‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনে মূল চরিত্রগুলির পাশাপাশি অনেকগুলি অপ্রধান চরিত্রের অস্তিত্ব আছে। প্রহসনের মূল কাহিনীতে এই চরিত্রগুলির স্থান ও গুরুত্ব অতি-সংক্ষিপ্ত হলেও চরিত্রগুলি প্রহসনের কাহিনী ও প্রধান চরিত্রকে গতি ও পরিণতি দানে কিছুটা ভূমিকা নিয়েছে একথা অস্বীকার করা যায় না। এই অপ্রধান পুরুষ চরিত্রগুলি হল- বাচস্পতি, গদাধর, রাম, আনন্দ ও অম্বিকাপ্রসাদ।

বাচস্পতি :

মধুসূদনের বাচস্পতি মর্ত্য পৃথিবীর মানুষ। জমিদার তার ব্রহ্মত্র দখল করে নিয়েছে বলে সে সুযোগ পেলে তার ওপর প্রতিশোধ নিতে দ্বিধাহীন এবং সে তাও করেছে; কিছু অর্থাগমেরও ব্যবস্থা করেছে। তবে হানিফের মধ্যে প্রাণের প্রাচুর্য যতখানি বাচস্পতি চরিত্রে ততখানি নেই। বাচস্পতি মূলত বুদ্ধির উপর নির্ভরশীল।

সমালোচকের মতে–“বাচস্পতির চরিত্র সৎব্রাহ্মণের চরিত্র। দারিদ্র্যের সুযোগে তার সর্বস্ব দখল করে নিয়েছেন গ্রামীণ জমিদার ভক্তপ্রসাদ। প্রতিবাদ করার সাহস পান নি তিনি কিন্তু বুদ্ধির জোরে অনায়াসে তিনি সে জমিদারের কাছ থেকে তাঁর আপন সম্পত্তি উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছে। নাটিকায় পঞ্চানন বাচস্পতি বুদ্ধিদাতার কাজ করে হানিফের মত গোঁয়ার গোবিন্দকে সুশৃঙ্খল পথে চালিত করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাহিনীকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন। পঞ্চাননের কথামতই ভক্তপ্রসাদকে হানিফ দু’এক ঘা লাগিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। নিজের খুশী অনুসারে হানিফ কাজ করলে ভক্তপ্রসাদের নিস্তার ছিল না।”

গদাধর :

গদাধর চরিত্রটি ক্ষুদ্র কিন্তু জীবন্ত। তার মনিবের কোনো কিছুই তার অজানা নেই। মনিবের চরিত্রের অন্ধিসন্ধি জানে বলেই সেই পথে পয়সা রোজগারের সুযোগ সে পুরোদস্তুর কাজে লাগায়। তার চরিত্রের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল তার কর্তার কামব্যাধির লক্ষণগুলো মনে মনে উপভোগ করা। গদাধরের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ক্ষেত্র গুপ্ত তাঁর নাট্যকার মধুসূদন গ্রন্থে বলেছেন—“তার কবিতা আবৃত্তি, ঘন ঘন মালাজপা, তাজ দিয়ে টিকি ঢাকা, নব কার্তিক সেজে অভিসারে চলা, মুসলমান বাবুর্চির নিন্দা করে মুসলমানীর দেহভোগের ব্যবস্থা- যাবতীয় অসঙ্গতি – সে লক্ষ্য করে। তার স্বগত সংলাপে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মন্তব্যে এই অসঙ্গতির উপরে তীব্র কটাক্ষপাত করা হয়েছে। তবে সে কোনো ছদ্মবেশী নীতিপ্রচারক নয়। বুড়ো কর্তার চরিত্রের অসঙ্গতি তার কাছে নীরব হাস্যের সামগ্রী। কিন্তু মনে মনে বোধ হয় ঐরূপ জীবনের স্বপ্নই সে দেখে। কর্তার গদিতে শুয়ে তামাক খাওয়ায় কি তার চকিত পরিচয় নেই?”

গদাধর চরিত্র চিত্রণে নাট্যকার মধুসূদন চিরপ্রচলিত রীতিই অবলম্বন করেছেন। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে চাকর-বাকর, দাস-দাসীদের যে রূপের চিত্রণ লক্ষ করি আলোচ্য প্রহসনেও তা অনুসৃত। মনিবের অধঃপতনে তার উল্লাসে চারিত্রিক type ঢঙটিকে প্রকাশ করে কিন্তু বাবু ভক্তপ্রসাদ যখন নেড়ের ভাত খাওয়া সম্পর্কে ঘৃণা প্রকাশ করেন তখন গদাধরের উক্তি— নেড়ের মেয়ে সম্ভোগে আপত্তি নেই, ভাত খেলে জাত যায় এবং পরিশেষে ‘বাবুর কি বুদ্ধি’ প্রভৃতি গদাধরের চারিত্রিক স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করেছে।

রাম:

অনুগত ভৃত্য রাম তার ফাই-ফরমাস খাটে। বিছানা ঠিক করে দেওয়া, তামাক সাজা, গা-হাত-পা টিপে দেওয়া ইত্যাদি তার কাজ। কর্তাবাবু উপস্থিত না থাকলে গদা একদিন ভক্তপ্রসাদের বিছানায় বসে অম্বুরী তামাক খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে রাম তার আয়োজন করে দেয়; যদিও তার অনিচ্ছা ছিল। কিন্তু বাবুদের মতো গদাধরের তামাক খাওয়ার ভঙ্গিমা দেখে সে বলে- ‘তুই বাবুদের মতন তামাক খেতে কোথায় শিখলি রে? এ যে ছাতারের নেত্য।’ এখানে তার নিজস্ব ঢঙে উপমা প্রয়োগের ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। আবার ভক্তপ্রসাদ আসছে দেখে ‘ঐ দেখ কত্তাবাবু আস্‌চে’ বলে তাকে সাবধানও করে দেয়।

আনন্দ ও অম্বিকাপ্রসাদ :

আনন্দ কলকাতায় থেকে লেখাপড়া করে। সে ভক্তপ্রসাদের পুত্র অম্বিকাপ্রসাদের সহপাঠী। দুজনের একই গ্রামে বাড়ি এবং উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট অন্তরঙ্গতা আছে, উভয়ে উভয়ের খোঁজ খবর রাখে। ভক্তপ্ৰসাদ আনন্দকে ভালো-ভদ্র ছেলে বলে জানে। তার আচরণ যথার্থই বিনীত ও ভদ্র। আনন্দপ্রসাদ একবার গ্রামে বেড়াতে এলে ভক্তপ্রসাদ তার কাছে পুত্রের খবরাখবর নেন। সে জানায়, তার মত মেধাবী ছাত্র হিন্দু কলেজে প্রায় বিরল। কিন্তু কলকাতায় থাকলে অম্বিকাপ্রসাদের মতিগতি বিগড়ে যেতে পারে ভেবে ভক্তপ্রসাদ ছেলেকে গ্রামে ফিরিয়ে আনতে চায়। কিন্তু আনন্দ বন্ধুকে ভালোবাসে বলে তা করতে নিষেধ করে। আনন্দপ্রসাদ ভক্তপ্রসাদের কাছে অধর্মাচরণ কি জানতে চাইলে সে বলে “ব্রাহ্মণের প্রতি অবহেলা, গঙ্গাস্নানের প্রতি ঘৃণা, এই সকল খ্ৰীষ্টিয়ানী মত।” আনন্দ জানায়, এ সকল কথা সে ঠিকমত বলতে পারবে না। তবে কলকাতায় যে এ সমস্ত নানা কাজকর্ম হচ্ছে তা জানাতেও ভোলে না। সে বেশ সত্যবাদী, বিনয়ী ও উপকারী বন্ধু।