ভূমিকা: বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে মননশীল লেখকদের মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদের [১৮৯৪-১৯৭০)। সাহিত্য ও জীবনধারায় তাঁর বিশ্বাস ছিল অভিন্ন। তিনি সমকালীন মুসলিম সমাজের প্রচলিত ভাবধারা থেকে বেরিয়ে এসে- আধুনিক চিন্তাধারাকে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর উদার নৈতিক চিন্তা চেতনার উজ্জ্বল স্বাক্ষর “বাংলা জাগরণ” [১৯৫৬] এবং ‘শাশ্বত বঙ্গ’ [১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) প্রবন্ধ গ্রন্থ দুটি।
আলোচ্য নিবন্ধে “বাংলা জাগরণ” এবং “শাশ্বত বঙ্গ” অবলম্বনে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে কাজী আবদুল ওদুদের ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করা হলো।
১৯৫৬ সালে বিশ্বভারতীতে আবদুল ওদুদ উনবিংশ শতাব্দীর ‘বাংলায় জাগরণ’ সম্বন্ধে ছয়টি লিখিত বক্তৃতা প্রদান করেন। এতে তিনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতিকে সামনে রেখে এক নব জাগরণের ইতিহাস রচনা করেন। বিশ শতকের গোড়া পর্যন্ত বাংলার নবজাগরণ যে বিচিত্র পথে অগ্রসর হয়েছে তার পরিচয় ও বিশ্লেষণ প্রদান করেছেন আবদুল ওদুদ। তিনি মনে করতেন যে, বাংলাদেশের হিন্দু সমাজে শতাধিক বছর যাবৎ চিন্তায়ও কর্মে বিশ্বধারার যে ঢেউ খেলে যাচ্ছে তাকে অগ্রাহ্য করে বাঙালি মুসলমানের জীবনে সার্থক নবজাগরণ আসতে পারে না।
বাংলার জাগরণ বলতে কাজী আবদুল ওদুদ বুঝিয়েছেন হিন্দু মুসলমানের মিলিত জাগরণ। তিনি ইসলামের ইতিহাস আর ভারতবর্ষের ইতিহাসকে মিলিয়ে দেখার প্রয়াস পেয়েছিলেন। এক মুক্ত দৃষ্টিতে তিনি হিন্দু মুসলমান এই সমাজকে দেখেছিলেন এবং আপন জেনে তাদের ত্রুটি নির্দেশ করেছিলেন। উনিশ শতকের বাংলার জাগরণকে তিনি বলেছেন রেনেসাঁস। তাঁর মতে, এ জাগরণ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে যথাযোগ্য চেতনার অভাব রয়েছে। বাংলার জাগরণ সম্বন্ধে লিখিত প্রবন্ধে তিনি এই জাগরণ প্রয়াসের শক্তি ও এর অন্তর্নিহিত দুর্বলতা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। রেনেসাঁ বা নবজাগরণ আবদুল ওদুদের সাহিত্যিক জীবনের একটি প্রিয় বিষয়। তাঁর মতে সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির চর্চা অর্থাৎ সমস্ত জ্ঞান সাধনাকে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের সমস্যা ও বিষয়বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তার মূল্য যে নেই তা নয় তাও বৃহত্তর সংস্কৃতি সাধনারই অঙ্গ কিন্তু তাতে কোনো দেশ, জাতি বা সম্প্রদায়ের মনে রেনেসাঁস বা নব জাগরণের পরিপূর্ণ চেতনা আসতে পারে না এবং মানব মনীষার পরিপূর্ণ ধারণা ও মূল্যবোধ তাতে ব্যাহত হতে বাধ্য। সর্বাঙ্গীণ রেনেসাঁস এবং মানব মনীষার পরিধি যে কত ব্যাপক ও কত বিরাট তার সম্ভাবনা উপলব্ধির জন্য সর্বজনীন জ্ঞান সাধনা, এমনকি সর্বগ্রাহী মনোভাব দরকার।
এ কারণে কাজী আবদুল ওদুদ তাঁর বাংলার জাগরণ বিষয়ক ভাবাদর্শের প্রধান প্রেরণারূপে রামমোহনকে নির্দেশ করেছেন। রামমোহন রায়ের যে দুটি দিক কাজী আবদুল ওদুদকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল তা হলো নিরাকার উপাসনা প্রচলনে প্রয়াস আর বিচার বুদ্ধি ও লোকশ্রেয়ের আলোকে শাস্ত্রবিচারের উদ্যোগ। জীবনের সমস্যা সমাধানে রামমোহন যেমন শাস্ত্রজ্ঞানের সাহায্য নিয়েছেন, তেমনি নিয়েছেন শাস্ত্র নিরপেক্ষ তত্ত্বজ্ঞানের। কিন্তু কাজী আবদুল ওদুদের দুঃখ লোকশ্রেয়ের চিরন্তর উদার পথ থেকে সরে গিয়ে রামমোহনের অনুসরণীরা ভগবদভক্তির আতিশয্যের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল প্রবলভাবে। এর উদাহরণ দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্র। তৃতীয় বক্তৃতায় কাজী আবদুল ওদুদ সিপাহি বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, মধুসূদন, দীনবন্ধু, বঙ্কিমচন্দ্রের ভূমিকা সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদগণ সিপাহি বিদ্রোহকে ভারতবর্ষের প্রবল স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে মনে করলেও আবদুল ওদুদের মতে, সে-দিন বাংলাদেশ অন্তত বাংলার প্রাণকেন্দ্র, কলকাতায় সিপাহি বিদ্রোহের কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। তিনি মনে করেন ১৮৫৮ সালে সংঘটিত নীল বিদ্রোহ, বাঙালিকে যথেষ্ট নাড়া দিয়েছিল। এ বিদ্রোহের ফলই সাহিত্য রূপ লাভ করেছে দীনবন্ধুর রচনায়। একই সময়ে রেনেসাঁস এর প্রথম শিল্পী মাইকেল মধুসূদন দত্তের আবির্ভাব তাঁর সম্বন্ধে উচ্চ প্রশংসা ব্যক্ত করেছেন আবদুল ওদুদ। শক্তিধর শিল্পস্রষ্টা হিসেবে বঙ্কিমের অনন্যতাকে আবদুল ওদুদ মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন। তবে তাঁর মনে হয়েছে বঙ্কিমের চিন্তাধারা বাঙালি জাতিকে সঠিক পথ দেখাতে সক্ষম হয়নি। জাতীয়তার প্রশ্নে বঙ্কিমের হিন্দুদের ধারণা সে সময়ে বাঙালি সমাজে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। বঙ্কিমের মতো সম্মানিত সাহিত্যিক ও অসাধারণ মনীষার মধ্যে যে হিন্দু ঐতিহ্যপর্ব দেখা দেয়, তার পরিণাম, আবদুল ওদুদের মতে, শুধু অকিঞ্চিৎকর তা নয়, বিপদ সংকুলতা। বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যে উগ্র হিন্দু জাতীয়ত্বের বীজ বপন করেছেন। এ প্রসঙ্গে আবদুল ওদুদ দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেছেন,
“চিন্তাশীল হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের মারাত্মক দুর্বলতা। যতখানি জায়গা পেল তার চাইতে বেশি জায়গা পেল হিন্দু ঐহিত্য পর্ব। তার সে শ্রেষ্ঠ অবলম্বন জাতীয় ঐতিহ্য পর্ব আজকের জগতে তা চিন্তায় অকিঞ্চিৎকর তা নয়, বিপদ সঙ্কুলতা প্রমাণিত হয়েছে।”
রামকৃষ্ণ পরম হংসের অসাধারণ ভগবৎ নির্ভর তার প্রশংসা এবং যত মত তত পথ বাণীর নতুন ব্যাখ্যা দান করে কাজী আবদুল ওদুদ দেখিয়েছেন তাঁর জীবন সাধনায় এবং বিবেকানন্দের বিশ্বজয়ের ফলে শেষ পর্যন্ত পুরাতন প্রবল লৌকিক সংস্কার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠবার সুযোগ পেল। মানব প্রেমিক বিবেকানন্দ কর্ম প্রেরণা স্বরূপ গ্রহণ করেছিলেন জাতীয়তাবাদ ও সন্ন্যাসকে এ দুইকেই কাজী আবদুল ওদুদ বিবেচনা করেছেন যথাক্রমে সংকীর্ণ ও জীবন বিমুখ বলে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তা বোধের উচ্চ প্রশংসা করে ওদুদ লিখেছেন:
“দেশের মহা সংকটের সম্মুখীন হয়ে নিঃশেষে ক্ষয়ে গেল কবির হিন্দুত্বের জন্য যত অবুঝ মমতা দেশের বিচিত্র দুর্গতি ও অসম্পূর্ণতার মর্মে প্রবিষ্ট হতে পারল তাঁর মনীষা। আর অপূর্ব প্রত্যয়ে তিনি অঙ্গুলি নির্দেশ করতে পারলেন দেশের প্রকৃত শ্রেয়োলাভ যে পথে তার দিকে শুধু ভারতবর্ষের নয়, আধুনিক জগতের প্রকৃত কল্যাণ কোন পথে পরোক্ষভাবে তারও নির্দেশ সেই নির্দেশের মধ্যে লাভ হলো বাংলায় ও ভারতবর্ষে এ এক অসাধারণ ঘটনা ঘটল বিংশ শতাব্দীর সুচনায়।”
রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তার সংকীর্ণতা ভেঙে তাকে বৃহত্তর করতে প্রয়াসী হয়েছেন। ফলে সে অসাধারণ ঘটনা ঘটল তা ঐক্য ও সমন্বয়ের পথে সকলকে আহ্বান কর। ভারতীয় জাগরণ প্রয়াসে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বের কথা আবদুল ওদুদ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে হিন্দু মুসলমান সমন্বয়ের অভাব আবদুল ওদুদকে পীড়িত করেছে সবচেয়ে বেশি।
কাজী আবদুল ওদুদ ব্যক্তিজীবনে গান্ধীবাদের অনুসারী ছিলেন। চিন্তা-চেতনায় ও মননে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। গদ্যশৈলী নির্মাণেও যথেষ্ট সচেতন ছিলেন তিনি। চিন্তায় ও শৈলীতে উভয় ক্ষেত্রেই তিনি বিশিষ্টতা লাভ করেছিলেন। তবে চিন্তার ক্ষেত্রে কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন অন্যদের থেকে পৃথক। এমনকি রীতি-নীতির প্রতিও তিনি বিদ্রোহী ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন মুসলিম সমাজকে অন্ধত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে তাদেরকে স্বনির্ভর করে তুলতে। কাজী আবদুল ওদুদ দুই কূল রক্ষা করে জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে পতীচ্য প্রভাবজাত সমস্যা সমাধানে ছিলেন প্রয়াসী। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত “শাশ্বত বঙ্গ” গ্রন্থের ভূমিকায় এ গ্রন্থ সম্পর্কে তাঁর হৃদয়ানুতি তিনি প্রকাশ করেছিলেন এভাবে:
“এই পরিবেশে বুদ্ধির মুক্তির কথা সমাদৃত হবে, সে সম্ভাবনা অল্প। আজ বরং মুষ্টিমেয়র বুকে অনিবার্ণ থাকুক এই প্রত্যয়ে যে তা-ই মানুষের জন্য পথ, চিরন্তন ধর্ম যা পূর্ণরূপে সত্যাশ্রয়ী আর সবার জন্য কল্যাণবাহী; আর সব বড়ো জোর আপদ্ধর্ম-অন্য কথায় বিপর্যয়। মানুষ অপ্রেম ও চিন্তা থেকে রক্ষা পাক, এই হোক আজ প্রত্যেক দায়িত্ববোধ সম্পন্ন নর ও নারীর অন্তরতম প্রার্থনা।”
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অত্র অঞ্চলে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পশ্চাদপদ বাঙালি মুসলমানদের মনোজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে লুই ভিভিয়ার ডিরোজির দেখানো পথে প্রায় একশ বছর পরে- এক রক্তিম অভিপ্রায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক সৈয়দ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে তাঁর অসাধারণ আন্তরিকতায় একদল তরুণ লেখক ও ভাবুকদের নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “মুসলিম সাহিত্য সমাজ” নামক সাহিত্য সংগঠন। “শিখা” নামক প্রচারপত্র ছিল এ সংগঠনের মুখপত্র। গতানুগতিকতা বিরোধী মনোভাবের ধারক ছিলেন “শিখা” গোষ্ঠীর উদ্যোক্তাগণ কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন এ ধারার একজন সদস্য। ‘শাশ্বত বঙ্গে’র অধিকাংশ প্রবন্ধে এ সত্যের স্বরূপ উন্মোচিত হয় পরবর্তীতে। বিশেষকরে ‘কোরআনের আল্লাহ’, ‘সম্মোহিত মুসলমান’, ‘ইসলামে রাষ্ট্রের ভিত্তি’ এ সকল প্রবন্ধে তাঁর মুক্ত চিন্তাগুলো সর্বাত্মক সুন্দর হয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
“জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।”- এই বিশেষ চেতনায় কাজী আবদুল সচেতন লেখক ছিলেন। তাই তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজের প্রধান উদ্দেশ্য চিন্তা চর্চা ও জ্ঞানের জন্য আকাঙ্ক্ষা এবং সুরুচি সৃষ্টি। যুক্তি ছিল তাঁর হাতিয়ার, বুদ্ধি ছিল তাঁর পরিশীলিত মনন চেতনার বাহন। মুসলিম সমাজের পশ্চাদপদ চিন্তা ধারার পরিবর্তন সাধন করে ধর্মকে যুক্তির আলোকে গ্রহণ করার অনুপ্রেরণাই ছিল তাঁর প্রবন্ধের উপজীব্য।
সাহিত্য বিষয়ক অনেক প্রবন্ধ কাজী আবদুল ওদুদ রচনা করেছেন। ‘শাশ্বত বঙ্গ’ গ্রন্থের কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ, রস ও ব্যক্তিত্ব, ‘সাহিত্য জগৎ’ কয়েকটি প্রবন্ধে রসতত্ত্বের নিপুণ বিচার রয়েছে। সাহিত্যের এমন সরল আলোচনা বাংলা ভাষায় সচরাচর দেখা যায় না। কাজী আবদুল ওদুদ মনে করেন সাহিত্য শুধু আনন্দই দেয় না জ্ঞানও সরবরাহ করে। সাহিত্যে তিনি প্রধানত রচয়িতার ব্যক্তিত্বকে প্রকাশিত দেখতে চান। সাহিত্যালোচনা করা যথার্থ লেখা নয়। লেখকই তাঁকে আকৃষ্ট করে বেশি। ভারতীয় অলংকার শাস্ত্রের রসকে তিনি যথোচিত গুরুত্ব দেন, কিন্তু অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন লেখকের ব্যক্তিত্বকে। তাই ‘রস ও ব্যক্তিত্ব’ প্রবন্ধে তাঁর মন্তব্য,
“রস যত মনে হয় হোক, এ কালে আমাদের মন বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছে সাহিত্যে ও শিল্প-ব্যক্তিত্বের দ্বারা এমনকি সাহিত্য ও শিল্পের সমস্ত মাধুর্যে, সগজ কলাকৌশলে ব্যক্তিত্বের স্পর্শটুকু আবিষ্কার করতে না পারলে আমাদের
শিল্পে ও সাহিত্য উপভোগ আজ আর পূর্ণাঙ্গ হয় না।”
কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন স্ব-সম্প্রদায় নিষ্ঠ। তাঁর প্রবর্তিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের
কল্যাণ সাধন; সাহিত্যচর্চা ছিল গৌণ। সাহিত্য সমাজের সদস্যরা মেনে নিয়ে ছিলেন যে, ইসলাম ধর্মকে যুগোপযোগী করে নিলে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জীবনে শুভ পরিবর্তন আসবে। শতবর্ষ পূর্বে রাজা রামমোহন রায় সে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। অনুরূপ প্রথায় তাঁরা শুরু করেছিলেন নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে। প্রতিদিনের আচার-ব্যবহার ও গোঁড়ামির অতিরিক্ত একটি সুন্দর ধারণা ছিল তাঁদের ধর্ম বিষয়ে। মুসলিম সাহিত্য সমাজের অন্যতম সদস্য কাজী আবদুল ওদুদ মনে করতেন: “প্রকৃত মুসলমান হওয়ার অর্থ আল্লাহর অর্থ সত্য কল্যাণের অনুগত হওয়া, আর সেই জন্য জগতের বন্ধু হওয়া।” (ইসলামে রাষ্ট্রের ভিত্তি)
কাজী আবদুল ওদুদের ধর্মমত নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও তার ধর্মপ্রাণতা ছিল গভীর। তিনি ইসলামের শাশ্বত বাণীর যেমন ছিলেন ভক্ত, হযরত মুহাম্মদ (স) এর তেমনি ছিলেন অনুরাগী। ধর্মের প্রতি গভীর নিষ্ঠা তাঁকে উদার ও সহজশীল করেছিল। ধর্মকে তিনি অনুষ্ঠানের মধ্যে পেতে চেষ্টা করেননি। তাকে তিনি পেতে চেয়েছেন জীবনের গভীর উপলব্ধিতে। তাঁর ‘শাশ্বত বঙ্গ’ গ্রন্থে ‘কোরানের আল্লাহ’ প্রবন্ধটির মূল বক্তব্যে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন-
“লেখার গুণে নিজেকে গুণান্বিত করে তোলাই প্রকৃত মেয়েদের আদর্শ হওয়া উচিত।’
‘শাশ্বত বঙ্গ’ গ্রন্থের সর্বাপেক্ষা আলোচিত ও উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ ‘ব্যর্থতার প্রতিকার’। তাঁর মতে যথোহিত মুসলমান অন্ধ গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে। এ প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন যে, ‘সত্য আর হযরত মুহাম্মদের সাধনা এক ও অভিন্ন এ মনোভাব আসলে সম্মোহিত্যেরই মনোভাব। ইসলাম ধর্মের মূল কথা বা ধর্মভাব বলতে তিনি বুঝিয়েছেন আদর্শের বা শ্রেষ্ঠ চিন্তার একান্ত আনুগত্য জীবনের সার্থকতা তাঁর কাছে মনে হয়েছে ধর্মবোধে অর্থাৎ সত্যে অথবা কোনো আদর্শে সমর্পিত চিত্ততায়।”
আজীবন ধর্ম সম্পর্কে এক উদার ধারণা কাজী আবদুল ওদুদ পোষণ করেছেন এবং অত্যন্ত আগ্রহভরে বিভিন্ন ধর্মের মহাপুরুষদের জীবনী আলোচনা করেছেন। স্বদেশের নির্মিত মুসলিম সমাজ তাঁর চিন্তার কারণ ঘটিয়েছে। চিন্তার আগ্রহ জাগিয়েছে রামমোহন সমাধানে, দিশন মিলেছে হযরত মুহাম্মদ (স) এর কাছে; আর পদ্ধতি পেয়েছে গ্যোটে থেকে। এই সমস্ত মহৎ ব্যক্তিত্বসমূহের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অসীম। ‘শাশ্বত বঙ্গ’ গ্রন্থে তাঁদের আদর্শের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করেছেন। বিভিন্ন প্রবন্ধসমূহে।
মুসলিম সমাজকে তিনি ভালোবাসতেন তাই তার সঙ্গে ধর্মের চেষ্টায় তিনি লেখনী ধরেছিলেন। মুসলমান সমাজের উন্নতি ও সামাজিক কাঠামোর গুণগত পরিবর্তনের উদ্দেশ্য মুসলমান সমাজের কুসংস্কার বিতাড়িত করার জন্য। তিনি যুক্তির সাথে সংগ্রাম করেছেন। মুসলমানের দুরবস্থার কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন:
“আজ আমাদের ইসলামের গৌরব রক্ষা করতে হলে যুগ ধর্মকে সত্যকে আশ্রয় করতে হবে এবং সেই মতো ইসলামকে পুনর্জীবিত করতে হবে।” (সম্মোচিত মুসলমান: শাশ্বত বঙ্গ)
তাঁর ক্ষোভে সবচাইতে বিরোধও সবেচেয়ে বেশি হয়েছিল এদেরই সঙ্গে। এঁদের প্রভাবে মুসলমান সমাজের যে দুরবস্থা হয়েছে তার প্রতি তিনি আলোকপাত করেছেন। তাঁর বক্তব্য: “ইসলামের এ হিতৈষী বাণী সেই কৃপার পাত্রের দ্বারা সম্ভবপর নয় যে আলেম বলে নিজের পরিচয় দেয় কিন্তু হৃদয় যায় সাংঘাতিকভাবে বন্ধ।” (সম্মোহিত মুসলমান)
এক মুক্ত দৃষ্টিতে মুসলমানের জীবন সাধনা ও নেতৃত্ব সম্পর্কে বিচার করেছেন কাজী আবদুল ওদুদ। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে হযরত মুহাম্মদের মৃত্যুর অল্পকাল পরে ‘আরবের আদিম উচ্ছৃঙ্খলতার ও পারস্যের বিলাস মত্ততার আর্বতে, হযরতের সাধনা বিপর্যস্ত হয়েছিল। তার পরেও ইসলামের ইতিহাসে দেখা দিয়েছে কখনো উচ্ছৃঙ্খলতা আর কখনো অন্ধ অনুবর্তিতা। তাই তাঁর সুবিখ্যাত উক্তি “ইসলামের ইতিহাস বহুল পরিণামে এক ব্যর্থতার ইতিহাস।”
যে যুগে মুসলিম সমাজ, শিক্ষা সংস্কৃতি, চিন্তা চেতনায় তুলনামূলকভাবে হিন্দুদের থেকে অনেক পেছনে ছিল, সে যুগে কাজী আবদুল ওদুদ মুক্তবুদ্ধির প্রসার ঘটিয়ে মুসলিম সমাজকে জাগ্রত ও আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ করতে প্রযাস পেয়েছিলেন। তাঁর আদর্শ তিনি সমুন্নত রেখেছেন। “সম্মোহিত মুসলমান”, “বাংলার জাগরণ”, “মুসলমানের পরিচয়” প্রভৃতি প্রবন্ধে তাঁর এজাতীয় চেতনা প্রতিষ্ঠিত।
কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন মানবিকতাবাদের সাধনায় নিযুক্ত। মানবিকতাকে যথার্থভাবে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। এর পরিপেক্ষিতেই তিনি ইসলামের ইতিহাস ও ভারতের ইতিহাসকে মিলাতে চেয়েছিলেন। সাদীর কবিতা, আতাতুর্কের বিপ্লব, দাদু কবীরের ভক্তি সাধনা, রামমোহনের সংস্কার প্রচেষ্টা ও রবীন্দ্রনাথের কবি জীবনকে একই সূত্রে গ্রথিত করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। মানব সভ্যতার ইতিহাসে সেসব জ্ঞান সঠিক ও চিন্তা নায়ক মানব কল্যাণ ও প্রেমের সাধনা করেছেন,
তাঁদের উত্তরাধিকার তিনি দাবি করেছেন দ্বিধাহীন চিত্তে। তাঁর বিবেচনায়,
“ইয়োরোপীয় সংস্কৃতির বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ও অকৃষ্ঠিত মানব কল্যাণ জিজ্ঞাসা আজো মানুষের শ্রেষ্ঠ অধিক সম্পদ।”
সর্বাঙ্গীণ রেনেসাঁয় এবং মানব মনীষীর পরিধি যে কত ব্যাপক ও বিরাট তার সম্ভাবনা উপলব্ধির জন্য কাজী ওদুদ সর্বজনীন জ্ঞান সাধনা ও সর্বগ্রাসী মনোভাবের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। ‘সংস্কৃতির কথা’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন:
“আজ বড় কথা সে সবের প্রাণ শক্তির সন্ধান যা থেকে সম্ভবপর হবে জাতিতে জাতিতে আমরা সমাজে সমাজে গাঢ়তর সহযোগিতা ও মঙ্গলতর ভবিষ্যৎ। মানুষের বিচিত্র সংস্কৃতির সেই প্রাণ শক্তি আজ চিন্তার ক্ষেত্রে নাম পেয়েছে বৈজ্ঞানিকতা ও মানব হিত আর কর্মের ক্ষেত্রে নাম পেয়েছে সুব্যবস্থিত রাষ্ট্র জীবন। এ কালে বাংলার মুসলমানের সাংস্কৃতিক জীবন ও প্রতিষ্ঠিত হবে সেই বৈজ্ঞানিক’তা মানব হিত ও সুব্যবস্থিত রাষ্ট্রের ভিত্তির উপরেই।” (সংস্কৃতির কথা: শাশ্বত বঙ্গ)
কাজী আবদুল ওদুদ সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। কোনো প্রকার ধর্মীয় গোঁড়ামি বা ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাব তাঁর ‘শাশ্বত বঙ্গ’ গ্রন্থের প্রবন্ধসমূহে লক্ষ করা যায় না। মানুষকে তিনি মনুষ্যত্বের মাপকাঠিতেই বিচার করতেন। তাঁর কাছে চরিত্রের মহত্ত্বই ছিল বড়। হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিরোধ তিনি সমর্থন করতে পারেননি। এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলনই ছিল তাঁর জন্য।
এভাবে “বাংলার জাগরণ” এবং “শাশ্বতবঙ্গ” গ্রন্থে কাজী আব্দুল ওদুদ তার সত্যার্থ চিন্তা ও বুদ্ধিকে সদাজাগ্রত ও সম্প্রসারিত করেছেন উদার মানবিকতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার সীমানায়। কাজী আবদুল ওদুদ বাংলা জাগরণ এবং মুক্ত বুদ্ধিরচর্চা সম্পর্কে ছিলেন সচেতন এবং যুক্তিবাদী। তাঁর যুক্তিধর্মীতার মাধ্যমে একদিকে যেমন সমাজ-জীবনের গভীরে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল- তেমনি আরেকদিকে বাংলা সাহিত্য তাঁর লেখনীর মাধ্যমে পেয়েছিল ঝরঝরে গদ্য ভাষা।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment