আধুনিক শিক্ষাকাঠামা এর অন্তর্গত সাধারণ ধর্মীয় শিক্ষা ও বিশেষ ধর্মী শিক্ষা সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করে। এই বিশেষ ধর্মীয় শিক্ষার অন্যতম দুটি অংশ হল বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষা। উভয় প্রকার শিক্ষাই শিক্ষার্থীর আত্মবিকাশে সাহায্য করে এবং তাকে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দক্ষতাসম্পন্ন করে তােলে।

শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে কাজের মাধ্যমে কোনো বিশেষ বৃত্তি সম্পর্কে যখন কোনাে বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা লাভ করে, তখন তাকে বলা হয় বৃত্তিমুখী শিক্ষা। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীকে শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ও কলকারখানার যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য যে শিক্ষায় বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেই শিক্ষাকে বলা হয় কারিগরি শিক্ষা। উভয় প্রকার শিক্ষাই শিক্ষার্থীদের প্রাক্ষোভিক, মানসিক, সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশ সাধন করে। উভয় প্রকার শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে উৎপাদনশীলতা বাড়ে ও দক্ষ বিশেষজ্ঞ গড়ে ওঠে।

বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষা যেহেতু সাধারণ শিক্ষা নয়, তাই তার একটিমাত্র পাঠক্রম থাকে না। এই শিক্ষার মধ্যে যেমন অসংখ্য বিভাগ রয়েছে, তেমনি প্রতিটি বিভাগের জন্য পৃথক পৃথক পাঠক্রম প্রণয়ন করা হয়।

পাঠ্য বিষয়: বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষার পাঠক্রমের বিষয়গুলি হল ভাষা বিভাগ, নির্বাচনী বিষয় বিভাগ, বৃত্তিমূলক নির্বাচনী বিষয় বিভাগ, সক্রিয়তা বিভাগ। সক্রিয়তা বিভাগের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন সক্রিয়তা মূলক কর্মসূচি যেমন—

  • কর্মশিক্ষা, 
  • শারীর শিক্ষা, 
  • সমাজসেবা, 
  • এনসিসি ইত্যাদি। 

বর্তমানে গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়। পরিবেশ বিজ্ঞানকে আবশ্যিক বিষয় করা হয়েছে। শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে আঞ্চলিক ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

তবে এই ধরনের শিক্ষার সব পাঠক্রমেই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হয়।যথা— 

  • কোনাে নিদিষ্ট বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান আহরণা করা
  • জ্ঞানগুলির ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে বিশেষভাবে জানা এবং
  • সেই জ্ঞানকে বাস্তব ক্ষেত্রে যথাযথভাবে প্রয়োগ করা।

(১) তাত্ত্বিক অংশ: এই অংশে তাত্ত্বিক কথা পরিবেশন করা হয়। অর্থাৎ এতে বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের বিকাশ হয়।

(২) ব্যবহারিক অংশ : তাত্ত্বিক অংশে গৃহীত তথ্য শিক্ষার্থীদের সবসময় বৌদ্ধিক জ্ঞানার্জনে সক্ষম করে না, তাই কিছু কাজের মাধ্যমে বিষয়টিকে সহজ করে উপলব্ধিযােগ্য করার জন্য ব্যবহারিক অংশের প্রয়োজন।

(৩) প্রয়োগমূলক অংশ: তাত্ত্বিক অংশ সংরক্ষিত তথ্য, ব্যবহারিক অংশ দ্বারা সমৃদ্ধ হওয়ার পর তাকে যাতে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়, তার উপযোগী কার্যাবলী হল প্রয়োগমূলক অংশ। এর তিনটি স্তর —

  • নির্দিষ্ট কর্মভিত্তিক শিক্ষা : ফিটার, টার্নার, ওয়েল্ডার, কার্পেন্টার ইত্যাদি।
  • ডিপ্লোমা কোর্স :সিভিল, মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, মাইনিং ইত্যাদি।
  • স্নাতক, স্নাতকোত্তর : সিভিল, মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, আর্কিটেকচার, কেমিক্যাল, কম্পিউটার শিক্ষা ইত্যাদি। 

কোন দেশের শিল্পোন্নত অনেকটা নির্ভর করে সেই শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও কৌশল কর্মীদের উপর। বর্তমান সমাজে এখনও অনেক অভিভাবকগণ সাধারণ শিক্ষাকে প্রথম শ্রেণিতে রাখে। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। এইসকল বিষয়ের কথা মাথায় রেখে কমিশন এই বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষা সম্পর্কে নিম্নলিখিত সুপারিশগুলি করেছে।

(১) দক্ষ কর্মী ও টেকনিশিয়ানদের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে।

(২) ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে মোট শিক্ষার্থীর ২০ শতাংশ এবং মাধ্যমিক পাস করার পর মােট শিক্ষার্থীর ৫০ শতাংশ আংশিক বা পূর্ণ সময়ের জন্য বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করবে।

(৩) ১৪ থেকে ১৮ বছরের শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহ দিতে হবে।

(৪) সরকারি দফতর থেকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের বৃত্তি শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে।

(৫) ITI এ ভর্তির বয়স কমিয়ে ১৪ বছর করা হবে ও তার সঙ্গে পাঠক্রমের সামঞ্জস্যতা রক্ষা হবে। 

(৬) স্কুলের শিক্ষায় যারা কৃতি শিক্ষার্থী তারা পরবর্তী স্তরে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে।

(৭) দক্ষ কর্মী তৈরির জন্য ITI গুলােয় শিক্ষার সুযােগ বাড়াতে হবে, তাই চতুর্থ পরিকল্পনার মধ্যে আসন সংখ্যা বাড়াতে হবে দ্বিগুণ পরিমানে।

(৮) ডিপ্লোমা কোর্সের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যবহারিক জ্ঞানের ভিত্তিতে হবে। এক্ষেত্রে শিল্প অভিজ্ঞতাকে শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে যুক্ত করা হবে।

(৯) পলিটেকনিক গুলিতে শিক্ষক কলকারখানা থেকে নিযুক্ত হবে। এ কারণে সাধারণ শিক্ষা শিথিল করার প্রয়োজন হলেও করা যেতে পারে।

(১০) পলিটেকনিক গুলিতে প্রথম দুই বছরের শিক্ষার পাঠক্রমে গণিত ও বিজ্ঞান এই দুটি বিষয়ে জোর দিতে হবে।

(১১) মেয়েদের যেসকল বিষয়ে উৎসাহ রয়েছে নিম্নমাধ্যমিক শেষে সে সকল বিষয়ে ডিপ্লোমা বা সার্টিফিকেট কোর্সের ব্যবস্থা।

(১২) বাছাই পলিটেকনিক কলেজ গুলোতে পোস্ট ডিপ্লোমা বা ডিপ্লোমা পরবর্তী শিক্ষা দেওয়া হবে।

(১৩) ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে।

(১৪) ডিপ্লোমা ও ডিগ্রি স্তরে বহুমুখী শিক্ষা হবে। 

(১৫) ওয়ার্কশপ আয়োজন উৎপাদনভিত্তিক হবে।

(১৬) যেসকল কারখানায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষা নেবে সে সকল প্রতিষ্ঠান কেন্দ্র থেকে সাহায্য পাবে।

(১৭) আঞ্চলিক ভাষায় পাঠ্য বই তৈরি হবে।

(১৮) বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে শিক্ষার পাঠক্রম পরিবর্তন করা যাবে বা সংস্কার সাধন করা যাবে।

(১৯) ডিগ্রি কোর্সের সম্পূর্ণ সময়ের ব্যবহারিক শিক্ষা কারখানার সহায়তায় তৃতীয় বর্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে।

(২০) জুনিয়র টেকনিক্যাল স্কুল গুলির নাম পরিবর্তন করে টেকনিক্যাল হাইস্কুল দেওয়া হবে।

কৃষিবিদ্যার ক্ষেত্রে কয়েকটি সুপারিশ

(১) শিক্ষা, গবেষণার সহায়তায় কয়েকটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।

(২) বেশি পরিমাণে কৃষি বিদ্যালয়গুলির উন্নতি সাধন করতে হবে। 

(৩) কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ ও পলিটেকনিক কলেজকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। 

(৪) কৃষি কর্মীদের শিক্ষার জন্য কৃষি সংক্রান্ত পলিটেকনিক কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।