কবিতার নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ নামকরণের মধ্যেই সৃষ্টিতত্ত্বের মর্মবাণীটি থাকে নিহিত। ব্যক্তিজীবনে নামকরণ কেবল একটি পরিচয় চিহ্ন হলেও সাহিত্য স্রষ্টা নামকরণকে তাঁর সৃষ্টির চাবিকাঠি রূপেই ব্যবহার করেন। রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব অভিমতটি এপ্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য—“নামকে যারা নামমাত্র বলিয়া মনে করেন আমি তাদের দলে নই।” তবে নামকরণ প্রসঙ্গটি সাহিত্য বিষয়ে নানা দৃষ্টিকোণ থেকেই আসতে পারে। যেমন— ব্যক্তিকেন্দ্রিক নামকরণ, ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণ, কোনো বিশেষ প্রতীক বা চিহ্নের দ্যোতনা সঞ্চারী নামকরণ প্রভৃতি। নামকরণের গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুও যথেষ্ট প্রকরণ নির্ভর, সচেতন বুদ্ধিদীপ্ত মননের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর ‘বাইশে শ্রাবণ’ কাব্যগ্রন্থের ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ কবিতার নামকরণ প্রসঙ্গে কোন্ ভাবনা-ক্রিয়াশীল ছিল, সেই বিশ্লেষণটি বর্তমানে আলোচনার অবকাশ রাখে।

‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ কবিতাটির নামকরণের বহিরঙ্গিক দিকটি নজরে আনলে মনে হয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক নামকরণের সবরকম লক্ষণেই আক্রান্ত কবিতাটি। তবে অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের ব্যঞ্জনাধর্মী দিকটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াল পটভূমিতে সমসাময়িক বিভীষিকার নিদারুণ অভিঘাত থেকে বাঁচবার চেষ্টায় জারিত। মহর্ষির পুত্র ঋষিত্বের উত্তরাধিকারী কবি রবীন্দ্রনাথ সভ্যতার ভয়ঙ্কর সঙ্কটদীর্ণ এই সময়গুলি সমগ্র দেশ ও জাতির সামনে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মহামিলনের শাশ্বত মন্ত্র। কবি বুদ্ধদেব বসুও তাই সমসাময়িক পৃথিবীর রক্তপঙ্কিল আবর্ত থেকে নিজেকে এবং সমগ্র জাতিকে রক্ষা করতে গুরুদেবের শরণাপন্ন হয়েছেন। তাকেই বন্ধু-প্রিয়তম-রক্ষাকর্তা মনে করেছেন। সভ্যতার ইতিহাসে তখন একের পর এক ঘটে গেছে মহামারীর সংক্রমণ। মানুষের মর্মজাত অস্তিত্বের প্রবল পটভূমিতে তখন প্রাণলক্ষ্মীর নির্বাসন ঘটে গেছে। এই সন্ধিলগ্নে দাঁড়িয়ে তরুণ কবি বুদ্ধদেবের মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী চিন্তাধারা, তার ঔপনিষদিক জীবনদর্শনকে স্মরণ করবার সময় এসেছে আজ। যুদ্ধবাজ রাজশক্তির রক্তপিপাসু উদ্ধত সঙিনে সমস্ত রকমের শিল্প-সৌন্দর্য ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। শক্তিমদে উন্মত্ত এই ফ্যাসিবাদীদের লোভ ও অত্যাচারে মানুষের জীবনের সর্বস্ব অবলুপ্তি ঘটে গেছে। ক্ষমতাশীল দেশের হাতে লক্ষ লক্ষ দেশ ও জাতির মানুষ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ‘সভ্যতা ও ফ্যাসিজম’ প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসুর বক্তব্যটি মনে আসে, “আজকের দিনে এমন এক রাষ্ট্রশক্তি প্রবল হয়ে উঠেছে যারা এই ব্যবস্থাকে স্থায়ী করবার প্রাণান্তকর চেষ্টায় লিপ্ত এবং সকল মানুষকেই লৌহশাসনের যন্ত্রে পিষ্ট না করলে যাদের চলে না, তাদের আদর্শ ও কর্মপদ্ধতি এমনই যে সকলের আগে কবির মুখ বন্ধ করা তাদের দরকার, কেননা কবি সত্য ও সুন্দরের উপাসক। এরই নাম ফ্যাসিজম।”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যলগ্নে দাঁড়িয়ে, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এক বছর পর প্রথম জন্মদিবস উপলক্ষ্যে কবিতাটি লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। জাতিতে জাতিতে, রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে এখন চলছে সংঘাত আর বিদ্বেষের তীব্র বিষাক্ত বাষ্পরথ। দীন দরিদ্র মানুষের মুখে অন্ন নেই, অথচ সাম্প্রদায়িকতার প্রবল পটভূমি উন্মুক্ত করে, দেশে দেশে মজুত হচ্ছে অস্ত্র ভাণ্ডার। সাধারণ মানুষ পশুর মতো জীবন-যাপন করছে। এইসব দীন, অসহায় মানুষগুলোকে নিয়েই সাম্প্রদায়িক শক্তি দানা বাঁধছে, এইসব মানুষগুলোকে পণ্য করেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কারবার ফুলে ফেঁপে উঠছে। মানবতার প্রবল অপমানে ব্যথিত কবি রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় নিলেন। গুরুদেবের বেদমন্ত্র সুলভ বাণী, স্মরণ করে লিখলেন,

“তোমারে স্মরণ করি আজ এই দারুণ দুর্দিনে 

হে বন্ধু, হে প্রিয়তম। সভ্যতার শ্মশান-শয্যায় 

সংক্রামিত মহামারী মানুষের মর্মে ও মজ্জায় ; 

প্রাণলক্ষ্মী নির্বাসিতা।”

পুষ্পকরথে বা আকাশযানে পরিভ্রমণরত এইসব যুদ্ধবাজ শক্তি প্রতিমুহূর্তে নিক্ষেপ করতে চলেছে আগুনের গোলা। নিজেদের শ্রেষ্ঠতর পরিচয় দিতে গিয়ে এইসব মৃত্যুবহনকারী অত্যাচারী রাক্ষসেরা উন্মত্ত জন্তুর মতো জীবনব্যাপী সৌন্দর্যের ধ্যান ভঙ্গ করে তাকে বিনষ্ট করতে উদ্যত। জীবনের সোনার হরিণ তাদের বোমার বর্ষণে অবিরত ভীত ও সন্ত্রস্ত। মানুষকে পণ্য করেই ধনতন্ত্রের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রতন্ত্রের মিলন ঘটিয়েছে তারা। মানবসভ্যতার এতবড়ো কলঙ্কজনক অধ্যায়কে নিজের অস্তিত্ব দিয়ে দেখা বুদ্ধদেবের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এত দুঃসহ দুঃখ, ঘৃণা, নরকযন্ত্রণার মতো দিনগুলিকে তিনি যে সহ্য করছেন, তা শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছে রবীন্দ্রবাণী ও সৃষ্টির প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও আনুগত্যের কারণে। নিবিড় কালো অন্ধকার রাত্রির অবসান নতুন দিনের ঊষা যেভাবে স্বর্ণদ্বার উদ্ঘাটন করে নতুনকালের সূচনা করে, রবীন্দ্রসৃষ্টির বেদমন্ত্রসম বাণীর মাধ্যমেও কবি বুদ্ধদেব সমস্ত প্রকার অমঙ্গল থেকে নিজেকে ও জাতির রক্ষা সম্ভব বলে জেনেছেন।

“এত দুঃখ, এ দুঃসহ ঘৃণা 

এ নরক সহিতে কি পারিতাম, হে বন্ধু, যদি না 

লিপ্ত হতো রক্তে মোর, বিদ্ধ হতো গূঢ় মর্মমূলে

তোমার অক্ষয়মন্ত্র।”

রবীন্দ্রনাথের এই বেদমন্ত্রসম বাণীর প্রতি আস্থা ছিল বলেই প্রবল অন্ধকার রাতেও বিবেক-বিশ্বাস ও প্রত্যয়িত মূল্যবোধের ধারণাটিকে যথার্থ সম্মুখবর্তী করে রাখতে পেরেছিলেন তরুণ কবি বুদ্ধদেব। আসলে রবীন্দ্রনাথই বলেছিলেন দুঃখের অনলে পুড়ে পুড়ে হোমবহ্নি হয়ে দেখা দেব প্রেম-ভালোবাসা-বিবেকবোধের মতো মানবিক ধারণাগুলি। আসলে দুঃখকে ত্যাগ করে শুধুমাত্র সুখের ওপর জীবনায়ন নিবন্ধ রেখে আনন্দকে লাভ করা যায় না কখনও । ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় ১৩২৪-এর আশ্বিন-কার্ত্তিক সংখ্যার একটি লেখার কথা মনে আসে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ধর্মবোধের প্রথম অবস্থায় শান্ত মানুষ তখন আপন প্রকৃতির অধীন, তখন সে সুখকেই চায়, সম্পদকেই চায়, তখন শিশুর মতো কেবল তার রসভোগের তৃষ্ণা, তখন তার লক্ষ্য প্রেয়। তারপর মনুষ্যত্বের উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে তার দ্বিধা আসে ; তখন সুখ এবং দুঃখ, ভালো এবং মন্দ এই দুই বিরোধের সমাধান খোঁজে সে। তখন দুঃখকে সে এড়ায় না, মৃত্যুকে সে ডরায় না…….তখন তার লক্ষ্য শ্রেয়।……সেখানে যে আনন্দ, সোঁত দুঃখের ঐকান্তিক নিবৃত্তিতে নয়, দুঃখের ঐকান্তিক চরিতার্থতায়।” ত্যাগ ও দুঃখবোধের এই ধারণাকে সমীকৃত করে নিয়েই রবীন্দ্রনাথ তার অমৃতলোকের জগৎটি নির্মাণ করেছেন। ফ্যাসিস্ট হত্যাকারীরা যেভাবে মানবতার শ্মশান শয্যা নির্মাণ করেছিল সেখানে দাঁড়িয়ে সে দুঃখ সহ্য করার একমাত্র চিরাবলম্বন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই বিশ্বাস আর অভীমন্ত্রের জোরেই বুদ্ধদেব বসু ‘বাইশে শ্রাবণে’র কবিতাগুচ্ছকে রবীন্দ্রপ্রণামে নিবন্ধ রেখেছিলেন। ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ কবিতাটিও কবি বুদ্ধদেবের এ ভাবনায় ব্যতিক্রম নয়। রবীন্দ্র প্রণামের মাধ্যমে সভ্যতার ইতিহাসে মানবতার মুক্তি যে সম্ভব তারই ইতিবৃত্ত রচিত হয়েছে কবিতাটিতে। সেদিক থেকে কবিতাটির নামকরণ যথাযথ হয়েছে বলা যায়।