নাটক বা প্রহসন যাই হোক না কেন তাকে সংলাপ নির্ভর হতেই হবে। সংলাপের উপরই নাটকীয়তা, বিষয়বস্তুর বর্ণনা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টির চেষ্টা, চরিত্রের গঠন, বিকাশ, বিশ্লেষণ, পরিণতি ইত্যাদি নির্ভর করে। সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতে কাহিনী, চরিত্র, ঘটনা, প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিকতা, স্থানাকালের পরিচয় প্রদানের জন্য নানা মাধ্যম থাকলেও প্রহসনের ক্ষেত্রে সংলাপই একমাত্র মাধ্যম। প্রহসনকারকে সমস্ত কিছুই প্রকাশ করতে হয় সংলাপের মাধ্যমে। সংলাপ প্রহসনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রহসনে সংলাপ রচনা পদ্ধতির জন্য রচয়িতাকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। মনের বিভিন্ন প্রবৃত্তি প্রকাশের জন্য সংলাপই একমাত্র মাধ্যম’। সংলাপের উপরেই মনের বিভিন্ন ভাব-অনুভব প্রকাশ নির্ভর করে। সংলাপের মাধ্যমে প্রহসনে নাট্যরস জমে ওঠে। এমনকি প্রহসনের অভিনয় প্রক্রিয়াও সংলাপের উপর নির্ভরশীল।
সংলাপ যত উৎকৃষ্ট হবে প্রহসন তত সমাদর লাভ করবে) সংলাপ সম্বন্ধে নিকনোর মন্তব্য স্মরণীয়– “Good dialogue does not by any means invariably signify poetic dialogue; it is dramatic language subordianted to character and eminently suitable for histrionic communication.” অর্থাৎ উৎকৃষ্ট সংলাপ মানেই কাব্য-সংলাপ এমন ধারণা ঠিক নয়, নাটকের প্রেক্ষিত ও কাহিনী অনুযায়ী সংলাপকে তাৎপর্যময় করে তুলতে হবে। “The Art of Dramatic’ গ্রন্থেও বলা হয়েছে ‘Good Dialogue is the product of characters, carefully chosen? মধুসূদন তাঁর ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ গ্রহসন রচনায় ভাষা-সংলাপের সেই সচেতনতা বোধের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর প্রহসনের চরিত্রগুলি তাদের নিজের নিজের ভাষায় কথা বলেছে।
প্রহসনে সংলাপ রচনায় মধুসূদন যে কতখানি দক্ষ তার পরিচয় আছে নানা সমালোচকের বক্তব্যে। যেমন অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “প্রত্যেক চরিত্রের সংলাপ চরিত্রানুযায়ী হয়েছে। হানিফ ও তার বিবি ফতিমার সংলাপে মধুসূদন যশুরে গ্রাম্য ভাষা বহাল রেখেছেন। যশোরে তাঁর জন্ম ও বাল্যকাল কেটেছে, সুতরাং স্থানীয় ভাষা তাঁর ভালোই জানা ছিল। একালে দেখছি, যাঁরা হালচালের নাটক-প্রহসন লিখছেন, তাঁরাও কৌতুক সৃষ্টির জন্য অথবা হাস্যকর পরিবেশ ফোটাবার জন্য যশোহরের উপভাষাই ব্যবহার করছেন। তাঁর ব্যবহৃত বাগরীতিতে হাস্যরসের যে উদ্বেল তরঙ্গ লক্ষ্য করা যায় এবং দুষ্ট ব্যক্তিকে যে ভাষায় ও পরিস্থিতিতে নাস্তানাবুদ করা হয়েছে, তা ক্ষণে ক্ষণে মলিয়েরকে স্মরণ করিয়ে দেয়।”
‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনে ভূমিকালিপি অনুযায়ী সংলাপ হওয়াতে চরিত্রগুলি যথেষ্ট জীবন্ত হয়েছে। এখানে বিচিত্রতর ও কৌতুককর বাভঙ্গির উদাহরণ আছে। কপট ধর্মাচারী নারীমাংসলোলুপ বৃদ্ধ জমিদার ও তার সহায়ক গ্রাম্য কুট্টনী পুঁটি এবং মুসলমান প্রজার সংলাপ অংশ উদ্ধার করলে বোঝা যায়, সংলাপ কত চরিত্রানুযায়ী হয়েছে। যেমন—
“(১) ভক্তপ্ৰসাদ। আহা! এমন খোস্-চেহারা কি হানিফের ঘরে সাজে? রাজরানী হোলে তবে এর যথার্থ শোভা পায়।
“ময়ূর চকোর শুক চাতকে না পায়।
হায় বিধি পাকা আম দাঁড়কাকে খায়।।”
(২) ফতেমা। পুঁটি দিদি, মুই তোর পায়ে সেলাম করি, তুই মোকে হেতা থেকে নিয়ে চল।
(৩) পুঁটি। আ মর্, একশো বার ঐ এক কথা? বাবু এত করে বল্চ্যে তবু কি তোর আর মন ওঠে না? হাজার হোক নেড়ের জাত কিনা, – ‘এই বাগভঙ্গি, চরিত্রোচিত সংলাপ এবং বাস্তব পরিবেশ, সচেতনতা যে কোনো কালের নাট্যাদর্শ হতে পারে।”
নাটকীয় ভাষা সৃষ্টির দিক দিয়ে ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ যথেষ্ট মূল্যবান। কারণ হানিফের মুখের ভাষা দীনবন্ধুর হাতে অনেকখানি প্রসার লাভ করে বাংলা সাহিত্যের বিশেষ চরিত্র রূপায়ণে এক বিশেষ ভাষায় পরিণতি লাভ করেছিল। এ ছাড়া এ প্রহসনটিতে মধুসূদন নানা কবিতা ও ছড়া ব্যবহার করে এর ভাষাকে আরও সরল করে তুলেছেন।
সমালোচক অজিতকুমার ঘোষের মতে, “মাইকেল গ্রামের মূর্খ, অশিক্ষিত কৃষক পরিবারের মুখে গ্রাম্যভাষা দিয়া ঐ সব চরিত্রের স্বাভাবিকতা রক্ষা করিয়াছেন। শুধু তাহাই নহে; হানিফ মুসলমান, সেজন্য প্রহসনকার তাহার কথায় প্রচুর মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন। ইহাতে চরিত্রটি আরো বেশি সরস ও উপভোগ্য হইয়াছে।” [বাংলা নাটকের ইতিহাস। “বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনের সূচনায় হানিফ আর গদাধরের সংলাপ শুধু স্বাভাবিক নয়, অনিবার্যও বটে।
আলোচ্য প্রহসনে ভদ্র হিন্দুর সংলাপ বেশ মার্জিত। সংলাপ বিষয় পরিস্থিতি ও চরিত্র অনুযায়ী সার্থকও বটে। কলকাতা ও নিকটবর্তী অঞ্চলের আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় সংলাপ রচিত। ভদ্রেতর চরিত্রের গ্রাম্য ভাষা ব্যবহৃত হওয়ায় চরিত্রগুলি সজীব ও প্রাণবন্ত হয়েছে।
সংলাপ রচনার ক্ষেত্রে মধুসূদন অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। প্রহসনের অঙ্গীরস হাস্যরস। যে রসের বাহন চরিত্রের শৈথিল্য এবং সরস সংলাপ চরিত্র শৈথিল্যের কথা চরিত্র পর্যালোচনায় আলোচিত হয়। এখানে সংলাপের আলোচনায় দেখা যায় মধুসূদন উক্তি প্রত্যুক্তিমূলক বক্তব্যে নিপুণতা দেখিয়েছেন। মধুসূদন পরিচিত পূর্ব-বঙ্গীয় গ্রাম্যভাষায় এই প্রহসনের অপ্রধান চরিত্রগুলির কথা বলেছেন। এই ভাষা ব্যবহার করার ফলে চরিত্রের ক্রোধের প্রকাশ রূপায়িত হয়েছে।
যেমন—হানিফের উক্তি—“এমন গরুখোর হারামজাদা কি হিদুদের বিচে আর দুজন আছে?” ফতেমার ভয় ভান করার ভাষাও বেশ বাস্তব— “না ভাই, মোরে বড় ডর লাগে, সাপেই খাবে না কি হবে, কিছু কতি পারি নে।” ভক্তপ্রসাদের কামলোলুপতার সার্থক প্রকাশ ঘটেছে তার সংলাপে। পাচীকে দেখে স্বগতোক্তি করেছেন— “মেদিনী হইল মাটি নিতম্ব দেখিয়া / অদ্যাপি কাঁপিয়া ওঠে থাকিয়া থাকিয়া।” ভক্তপ্ৰসাদ সাজগোজের পর যে ভাষায় কথা বলে তাও তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে “এই তাজ্টি মাথায় দেওয়া ভালই হয়েছে। নেড়ে মাগীরা এই সকল ভালবাসে; আর এতে এই একটা আরও উপকার হচ্যে যে টিকিটা ঢাপা পড়েছে এমনকি ভক্তপ্রসাদ ভাঙ্গা শিব মন্দিরে তার অনাচারের স্থান বেছে নিয়ে সাফাই গায়— “অ্যাঁ— মন্দিরের মধ্যে? হাঁ; ভগ্নশিবে তো শিবত্ব নাই, তার ব্যবস্থাও নিয়েছি। বিশেষ এমন স্বর্গের অপ্সরীর জন্য হিন্দুয়ানি ত্যাগ করাই বা কোন্ ছার?” এই সময় বাচস্পতির গম্ভীর স্বর— “বটে রে পাষণ্ড নরাধাম দুরাচার” —তার স্বভাব গাম্ভীর্যের কথা জানায়। আবার হানিফের প্রহারে ভক্তপ্রসাদ যখন অচেতন তখন বাচস্পতি যে গান গায় তা প্রহসনের নাটকীয়তা সঞ্চার করে—“মায়ের এই তো বিচার বটে, বটে বটে গো আনন্দময়ি– এই তো বিচার বটে।”
এই নাটকটি মূলত হানিফ আর ভক্তপ্রসাদকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। ধর্ম সম্পর্কে ভক্তপ্রসাদের বক্তব্য তার চরিত্র অনুযায়ী —“ভাল, আমি শুনেছি যে, কলকেতায় নাকি সব একাকার হয়ে যাচ্ছে…… শুনেছি কলকেতায় নাকি বড় বড় হিন্দু সকল মুসলমান বাবুর্চী রাখে।” এমন কি অধর্মাচরণের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন— “এই দেব ব্রাহ্মণের প্রতি অবহেলা, গঙ্গাস্নানের প্রতি ঘৃণা, এই সকল খ্রীষ্টিয়ানী মত”। ভক্তের বকধার্মিক রূপটি অনাবৃত হয় নিম্নোক্ত সংলাপে— “আমার বোধ হয় অম্বিকাপ্রসাদ কখনই এমন কুকর্মাচারী হবে না- সে আমার ছেলে কি না।”
প্রহসনের অন্যান্য চরিত্রগুলিও তাদের সংলাপে যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে গল্পের পূর্ণতায় দ্বন্দ্বমূলক প্রকৃতিতে সংলাপের প্রাণ চাঞ্চল্যে।
“এ প্রহসনের সংলাপে গ্রামীণ মানুষের মুখের ভাষাকে স্থান দেওয়া হয়েছে, যশোর অঞ্চলের কথ্য ভাষাকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে তাকে কিছু ঘষে মেজে নিয়েছেন। নীলদর্পণের সংলাপে প্রায় একই অঞ্চলের কথ্য গদ্যকে অবলম্বন করা হয়েছে। দীনবন্ধু ঐ ভাষার অমার্জিত রূপ যথাযথ রাখতে চেষ্টা করেছেন, মধুসূদন তাকে পরিশীলিত করে ‘সাহিত্যিক’ করে তুলেছেন। মূলের স্বাদ গন্ধ রেখেছেন, সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিকতাজনিত দুর্বোধ্যতা দূর করার অনেকাংশে সকল চেষ্টাও করেছেন।
সংলাপের পূর্বোক্ত সাধারণ কাঠামোর মধ্যে শ্রেণীঘটিত বিশিষ্টতা এবং ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের ছাপও লক্ষ্য করা যায়। পুঁটি ও ফতেমার ভাষায় একটা বাড়তি মেয়েলি ঢঙের স্পর্শ আছে। ফতেমা ও হানিফের কথাবার্তায় মুসলমান সমাজে প্রচলিত কিছু ফার্সি শব্দ এসে গিয়েছে। এদের ভাষা কৃষকের মুখের কথা। তার উপরে হানিফের স্বভাবগত বলিষ্ঠতা ও ক্রোধ তার সংলাপকে কিছুটা দীপ্ত করে রেখেছে। বাচস্পতিতে টুলো পণ্ডিতের ভাষাবিন্যাস যেমন আছে, ভক্তপ্রসাদে তেমনি সমাজের কথ্যরীতির কিছু পরিমার্জনা লভ্য। অবশ্য শেষোক্ত ব্যক্তির লাম্পট্যাদি ব্যাধি ও চরিত্রবিকার তার কৃত্রিম উপমাচয়ন ও কবিতা আবৃত্তিতে প্রতিফলিত।
স্বল্প কয়েকটি প্রাণবন্ত চরিত্র এবং সার্থক জীবন্ত সংলাপ ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’র পূর্ণাঙ্গ কাহিনীটিকে প্রচলিত প্রহসনের সামান্যতার বহু ঊর্ধ্বে স্থাপিত করেছে।”— [ নাট্যকার মধুসূদন – ক্ষেত্র গুপ্ত।]
আলোচ্য প্রহসনটি নাটকীয় কলাকৌশলে ও নাট্যরসে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে মূলত সংলাপের জন্য। প্রহসনের সংলাপে যে বৈশিষ্ট্য—স্পষ্টতা, সহজাত সংক্ষিপ্ততা, সরসতা সবগুলিই ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রো’ তে উপস্থিত। গ্রাম্য ভাষা ব্যবহারে প্রহসনের গ্রামীন চরিত্রগুলি জীবন্ত হয়ে উঠেছে এবং পরবর্তীকালে তার এই বৈশিষ্ট্য অন্যান্য প্রহসনে প্রতিফলিত হয়েছে।
Leave a comment