মধুসূদন দত্ত ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনটির প্রথমে নামকরণ করেছিলেন ‘ভগ্ন শিবমন্দির’। কবি মধুসূদনের ব্যঞ্জনাগত নামকরণে এই নাটিকার বক্তব্য বেশ তীক্ষ্ণতা লাভ করেছিল। ভগ্ন শিবমন্দির নামকরণের পশ্চাতে কয়েকটি বিশেষ কারণ আছে বলে মনে হয়। যেহেতু এক ভগ্ন শিবমন্দির এই নাটকের ক্লাইমেক্সের পশ্চাৎপট সেই কারণে এইরূপ নামকরণ করা হয়েছে। এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র এক প্রাচীন ব্যক্তি, জমিদার ভক্তপ্রসাদ যে প্রাচীন বলেই বহু ক্ষতের দাগ রয়েছে তার মধ্যে। ভগ্ন মন্দিরের মধ্যে যেমন থাকে বহু নোংরা আবর্জনা, ভক্তপ্রসাদের মধ্যে তা-ই বিরাজিত। সেদিক থেকে তাঁকে এবং ভগ্ন শিব মন্দিরকে অভিন্ন ভাবা হয়েছে এবং বক্তব্যে গভীরতা এসেছে। প্রহসনের নামকরণে সূক্ষ্ম রেখা কার্যকরী নয় একথা পাইকপাড়ার সিংহ ভ্রাতারা বুঝতেন তাই একটু ইঙ্গিত বজায় রেখে কিছুটা স্থূলভাবে নাটিকার নামকরণ করেন ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’। ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ এই নামকরণ করেন। প্রহসনটির নামকরণ প্রসঙ্গে অশোককুমার মিশ্র তাঁর ‘বাংলা প্রহসনের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন- “নামকরণটি সার্থক, কেননা নাটকের মূল কাহিনী এক ধর্মধ্বজী জমিদারকে নিয়ে। সালিকের ঘাড় বৃদ্ধ বয়সে রোঁয়া বিহীন হয়। রোঁয়া যৌবনের প্রতীক। বুড় বয়সে ঘাড়ে রোঁয়া – ময়ূর পুচ্ছধারী কাকের আচরণের সমতুল্য। ভক্তপ্রসাদের এই আচরণের বৈপরীত্য এখানে মূল অবলম্বন। সুতরাং এই নাটিকার নামকরণ সার্থক।
নট ও নাট্যকার উৎপল দত্ত কিন্তু ‘ভগ্ন শিবমন্দির’ নামটি সমর্থন করে বলেছেন— “মধুসূদন এই প্রহসনের নাম দিয়ে ছিলেন ভগ্ন শিবমন্দির অর্থাৎ একটা অতীত বিধ্বস্ত সমাজব্যবস্থার চিত্রকল্প …… প্রাচীন জমিদারীর বর্তমান বন্ধ্যা অবস্থা, পুরাতন ধর্মব্যবসায়ের বর্তমান দেউলিয়া চেহারা যে সমাজ ইতিমধ্যে মরে গেছে, বিলুপ্ত হয়েছে ভগ্ন শিবমন্দির তার অপূর্ব প্রতীক হতে পারত।”
‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ (সপ্তম খণ্ড) গ্রন্থে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নামকরণটি সমর্থন করে বলেছেন— “মূল ঘটনা একটি পরিত্যক্ত শিবমন্দিরে হয়েছিল বলে বোধহয় তিনি প্রহসনটির এই নামকরণ করেছিলেন। কিন্তু পাইকপাড়ার ছোট রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ এর নতুন নামকরণ করেন ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’। এই নামটি কেন্দ্রীয় বিষয়টিকে চমৎকার ফুটিয়েছে। সালিক পাখি বুড়ো হয়ে গেলে তার ঘাড়ের রোম ঝরে পড়ে। এই দৃষ্টান্তে সুরসিক ছোট রাজা বোধহয় বলতে চেয়েছিলেন, মানুষ বৃদ্ধ হলে তার ঘাড়ের রোঁয়া অর্থাৎ কামপ্রবৃত্তি দূর হয়। কিন্তু কোনো কোনো কদাচারী বৃদ্ধের বয়স বাড়লেও কাম নিবৃত্তি হয় না, যৌবনকালের মতই তীব্র থাকে।
ক্ষেত্র গুপ্তও তাঁর ‘নাট্যকার মধুসূদন’ গ্রন্থে ‘ভগ্ন শিবমন্দির’ নামকরণ সমর্থন করে লিখেছেন— “মধুসূদন একটি চিঠিতে বুড় সালিকের একটি পৃথক নামের উল্লেখ করেছিলেন— ‘ভগ্ন শিবমন্দির’। লিখবার সময় এই নামই দিতে চেয়েছিলেন, ‘যখন ছাপা হয়ে বেরুল দেখা গেল বর্তমান নামই রয়েছে। নাম কেন বদলানো হল জানা যায় না। এমন হওয়া অসম্ভব নয়, লেখকের পৃষ্ঠপোষকরা হিন্দু সমাজের মাথা ছিলেন এবং ‘ভগ্ন শিবমন্দির’ নামটি তাঁদের পছন্দ হয় নি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে নাটকের চূড়ান্ত কাণ্ড ভাঙা শিবমন্দিরের কাছে ঘটেছিল বলেই এরকম নামকরণ, কিন্তু এর গভীরতর তাৎপর্য অনুভব করা যায়। একটা বিশেষ ভাঙা মন্দিরের সামনে কি ঘটল, তার চেয়ে বড় কথা ভক্তপ্রসাদেরা তাদের ভণ্ডামি, মিথ্যাচার আর সনাতন আদর্শের নামে তার সত্যে নিত্য আঘাত করে হিন্দুদের মনুষ্যত্বের আদর্শ শিবমন্দিরটি রোজই ভাঙছিল। এ প্রহসন তাই ‘ভগ্ন শিবমন্দিরের’ কাহিনী।”
আলোচ্য প্রহসনটির ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায় ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনে নাটক গড়ে ওঠে ভক্তপ্রসাদ, হানিফ, ফতেমা, পুঁটি, বাচস্পতিকে কেন্দ্র করে। জমিদার ভক্তপ্রসাদ কৃপণ অথচ ধনী জমিদার, সে ধর্মধ্বজী অথচ ব্যভিচারী। মধুসূদন এমন-ই এক চরিত্রের স্বরূপ উন্মোচনের জন্য এই প্রহসনটি রচনা করেন। জমিদারের কুকর্মের দুই অনুচর পুঁটি আর গদাধর। পিতাম্বর তেলীর যুবতী কন্যা পাঁচীর প্রতি লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে তাকে পেতে চাইলে গদাধর জানায় অর্থে সব হয়। জমিদারের সহচর পুঁটি ফতেমার সঙ্গে দেওয়া নেওয়া সংক্রান্ত কথাবার্তা সেরে ফেলে। ফতেমা হানিফের উনিশ বছরের সুন্দরী যুবতী স্ত্রী। তাকে পাবার আশায় ভক্তপ্ৰসাদ উল্লসিত হয়। হানিফ ফতেমাকে সাবধান করে দেয়, বুড়ো যেন তার গায়ে না হাত দেয়। পুঁটি ফতেমাকে জানায় ভক্তপ্রসাদের সঙ্গে শিবের মন্দিরে তারা যাবে। ভক্তপ্রসাদ সাজসজ্জা শেষ করে নির্দিষ্ট সময়ের বহুপূর্বে ভাঙা শিব মন্দিরে উপস্থিত হন। মন্দিরের অশ্বত্থ গাছের আড়ালে পঞ্চানন আর হানিফ লুকিয়ে থাকে। পঞ্চাননের নির্দেশ পেলেই হানিফ ভক্তপ্রসাদকে উত্তম মধ্যম শিক্ষা দেবে। ফতেমাকে সঙ্গে নিয়ে পুঁটি অরণ্য সঙ্কুল ভাঙা মন্দিরের কাছে এলে সে ভয়ের ভান করে। গদাধরকে বাইরে থাকতে বলে ভীতা ফতেমার আঁচল ধরে ভক্তপ্রসাদ তাকে প্রেম জানাতে যান। এই সময় মন্দিরের ভিতরে গম্ভীর আওয়াজ শোনা যায় ‘বটেরে পাষণ্ড নরাধম দুরাচার’ ভূত-মনে করে পুঁটি মূৰ্চ্ছা যায়।
ফতেমাকে ছেড়ে ভক্তপ্রসাদ ভগবানের নাম জপ করে রুষ্ট শিবকে সন্তুষ্ট করতে চান। এমন সময় কাপড়ে মুখ ঢেকে হানিফ এক চড়ে গদাধরকে মাটিতে ফেলে দেয় আর পুঁটির কপালেও জোটে লাথি। ভক্তপ্রসাদ হানিফের ঘুসিতে যখন কাতর তখন সে, দ্রুত প্রস্থান করে। আর তখনই, পঞ্চানন প্রবেশ করে। সে জানতে চায় হানিফের স্ত্রী এখানে কেন? ভক্তপ্রসাদ পঞ্চাননকে তার ব্রহ্মত্র জমি ফিরিয়ে দেবার কথা বলে এবং পঞ্চাশ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একথা কাউকে বলতে নিষেধ করেন। অতঃপর হানিফ প্রবেশ করে। এবার হানিফের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য তাকে দুশ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। সমুচিত শিক্ষা পেয়ে ভক্তপ্রসাদ নারায়ণের কাছে প্রার্থনা করেন, “এমন দুর্মতি যেন আমার কখনও না ঘটে।” শিব মন্দিরের দৃশ্যটি নাটকে গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে যে এখানে ঘটনার শীর্ষবিন্দু স্থাপিত হয়েছে। উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে আর বিষয়টি প্রহসনটিকে ক্লাইম্যাক্সের দিকে নিয়ে গেছে। এরপর উত্তেজনার তীব্রতা হ্রাস পেয়ে যবনিকা ঘটেছে।
আসলে প্রহসনের ঘটনা কোথায় ঘটল তা না দেখিয়ে যে ঘটনা ঘটল তার কারণ জানানোই প্রহসনকারের উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য পাঠকের গোচরে আনার জন্যই পূর্ববর্তী নামকরণ না রেখে ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ করা হয়েছে। ভক্তপ্রসাদের চরিত্রের মধ্য দিয়ে তার বৈষম্য ও বৈপরীত্যের উপাদানগুলি তুলে ধরা হয়েছে। ভক্তপ্রসাদ সনাতন ধর্মের মূর্তিমান প্রতিনিধি, অথচ ভাবনা, কামনা ও আচরণে তিনি অধর্মের ঘৃণ্যতম প্রতীক। সে বয়সে বৃদ্ধ অথচ কামলোলুপতায় হিতাহিতজ্ঞানশূন্য। সে দরিদ্র প্রজাকে শোষণ করে অথচ লাম্পট্যবৃত্তির জন্য মুক্তহস্তে টাকা খরচ করে ভক্তপ্রসাদের মধ্যে লালসার নগ্ন রূপটি নাট্যকার তুলে ধরেছেন আলোচ্য প্রহসনে। নারীদেহের প্রতি তার আগ্রাসী চাউনি, অবৈধ সম্ভোগের আশায় তার রোমাঞ্চিত প্রতীক্ষা, সাজসজ্জা, প্রসাধন ইত্যাদি যেন ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ ওঠার মতো। তাই ‘ভগ্ন শিবমন্দির’ অপেক্ষা বর্তমানে প্রচলিত নামটি সঙ্গত ও সার্থক বলে মনে হয়।
Leave a comment