বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থের সংরক্ষক: পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে গণতন্ত্র পরিলক্ষিত হয় তা হল বুর্জোয়া গণতন্ত্র। বুর্জোয়া গণতন্ত্র সর্বসাধারণের গণতন্ত্র নয়। এ হল মুষ্টিমেয় শোষকের গণতন্ত্র। বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থেই এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে থাকে। বুর্জোয়া শ্রেণী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিশেষভাবে বিন্যস্ত করে। তারফলে তাদের শ্রেণী-স্বার্থ অব্যাহত থাকে। তাই কোন অবস্থাতেই বুর্জোয়া গণতন্ত্র সর্বসাধারণের জন্য প্রকৃত গণতন্ত্র হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে না। চূড়ান্ত বিচারে বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণই হল বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কাজ। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শাসক-শোষক শ্রেণী এবং শাসিত-শোষিত শ্রেণী থাকে। এই পরিস্থিতিতে সর্বজনীন স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে বুর্জোয়া গণতন্ত্র ব্যর্থ প্রতীয়মান হয়। অথচ জনসাধারণের স্বার্থের রক্ষাকারী হিসাবে বুর্জোয়া গণতন্ত্র নিজেকে প্রতিপন্ন হবার চেষ্টা করে। শোষক বুর্জোয়া শ্রেণী গণতন্ত্রের ছত্রছায়ায় থেকে তাদের শ্রেণীস্বার্থের অনুকূল শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখে। আর এরকম শাসন-শোষণের কাজে বুর্জোয়া শ্রেণী তথাকথিত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে ব্যবহার করে। শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে জনগণের গরিষ্ঠ অংশের বৈপ্লবিক আন্দোলনকে দমন করাই হল বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য। অতএব, বুর্জোয় গণতন্ত্র হল শ্রেণীভিত্তিক গণতন্ত্র এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থে পরিচালিত।
ব্যক্তিগত সম্পত্তির স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ: বুর্জোয়া গণতন্ত্রে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানাকে স্বীকার ও সংরক্ষণ করা হয়। বলা হয় যে সম্পত্তি অর্জনের বিষয়টি ব্যক্তিগত যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল। মানবজাতির উন্নতি ও মানদণ্ড হিসাবে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার কথা বলা হয়। বুর্জোয়া ব্যবস্থার বক্তব্য অনুসারে একমাত্র বুর্জোয়ারাই হল সভ্য মানুষ। অর্থাৎ উৎপাদন-উপাদানের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার পরিপ্রেক্ষিতে আরও বলা হয় যে মানবসভ্যতার সর্বোচ্চ বিকাশ হিসাবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সরকারের কথা বলা হয়। এবং আরও বলা হয় যে, এই সরকার পরিচালনার যোগ্যতা কেবলমাত্র বুর্জোয়া শ্রেণীরই আছে।
শ্রেষ্ঠতাবাদের সমর্থন: বুর্জোয়া গণতন্ত্রে শ্রেষ্ঠতাবাদ (elitism)-কে স্বীকার ও সমর্থন করা হয়। এই শ্রেষ্ঠতাবাদের ভিত্তিতে বুর্জোয়া গণতন্ত্রে সংখ্যালঘু বুর্জোয়া শ্রেণীর শাসন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাকে কার্যকর করার ব্যবস্থা করা হয়। এই ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাছাই করা মুষ্টিমেয় ব্যক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হয়। বুর্জোয়া গণতন্ত্রে জনসাধারণের অজ্ঞতা, অযোগ্যতা ও নির্লিপ্ততাকে বড় করে দেখান হয়। এবং এর আসল উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে জনগণকে দূরে রাখা এবং বঞ্চিত করা। প্রকৃত প্রস্তাবে এই ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে জনসাধারণের ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বুর্জোয়া গণতন্ত্রে বিরোধিতা করা হয়। এবং এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য শ্রেষ্ঠতাবাদের যুক্তি খাড়া করা হয়।
পুঁজির প্রাধান্য: বুর্জোয়া গণতন্ত্র হল পুঁজিবাদী গণতন্ত্র। এই ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামগ্রিক বিচারে পুঁজির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে পুঁজিই হল স্বাধীন; মানুষ এখানে পরাধীন। পুঁজিই হল সার্বভৌম, জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ এখানে থাকে না। বুর্জোয়া ব্যবস্থায় ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্ব অস্বীকৃত; কেবলমাত্র পুঁজিরই ব্যক্তিত্ব স্বীকৃত।
আংশিক গণতন্ত্র: বুর্জোয়া গণতন্ত্রে রাজনীতিক স্বাধীনতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। অন্যান্য প্রকারের স্বাধীনতার উৎস হিসাবে রাজনীতিক স্বাধীনতার উপর জোর দেওয়া হয়। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অধিকার ও স্বাধীনতার স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ বুর্জোয়া গণতন্ত্রে সম্ভব হয় না। কারণ এই ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। তা ছাড়া শোষণমূলক ব্যবস্থার উপরও এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃত প্রস্তাবে বুর্জোয়া গণতন্ত্র একমাত্র রাজনীতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সঠিক অর্থে সাম্য ও স্বাধীনতার ধারণা বুর্জোয়া গণতন্ত্রে অস্বীকৃত। এই কারণে বুর্জোয়া গণতন্ত্র হল আসলে আংশিক গণতন্ত্র।
বুর্জোয়া গণতন্ত্রের গুরুত্ব: তবে বুর্জোয়া গণতন্ত্রে সাধারণভাবে কিছু নাগরিক অধিকার প্রদান করা হয়ে থাকে। এই সমস্ত অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে মেহনতী মানুষের সংগঠিত হওয়ার এবং বৈপ্লবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুযোগও থাকে। কিন্তু বুর্জোয়া গণতন্ত্রে এই সীমিত অধিকারকেও শোষণকারী শাসকশ্রেণীর স্বার্থে খর্ব করা হয়। এ প্রসঙ্গে লেনিনের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “Capitalism, in general, and imperialism in particular, transform democracy into an illusion, endangers democratic aspirations in the masses, creates democratic institutions and intensifies the antagonism between imperialism which negates democracy and the masses who aspire to it.” লেনিন বুর্জোয়া গণতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করেছেন; সঙ্গে সঙ্গে লেনিন শ্রমিকশ্রেণীর শোষণ মুক্তির সংগ্রামে এই গণতন্ত্রের অপরিসীম গুরুত্বের কথাও বলেছেন। তাঁর মতে আর্থিক বিপ্লব সংগঠনের অন্য মেহনতী মানুষকে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পাঠ দেওয়া দরকার। গণতন্ত্রের জন্য শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্যবদ্ধ ব্যাপক বৈপ্লবিক সংগ্রাম শ্রেণী-শোষণের অবসান ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনে বিশেষভাবে সহায়ক। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে শ্রমজীবী জনতা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়। কারণ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং আপাত বিচারে হলেও জনপ্রিয় সার্বভৌমত্বের ধারণা বর্তমান থাকে। সুতরাং বুর্জোয়া গণতন্ত্রে সীমিত অর্থে হলেও নাগরিক অধিকারের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এই সীমিত নাগরিক অধিকারের মাধ্যমে সর্বহারা শ্রেণী শোষণের বিরুদ্ধে এবং ব্যাপক গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য বৈপ্লবিক আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করতে পারে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত সর্বহারা শ্রেণীর বৈপ্লবিক আন্দোলন গণতন্ত্রবিরোধী হতে পারে না। শোষিত সংখ্যাগুরু মেহনতী মানুষের বৈপ্লবিক প্রক্রিয়াকে পরিপূর্ণ অর্থে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হিসাবে বিবেচনা করা যায়।
মার্কসীয় ধারণা: মার্কসীয় দর্শন অনুসারে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ ও সঠিক গণতন্ত্র হিসাবে গণ্য করা হয়। এই সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র শুধুমাত্র রাজনীতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না। এই গণতন্ত্র সামাজিক এবং আর্থনীতিক ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত হয়। এই রকম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সকল ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকার ও সংরক্ষণ করা হয়।
Leave a comment