িত্ববোধ বাড়বে। তাদের মতামত উপেক্ষিত হবে না। এই সব কিছুর ফলে সহজ ও স্বচ্ছন্দভাবে রাষ্ট্রীয় আইন কার্যকর হবে এবং অর্থবহ হয়ে উঠবে।

রাষ্ট্র ও সামাজিক গোষ্ঠীর পাশাপাশি অবস্থান: ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে সমাজ গঠিত হয় বিভিন্ন সংঘ-সমিতিকে নিয়ে। এগুলি গড়ে উঠে সামাজিক পরিবেশের দাবি অনুসারে এবং এগুলি নিয়ন্ত্রিত হয়। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির চাপে। ল্যাস্কির মতানুসারে এই সামাজিক সংঘগুলি প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে যাতে সমাজজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তার সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। তিনি এই সমস্ত সংঘের সমান গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন। এই সমস্ত সামাজিক সংঘ-সমিতির মত রাষ্ট্রও হল একটি সমিতি। শ্রমিক সংঘ, চার্চ, প্রভৃতির মত রাষ্ট্রও হল একটি সংগঠন। ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন : “It (state) is an association like others, churches, Trade Unions and the rest.” অন্যান্য সমিতির মত এরও বিশেষ উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী আছে। ব্যক্তি জীবনের যাবতীয় দাবি-দাওয়ার পরিতৃপ্তি সাধন রাষ্ট্রের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই রাষ্ট্র এবং এই সমস্ত সমিতি পাশাপাশি অবস্থান করে। এ বিষয়টি রাষ্ট্রকে মেনে নিতে হয়। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জন্য আইনানুগ অনুজ্ঞা প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে। সামাজিক সংঘগুলিও তাদের সদস্যদের জন্য তাই করে। ল্যাস্কির মতানুসারে সামাজিক সংঘগুলির অনুজ্ঞাসমূহের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। কারণ রাষ্ট্রীয় অনুজ্ঞাগুলির মাধ্যমে ব্যক্তিজীবনের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করা যায় না। উভয় ধরনের অনুজ্ঞার মধ্যে সৃজনশীল সম্পর্ক সৃষ্টি করা দরকার। ল্যাস্কির মতে এই সম্পর্ক সৃষ্টির দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই সম্পাদন করতে হবে।

সমাজের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ল্যাস্কি সমাজকে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সঙ্গে তিনি সমাজের প্রকৃতিকে তুলনা করেছেন। ল্যাস্কির অভিমত হল যে-কোন সমাজের প্রকৃতি যথাযথভাবে পর্যালোচনা করতে গেলে বোঝা দরকার যে, সমাজের প্রকৃতি হল মূলত যুক্তরাষ্ট্রীয়। তিনি তাঁর A Grammar of Politics গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “…it is integral to the proper understanding of any given society that it should be regarded as essentially federal in nature.” যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হল অধিকার অর্জন ও স্বাধীনতা ভোগের সহায়ক ব্যবস্থা। এই সমাজের কাঠামোও হল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মত। কারণ সমাজ গঠিত হয় বহু ও বিভিন্ন সংঘ-সমিতিকে নিয়ে। এই সংঘ-সমিতিগুলি স্বাতন্ত্র্যসম্পন্ন। সমাজে এগুলির অবস্থান স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীন। স্বাধীনভাবেই সামাজিক সংঘগুলি যে যার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য উদ্যোগী হয়। ল্যাস্কির মতানুসারে রাষ্ট্র এককভাবে নাগরিকদের আনুগত্য দাবি করতে পারে না এবং রাষ্ট্র এককভাবে সার্বভৌম, ক্ষমতার অধিকারী নয়। এ ক্ষেত্রে সামাজিক সংঘ-সমিতিগুলির দাবিকে রাষ্ট্রকে স্বীকার করে নিতে হবে। এই সমস্ত কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত হল, সকল সমাজের প্রকৃতিই হল যুক্তরাষ্ট্রীয়। আইনের আনুষ্ঠানিক দিকটির কথা বাদ দিলে, রাষ্ট্র এবং অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের মর্যাদা অভিন্ন। রাষ্ট্রের স্থান সামাজিক সংগঠনের ঊর্ধ্বে নয়। An Introduction to Politics গ্রন্থে ল্যাস্কি বলেছেন: “It follows from this that any society, at bottom is essentially federal in nature. The State is, formal law apart, one with other associations and not over and above them. Its legal imperatives succeed by being in creative relationship with those which other associations lay down for their members.”

রাষ্ট্র ও সামাজিক সংঘের মধ্যে পার্থক্য

ল্যাস্কির রাজনীতিক চিন্তাধারার উপর বহুত্ববাদী ভাবধারার প্রভাব অনস্বীকার্য। কিন্তু তিনি একেবারে গোঁড়া বহুত্ববাদী ছিলেন না। কারণ তিনি রাষ্ট্র এবং অন্যান্য সামাজিক সংঘ-সংগঠন বা গোষ্ঠীকে অভিন্ন প্রতিপন্ন করেননি। রাষ্ট্রের সঙ্গে সামাজিক সংঘ বা গোষ্ঠীর পার্থক্যের কথা তিনি বলেছেন। এ বিষয়ে A Grammar of Politics গ্রন্থে তিনি মোটামুটি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। রাষ্ট্র ও সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্যসমূহ নিম্নরূপ :

(১) রাষ্ট্র হল একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। স্থায়ীত্ব রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বা বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই অর্থে সামাজিক সংঘ বা গোষ্ঠীকে স্থায়ী বলা যায় না। 

(২) নির্দিষ্ট ভূখণ্ড হল রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য উপাদান। এই কারণে রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রধানত ভূখণ্ডকেন্দ্রিক। কিন্তু এ কথা কোন সামাজিক সংগঠনের ক্ষেত্রে খাটে না। 

(৩) রাষ্ট্রের সদস্যপদ হল বাধ্যতামূলক। রাষ্ট্রের মধ্যে ব্যক্তিবর্গকে রাষ্ট্রের সদস্য হতেই হয়। তা ছাড়া রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পরিত্যাগের ঘটনা সচরাচর বা সহজে ঘটে না। কিন্তু কোন সামাজিক সংঘের সদস্যপদ বাধ্যতামূলক নয়। এই সদস্যপদ পুরোপুরি স্বেচ্ছামূলক। আবার এই সদস্যপদ ইচ্ছা করলেই ত্যাগ করা যায়। কোন সমিতি বা ধর্মীয় সংস্থার সদস্যপদ ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করতে পারে।

(৪) রাষ্ট্রীয় আইন সর্বজনীন। এবং এই আইন মান্য করা বাধ্যতামূলক। রাষ্ট্র প্রয়োজনবোধে বলপ্রয়োগ করতে পারে এবং এই পথে তার নাগরিকদের আনুগত্য আদায় করতে পারে। রাষ্ট্র তার আইন অমান্য করার অপরাধের জন্য অপরাধীকে যে-কোন ধরনের শাস্তি দিতে পারে। কিন্তু সামাজিক সংঘ হল স্বেচ্ছামূলক। এর নিয়মকানুন কেবলমাত্র তার সদস্যদের উপরই প্রযুক্ত হয়ে থাকে। তার নিয়মকানুন অমান্য করার জন্য সামাজিক সংঘ তার কোন সদস্যকে দৈহিক শাস্তি দিতে পারে না; বড়জোর সংঘের সদস্যপদ কেড়ে নিতে পারে।

(৫) তুলনামূলক বিচারে রাষ্ট্রের কাজকর্মের পরিধি অনেক বেশি ব্যাপক। রাষ্ট্র সকলের এবং সর্বজনীন দাবি মেটানোর চেষ্টা করে থাকে। সমাজের সকল মানুষের স্বার্থ রাষ্ট্রের কাজকর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকে। তাই রাষ্ট্র সর্বজনীন দাবি পূরণের উদ্দেশ্যে সামাজিক সংগঠনসমূহের উপর তার নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে, কখনো প্রত্যক্ষভাবে আবার কখনো পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র তার এই নিয়ন্ত্রণ বলবৎ করে থাকে। ল্যাঙ্কির অভিমত অনুসারে রাষ্ট্র হল Public Service Commission.

(৬) সামাজিক সংঘ বা গোষ্ঠীকে তার সাফল্যের স্বার্থে সদস্যদের মতামতের উপর নির্ভর করতে হয়। সদস্যদের সক্রিয় ইচ্ছাকে গোষ্ঠী উপেক্ষা করতে পারে না। এই কারণে সামাজিক গোষ্ঠীগুলি যে যার সদস্যদের মনোভাবের প্রতি অধিকতর সংবেদনশীল হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ কথা এমনভাবে প্রযোজ্য নয়। 

(৭) সদস্যদের স্বতঃস্ফূর্ত বিশ্বাস ও আস্থার উপর সামাজিক গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব নির্ভরশীল। A Grammar of Politics গ্রন্থে ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন: “The authority of any group is based, in fact upon the living and spontaneous trust it can command.” নিজের ঘোষিত উদ্দেশ্যকে বাস্তবে কার্যকর করার জন্য সদস্যদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সামাজিক গোষ্ঠীকে সতত সক্রিয় থাকতে হয়। গোষ্ঠীর ঘোষিত উদ্দেশ্য বা পৃষ্ঠপোষিত স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে গোষ্ঠীর সদস্যপদ গ্রহণ করে এবং গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। ল্যাস্কি এ প্রসঙ্গে বলেছেন: Their obligation become sterilised save as they grew spontaneously from an experience that proves their worth.” রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বা নাগরিকদের আনুগত্যের উপর রাষ্ট্রের দাবির ক্ষেত্রে এ কথা এমনভাবে প্রযোজ্য নয়।

(৮) বৃহৎ সমাজে বহু ও বিভিন্ন সংঘ-সমিতি বর্তমান। এদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদের আশংকাকে অস্বীকার করা যায় না। এরকম বিরোধের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বিবদমান গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে। বস্তুত সামাজিক গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে বিবাদ মীমাংসার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র মধ্যস্থতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

সামাজিক গোষ্ঠীর সীমাবদ্ধতা: বৃহৎ সমাজে এবং ব্যক্তিজীবনে সামাজিক সংঘ বা গোষ্ঠীর ভূমিকার গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে ল্যাস্কি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তবে সঙ্গে সঙ্গে ল্যাস্কি সামাজিক গোষ্ঠীর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে সামাজিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে এক চরম স্বাতন্ত্র্যের ধারণা সৃষ্টির প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। তার ফলে গোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্ম হওয়ার কারণে ব্যক্তির মধ্যে সংকীর্ণতার সৃষ্টি হয়। গোষ্ঠীর সদস্যদের মানসিক উদারতা থাকে না। গোষ্ঠীর ভিতরে সমালোচনার সুযোগ তেমন থাকে না। তারফলে স্বৈরী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। গোষ্ঠীমাত্রেই নিজের ভালমন্দ বা সত্যাসত্যের ধারণাকে অভ্রান্ত বা সর্বজনীন সত্য হিসাবে প্রতিপন্ন করে এবং নিঃশর্ত আনুগত্যের ধারণা গড়ে তোলে।

সামাজিক গোষ্ঠীর গুরুত্ব: ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও বলতে হয় যে প্রত্যেক গোষ্ঠীর নিজের নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে। এবং সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে গোষ্ঠীগুলি গঠিত হয়। গোষ্ঠীজীবন ব্যক্তির বৈচিত্র্যের প্রয়োজন পূরণ করে। গোষ্ঠীগুলি সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্বার্থের প্রতিনিধি হিসাবে ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশ শাসনের আইন রাষ্ট্র প্রণয়ন করে। আইন প্রণয়নের এই পদ্ধতির সঙ্গে সামাজিক গোষ্ঠীগুলিকে বেশি করে সংযুক্ত করা দরকার। তা হলে আইনের বিষয়বস্তু হবে অধিকতর সুপরিকল্পিত এবং আইনের প্রতি নাগরিকদের আনুগত্য হবে সুনিশ্চিত। অর্থাৎ আইনের সাফল্য সুনিশ্চিত হবে। প্রকৃত প্রস্তাবে ল্যাস্কির অন্যতম উদ্দেশ্য হল সার্বভৌম ক্ষমতার উপর রাষ্ট্রের অধিকারকে সীমাবদ্ধ করা। তাঁর অভিমত অনুসারে সমাজের কল্যাণের স্বার্থে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী ধারণা নিতান্তই নিয়মমাফিক বিবেচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ সামাজিক কাঠামো হল যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতির। A Grammar of Politics গ্রন্থে ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন: “That the State is, in some form or another, an inevitable organisation…. But to admit that it is inevitable is not to admit that it is entitled to moral pre-eminence of any kind.”

উপসংহার: রাষ্ট্রের প্রকৃতি এবং বৃহৎ সমাজে রাষ্ট্রের স্থান সম্পর্কে ল্যাস্কির অভিমত মোটামুটি মার্কসীয়। তবে তিনি সম্পূর্ণরূপে মার্কসবাদী ছিলেন না। বিপ্লবের থেকে তিনি সংস্কার সাধনের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতানুসারে এই পথেই সমাজের বিকাশ ঘটতে পারে। ল্যাস্কি রাষ্ট্রের সঙ্গে সামাজিক সংঘ-সমিতির কার্যগত ও আইনগত সম্পর্ক প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে বহুত্ববাদী বক্তব্যের দ্বারা ল্যাস্কি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রের চরম, চূড়ান্ত বা অপ্রতিহত ক্ষমতাকে স্বীকার করেননি। তিনি রাষ্ট্রের বিলুপ্তির কথা বলেননি। কারণ তিনি নৈরাজ্যবাদী ছিলেন না। তিনি রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিরোধী ছিলেন। ল্যাস্কির রাজনীতিক মতাদর্শ বহুত্ববাদী ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। তবে তাঁকে চরম বা গোঁড়া বহুত্ববাদী বলা যাবে না। আবার রাষ্ট্র এবং সামাজিক সংঘ-সংগঠনগুলি পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী এ কথাও তিনি বলেননি। তাঁর মতানুসারে রাষ্ট্রীয় আইনকে গ্রহণযোগ্য ও অর্থবহ করে তোলা দরকার। এবং তারজন্য নিরবিচ্ছিন্নভাবে আইনের সামাজিকীকরণ অপরিহার্য।