অথবা, বুদ্ধিবাদ কাকে বলে?
অথবা, বুদ্ধিবাদের সংজ্ঞা দাও।
ভূমিকাঃ বুদ্ধিবাদের মূল বক্তব্য হল- জ্ঞান বুদ্ধি দিয়েই লাভ করা যায়। যে মতবাদ বিশুদ্ধ বুদ্ধিকে সার্বিক ও নিশ্চিত জ্ঞানের উৎস বলে মনে করে, তাকেই বুদ্ধিবাদ বলে। বুদ্ধিই যথার্থ জ্ঞানলাভের প্রধান উপায়, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় না। ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি তা পরিবর্তনশীল ও অনিশ্চিত। ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান বস্তুর বাহ্যরূপেই সীমাবদ্ধ।
ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি সে জ্ঞান অসঙ্গত এবং অসম্পূর্ণ। অতএব, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের মাধ্যমে তত্ত্বালােচনা করা যায় না। তাই বুদ্ধিবাদী দার্শনিকরা বুদ্ধিকেই জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায় ও উৎস হিসেবে উল্লেখ করেন। বুদ্ধিবাদীদের মতে আমাদের জ্ঞান অভিজ্ঞতাপূর্ণ। এর জন্য কোন অভিজ্ঞতার প্রয়ােজন হয় না। বুদ্ধিবাদীদের মতে, মন বা আত্মা হল প্রধানত সক্রিয়। বুদ্ধি এর স্বাভাবিক গুণ।
প্রাচীন বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের মধ্যে যারা অগ্রগণ্য তারা হলেন সক্রেটিস এবং প্লেটো। নব্য পাশ্চাত্য দর্শনের জনক বুদ্ধিবাদের প্রধান পুরােহিত হলেন ডেকার্ট, স্পিনােজা, ভলফ এবং লাইবনিজও নামকরা বুদ্ধিবাদী। এরা সবাই স্বীকার করেন যে, বুদ্ধির সাহায্যেই নিশ্চিত ও যথার্থ জ্ঞানলাভ সম্ভব। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান সঠিক নয়। এ জ্ঞান অসঙ্গত এবং অযথার্থ।
ডেকার্টঃ মধ্যযুগের সমস্ত বিশ্বাসকে সন্দেহাকারে ডেকার্ট তার দার্শনিক আলােচনা করেন। তিনি তিন প্রকার ধারণার কথা বলেছেন; যেমন (ক) আগন্তক ধারণা, (খ) কৃত্রিম ধারণা ও (গ) অন্তর বা সহজাত ধারণা।
(ক) আগন্তুক ধারণাঃ যেসব ধারণা বাইরে থেকে আমাদের মনে আসে সেগুলােকে বলে আগন্তুক ধারণা। যেমন বাড়ি, নদী, পাহাড় ইত্যাদি। এ ধারণা স্পষ্ট, প্রাঞ্জল ও উজ্জ্বল নয়।
(খ) কৃত্রিম ধারণাঃ আমাদের মনের বিভিন্ন ধারণার সাথে যােগ-বিয়ােগের ফলে যে ধারণার উৎপত্তি হয় সেগুলাে কৃত্রিম ধারণা। যেমন পঙ্খীরাজ ঘােড়া, সােনার হরিণ ইত্যাদি। এ ধারণা স্পষ্ট, প্রাঞ্জল ও উজ্জ্বল নয়।
(গ) অন্তরধারণাঃ ডেকার্টের মতে, কতগুলাে অন্তরধারণা ঈশ্বর জন্ম থেকেই আমাদের মনে মুদ্রিত করে দিয়েছেন; যেমন- অসীমতা, নিত্যতা, পূর্ণসত্তা বা ঈশ্বরের ধারণা। তার মতে, সুস্পষ্টতা এবং প্রাঞ্জলতাই এসব ধারণার সত্যতা প্রমাণ করে। এগুলাে স্বতঃসিদ্ধ। এসব অন্তরধারণা থেকেই আমরা জগৎ ও জীবন সম্পর্কে দার্শনিক জ্ঞান লাভ করে থাকি।
ডেকার্ট মনে করেন, জ্যামিতিতে যেমন কতগুলাে স্বতঃসিদ্ধ সূত্র আছে যেগুলাে থেকে অবরােহ পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত টানা হয়, তেমনি মানুষের মনেও কতগুলাে স্বতঃসিদ্ধ অন্তরধারণা আছে যেগুলাে থেকে অবরােহ পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত টানা হয়। তিনি মনে করেন, দার্শনিক সত্য গাণিতিক সত্যের মৃত সুনিশ্চিত এবং যথার্থ।
স্পিনােজাঃ বুদ্ধিবাদী দার্শনিক স্পিনােজাও ডেকার্টের মত অন্তরধারণার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। তিনি ঈশ্বরসম্বন্ধীয় অন্তরধারণার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়ে জ্যামিতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে, অবরােহের সাহায্যে জীবাত্মা ও জীবজগতের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।
লাইবনিজঃ জার্মান দার্শনিক লাইবনিজ বলেন, জ্ঞান বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া যায়। তবে ইন্দ্রিয় কখনাে যথার্থ জ্ঞানের সন্ধান দিতে পারে না। যথার্থ জ্ঞান একমাত্র বুদ্ধির সাহায্যেই লাভ করা যায়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, মতবাদ বিশুদ্ধ বুদ্ধিকে সার্বিক ও নিশ্চিত জ্ঞানের উৎস বলে মনে করে, তাকেই বুদ্ধিবাদ বলে। বুদ্ধিই যথার্থ জ্ঞানলাভের প্রধান উপায়, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় না। ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি তা পরিবর্তনশীল ও অনিশ্চিত। ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান বস্তুর বাহ্যরূপেই সীমাবদ্ধ।
Leave a comment