কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি তারিখ বিহীন লেখা চিঠিতে মাইকেলের এই নাটকটিকে ‘ভগ্ন শিবমন্দির’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে অনুমান করা চলে নাটকটির এমন নামকরণ সম্ভবত করেছিলেন স্বয়ং নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মূলত পাইকপাড়ার রাজারা—যথা প্রতাপ চন্দ্র সিংহ এবং ঈশ্চরচন্দ্র সিংহ, মাইকেলের শুভানুধ্যায়ী ছিলেন। তাঁদের নাট্যানুরাগের জন্যই নিত্যনূতন নাট্যরচনায় মাইকেল মেতে ওঠেন। এই রাজাদের ব্যয়েই আলোচ্য প্রহসনটি মুদ্রিত হয়। নানাপ্রকার বাধার ফলে শেষে নাকটটি আর অভিনীত হয়নি। রাজা ঈশ্চরচন্দ্র সিংহ মহাশয় স্বয়ং প্রহসনটির নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেন—“বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’। এটি অবশ্য আলোচ্য প্রহসনটির শেষ পঙক্তি। এথেকে পাঠক মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, এই নাম পরিবর্তন কতখানি সাহিত্য শিল্পসম্মত হয়েছে। এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বিশদ পর্যালোচনায় অবতরণ করতে হবে।
প্রথমেই দেখতে হবে ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নামের দ্বারা নাটকের কোন্ দিকটি প্রাধান্য পেয়েছে। নাটকটির কাহিনি বিন্যাসের ধারা আলোচনাকালে, প্রথমেই স্বীকার করতে হবে এই নামটি একটি বাংলা ইডিয়ম। ড. সুকুমার সেন মহাশয় তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ বইতে এ বিষয়ে একটি প্রাসঙ্গিক মন্তব্য করেছেন। তখনকার প্রহসন ও লঘুরসের নাটকগুলির নামকরণে দেখা যেত–বাংলা ছড়া প্রবাদ ইডিয়মের প্রয়োগ। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে মাইকেল এই প্রহসনটি লেখেন। প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮৬০ খ্রিঃ বাংলা ১২৬৬ সালে। ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ যখন এর নাম পরিবর্তন করেন, তখন কিন্তু নামের ক্ষেত্রে ছড়া প্রবাদ ইডিয়মের প্রয়োগ ব্যাপকভাবে শুরু হয়নি। বরং বলা যায়, মাইকেলের নাম ও খ্যাতির কারণেই অন্যান্য পরবর্তী নাটকের নামকরণের ক্ষেত্রে এই নীতির ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়। রাজা ঈশ্চরচন্দ্র সিংহ কেন এইপ্রকার নামকরণের আগ্রহী হলেন, তা বিশদভাবে দেখা যেতে পারে।
বৃদ্ধ ব্যক্তির যুবাবৎ আচরণকে নির্দেশ করতে আলোচ্য নামকরণটি করা হয়েছে। শালিক পাখির জীবনালোকে এখানে মানুষের একটি প্রবৃত্তি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বৃদ্ধের যুবাবৎ আচরণ বলতে যুবাবৎ বেশভূষা এবং যুবাবৎ প্রেম প্রণয়লীলায় উৎসাহ ও সচেতনতাকে প্রকাশ করা হয়েছে। বৃদ্ধ ভক্ত-প্রসাদের মধ্যে নারীসঙ্গ লুষ্কতা অত্যন্ত প্রখর। নাট্য ঘটনার মূল বিষয়টিই তা নিয়ে গড়ে উঠেছে। কলকাতার তৎকালীন বাবুসমাজের সঙ্গে স্বভাবতই পাইকপাড়ার রাজাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। তাদের চালচলন ও বিলাস-বৈভব সবই রাজাবাবুদের চেনা ও দেখা। স্বভাবতই গ্রামবাংলার একজন স্বচ্ছল ভূস্বামী প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে গিয়ে কলকাতার বাবুসমাজের বিলাসলীলাকেই প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁরা। কলকাতায় যখন এইপ্রকার বাবুকালচারের আবহাওয়া বহমান ছিল তখন গ্রামবাংলার স্বচ্ছল জমিদারদের মধ্যেও নানা প্রকার দুর্নীতি, অন্যায় লালসার বন্যা বয়ে যাচ্ছিল। এমন একটা চিত্র প্রকট হয়ে উঠেছে আলোচ্য প্রহসনটিতে।
‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নামকরণের মধ্যে একটু ব্যঙ্গের তির্যকতা আছে। পাইকপাড়ার রাজারা নৈতিক বিশুদ্ধতা ও দেশহিতৈষণার বোধ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন। যেহেতু মাইকেল তাঁর প্রথম প্রহসনটিতে তৎকালীন কলকাতার তরুণ প্রজন্মকে ব্যঙ্গ করেছেন, তারই সঙ্গে সমতা রক্ষা করবার জন্য এবার রাজাবাবুরা এই ব্যঙ্গাত্মক ইডিয়মটি বেছে নেন। শহরের সঙ্গে গ্রাম সংস্কৃতির বিচ্ছেদ এত প্রকট হয়ে ওঠেনি তখন। শালিকের জীবনের অগ্রগতির যে বিশেষত্ব গ্রামের মানুষদেরই বিশেষ নজরে পড়ার কথা, শহরের মানুষরাও সে বিষয়ে যথেষ্ট অবহিত থাকতেন। ছড়া প্রবাদ চিরকাল বাঙালির জীবনে নানাভাবে যুক্ত। ছড়া প্রবাদ চিরকাল বাঙালির জীবনে নান হাস্য পরিহাস প্রকাশের উপায় রূপে ব্যবহৃত। এসব কারণেই এইপ্রকার বিশেষত্ব জ্ঞাপক ইডিয়ম ব্যবহার করা হয়েছিল।
সর্বোপরি, প্রহসন যেহেতু হাস্যরসাত্মক নাটক সেইহেতু গম্ভীর ভাবদ্যোতক কোনো নামকরণের অপেক্ষা পরিহাসমূলক নামকরণটিই তখনকার মানুষ বেশি পছন্দ করেছিলেন। ফলত আলোচ্য প্রহসনটির পূর্ববর্তী নামের পরিবর্তন সাধন করে বর্তমানের এই নামকরণটি করা হয়েছিল। তবে এই প্রকার নামকরণের মধ্যে ভক্তপ্রসাদের নারী বিলাস এবং সেই নারী বিলাসের কারণে শাস্তি পাবার ব্যাপারটি শ্লেষাত্মকমণ্ডিত হয়ে হাস্যরস বিশেষভাবে প্রকট হয়েছে। তাই, নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে আলোচ্য প্রহসনটির পরিবর্তিত নামকরণটি যথাযথ ও সার্থক হয়েছে।
Leave a comment