ভক্তপ্রসাদের নামকরণের মধ্যেই নিহিত তার চরিত্রের আসল তাৎপর্য। নাটকটির মধ্যে তাঁকে তিনবার দেখা যায়, তিনবারই সন্ধ্যার পরিবেশে। সন্ধ্যাবেলায় তাঁর আহ্নিক কৃত্যের সময় ‘ভক্ত’ হিসেবে তিনি কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ শুনলে ‘ঠাকুর দর্শন’ করতে যান। নিজেই তিনি নিজের চরিত্রের বিবরণ দেন—“বাইরে ছিল সাধুর আকার/ঘণ্টা কিন্তু ধর্ম ধোয়া …. ভণ্ডামীতে চারটি পোয়া।।” এই ভক্তের মধ্যে একদিন আসল ভক্তের উদ্বোধন ঘটল। তাঁর অপরাধের জন্য ভূতরূপী এক নির্বিশেষ সত্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মধ্যে এক নতুন ভক্তপ্রসাদের আবির্ভাব ঘটল।
দেবতার প্রসাদপ্রার্থী—‘ভক্তপ্রসাদ’। অপরাধের জন্য তিনি যে প্রহৃত হয়েছেন, তা স্থলভাবে হাস্যরসের সঞ্চার করে। তাঁর শাস্তি তিন রকমের দৈহিক, জাতিগত ও মাসাজিক এবং আর্থিক। প্রথম ও তৃতীয় দিকটি বড়ো নয়, দ্বিতীয়টি বড়ো। ভক্তপ্রসাদকে সবচেয়ে দুর্বল ও অসহায় করেছে এই দ্বিতীয় দিকটাই। সমাজে তিনি একজন প্রতিষ্ঠাবান ব্যক্তি। হিন্দুয়ানীর একজন ধ্বজাধারী। হানিফ এসে যখন বিদ্রুপের সুরে তাঁকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করে, কিংবা স্বয়ং ফতেমাই, তখন তিনি সবচেয়ে লজ্জিত হয়েছেন। তাঁর ভয়ও সবচেয়ে এইখানেই। কেবল যদি তাঁর দৈহিক ও আর্থিক সাজা হত তবে তা কখনোই সঠিকভাবে তাঁর প্রায়শ্চিত্তের কারণ হতে পারত না।
অবশ্য অপরাধবোধ জাতীয় বিবেকদংশন এবং সেজন্য কিছু দ্বন্দ্ব সংশয় ভক্তপ্রসাদকে মর্যাদাশীল চরিত্র করে তুলেছে। তাঁর ভেতরে ভেতরে, সামান্য হলেও এই দ্বিধা সংশয় তাঁর পরিণতিকে আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত কিছু করে তোলেনি। এজন্য তাঁকে Round character রূপে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এছাড়াও তিনি যৌনসচেতন, সৌন্দর্য প্রিয় ও কাব্যরসিক। এসবই তাঁকে অধিকতর কলঙ্কের হাত থেকে ক্ষীণভাবে রক্ষা করেছে।
ভৃত্য গদাধরের সঙ্গে জুটি চরিত্র রূপে কিছু হাস্যরসের উৎসার ঘটলেও, তাঁর চরিত্রের কিছু প্রকাশ ঘটলেও, শেষে বিচারে তাতে তাঁর সম্মান কিন্তু বাড়েনি। গদাধরই তাঁর চরিত্রের Commentator | তারই মন্তব্যের আলোকে নাট্যকার তাঁকে প্রদর্শন করেছেন। গদাধরই তাঁকে প্রাক্তন প্রেমিকার ইচ্ছের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, ফতেমার রূপের ব্যাখ্যান করে, এবং রূপ থেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলে সেইই মস্তব্য করে—“আবার ভাব লাগলো দেখছি, বুড়ো হলে লোভাত্তি হয়…”, কিম্বা ভক্তপ্রসাদ ‘হরিবোল’ বললে সে বলে— ‘এখন আল্লা আল্লা বল’। ভক্ত ভালো মানুষ হবার প্রতিজ্ঞা করলে তার মন্তব্য—“তবেই তো গদার পেশা উঠল।” অর্থাৎ একার্থে গদার দ্বারাই ভক্তপ্রসাদ পরিচালিত।
সর্বোপরি ভক্তপ্রসাদ চরিত্রখানি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লেখকের উদ্দেশ্যের প্রতি দৃকপাত করতে হয়। কারণ, ভক্তপ্রসাদকে হেয় প্রতিপন্ন করাই ছিল মূল লক্ষ্য। নাটকেও তা দেখানো হয়েছে—কেউই তাঁর সম্পর্কে ভালো কথা বলেনি। দাসী ও ভৃত্যের কাছে ভক্তপ্রসাদকে নৈতিক দিক থেকে যতখানি হেয় প্রতিপন্ন করা যাবে, ততই ভালো মানুষ হবার প্রতিজ্ঞা তাঁর মধ্যে কার্যকরী হবে। সেই দাসীভৃত্যের সম্মুখেই ভক্তপ্রসাদ প্রায়শ্চিত্ত করতে লজ্জাবোধ করেননি। তাঁর মধ্যে অসাধুতার পরিমাণ বেশি বলেই সাধু হবার মানসিক গুণ উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে।
Leave a comment