বাংলার কাব্য সাধনায় নব যুগের সূচনায়, মাইকেল মধুসূদন হলেন প্রথম মানবীয়তার সার্থক উদ্গাতা। জীবন রসিকতার অজস্রতা, মানবিকতার বাহুল্যে মধুকবির দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। তাই তিনি সাহিত্য সাধনার সূচনার পৌরাণিক চরিত্রগুলির অত্যুজ্জ্বল মহিমার কুহেলি গুণ্ঠনের নির্মম অপসারণে স্বাধীন ও মুক্ত মন দিয়ে তাদের নতুন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে প্রয়াস পেয়েছেন। বস্তুত স্বর্গলোকের নিঃসীম মহিমায় নয়, সত্যলোকের সীমায়িত সংকীর্ণতার প্রতিই কবির অন্তরঙ্গ দৃষ্টি সমধিক। তাই তিনি ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ ব্রজাঙ্গনা কাব্যের মতো অপূর্ব সৃষ্টিতে মত্ত হতে পেরেছিলেন। ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ প্রতিভাধর কবির জীবন সায়াহ্নের পরিণততম কাব্য কীর্তি। এখানে নারী চরিত্র অঙ্কনে মধুকবির অপূর্ব মানবপ্রীতির নিদর্শন মেলে। তবে মর্ত্যজীবন সমুদ্রের মাঝে মাঝে অমর্ত্য আকাশের ছায়াপাত ঘটে থাকে, সেই সমুদ্র সর্বদাই বাত্যাবিক্ষোভ পীড়িত কিংবা উদ্দাম তরঙ্গ সফেন নয়। মাঝে মাঝে তা নীরব শাস্ত শ্রীও ধারণ করে থাকে। তাই মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যে কবির আন্তরিক সমাজ সচেতনতার, বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গি এবং সর্বোপরি অপূর্ব মানব মুখীনতার উদার ব্যপ্তির অবকাশেও উচুঁ মুখে বাধা রোমান্সে ছটা এবং অবাস্তবতার ছায়াপাত ঘটেছে।
বীরাঙ্গনা কাব্যের পত্রিকাগুলিকে উপস্থাপিত নারীপ্রেমের বর্ণনালেখ্য আমাদের সমাজের যুগসতি সংস্কার জড়তার বল্মীক স্তূপের পাশেই কলস্রোতা, সামাজিক সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণের পরিমিতিতে এই উদার ও উদাত্ত প্রেমের ব্যাপ্তি ও গভীরতা উপলব্ধি করা সম্ভব নয় পিতৃতুল্য ঋষি কণ্বমুনির অনুমতি না নিয়েই শকুন্তলা ও দুষ্মন্তের বিবাহ নিষ্পন্ন হয়েছে। লজ্জাবতী কুলবালা রুক্মিণী অপরিচিত শ্রীকৃষ্ণের নিকট আত্মসমর্পণে উদ্যত হয়েছেন। গুরুপত্নী হওয়া সত্ত্বেও তারা অপূর্ব দেহলাবণ্যময় স্বামী শিষ্য সোমদেবের নিকট আপন যৌবন সুধা ডালি দিতে চেয়েছেন, স্বর্গলোকের কানন বাসিনী চির যৌবনা রূপ বিলাসিনী রাজ সহোদরা হয়েও বাল বিধবা শূর্পণখা বনবাসী লক্ষ্মণের অঙ্গচ্ছটায় আকৃষ্ট হয়ে তাঁর পদতলে রূপযৌবন ডালি দিতে চেয়েছেন। প্রচলিত সমাজ-সংস্কার ও সমাজ আচারের বিধি-বিধানে এদের সকলের প্রণয় পত্রিকা গর্হিত চলে বলে মনে হয়। বিশেষত উবর্শী ও তারার পত্রে যে স্বাধীন ও মুক্ত প্রেমের অট্টহাস্য রয়েছে, তাতে সমাজ কোটরবাসী অনেক নিশাচরের নিদ্রাভঙ্গ স্বাভাবিক।
শকুন্তলা দুষ্মন্তের বিস্মরণে উৎকণ্ঠিতা, বেদনা বিধুর তার দেহমন। বননিবানিশী তাপস বালা শকুন্তলার সমগ্র পত্রটিকে বেদনার অশ্রুবিন্দু টলমল, সংসার অনভিজ্ঞা সরণ হৃদয় শকুন্তলার সকরুণ আর্তি—
‘কিঙ্করী করিয়া মোরে রাখ নিজ পদে।’
হয়তো বা এই মিনতি একমাত্র শকুন্তলার পক্ষেই স্বাভাবিক। অন্যদিকে কুলকন্যা অনুঢ়া রুক্মিণীকে বিবাহ করতে আসছেন কালরূপী শিশুপাল। তাই দিবসের কর্মে, রাত্রির স্বপ্নে মিশে তার মন হরণ করেছেন, শুধু যার শ্রী পাদপদ্মে আত্মসমর্পণের স্বপ্ন কামনায় বিহ্বল হয়ে পড়েছেন, সেই সংকট মুহূর্তে তিনি ত্রাতা দ্বারকাধিপতির নিকট পত্রপ্রেরণ করেছেন তাঁকে উদ্ধার করার আবেদন জানিয়ে—
“কালরূপে শিশুপাল আসিছে সত্বরে
আইস তাহার অগ্রে। প্রবেশি এদেশে
হব মোরে। হয়ে লয়ে দেহ তার পদে,
হরিলা এমন যিনি শিকার স্বপনে।”
এইরূপ আলোচনায় বলা যায়, শকুন্তলা ও রুক্মিণী পত্রিকায় রূপজমোহের স্পর্শপাত ঘটেনি।
কিন্তু উর্বশী, শূর্পণখা, তারার পত্রে পরিমাণ ও গুণগতভাবে দেহ কামনা তথা রূপজ মোহের ছায়াপাত ঘটেছে। শূর্পণখা বাল্যবিধবা, উর্বশী বার বিলাসিনী আর তারা স্বামীর শিষ্য সোমের প্রতি তার আকর্ষণ। একাৰ্থে এই অবৈধ আকর্ষণের ফলে সমাজ নারীকে অসম্মানিত পতিতার পথে ঠেলে দেয়। এই সকল পত্রের দ্বারা প্রমাণিত, জীবনের নারীকে বাদ দিয়ে যাঁরা শুধুমাত্র ক্ষীরকে গ্রহণ করতে চান, মধুকরি তাঁদের বিরুদ্ধে, দেহবিমুক্ত, প্রেমের ভাববিলাস-বৈচিত্র্য আছে। কিন্তু জীবনের বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে তার সত্যতা স্বীকার করা চলে না—মধু কবি যেন এই কথাই বলতে চান। কামনাময় পুরুষ এবং রতিময়ী নারীর পারস্পরিক আকর্ষণকে জীবনে মননে অস্বীকার করা চলে না। যে সমাজ পরিবেশ নারী পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণকে পদে পদে দলিত করে বিধি বিধানের কঠোর ও হৃদয়হীন নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধা, মধুকবি তারই বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে হয়তো বা নিজেরই অজ্ঞাতসারে জাতীয় মন ও মনন, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে সুদূর প্রসারী বিপ্লব সূচনা করতে চেয়েছেন।
বীরাঙ্গনা কাব্যে যেমন বয়স্কা নারীর পরিহাস রসিকতার পরিচয় মেলে, অন্যদিকে তেমনি মেলে বহুভার্ষ স্বামীর প্রতি তীব্র ব্যঙ্গ বিদ্রুপের শাধিত শরক্ষেপণ, গর্ভালোক অপেক্ষা মর্ত্যজীবনের তৃাহারা কামনা বাসনার প্রতিই দ্রৌপদীর আকর্ষণ বেশি। তাই তিনি অর্জুনের উদ্দেশ্যে বলেছেন—
কে ফেরে বিদেশে
যুবতী পত্নীর ঘরে রাখি একাকিনী।
–কৈকেয়ীর উচ্চাভিলাস মর্ত্যমানবীর কামনা বাসনার সুর স্বাতন্ত্র্যেই ঝংকৃত হয়েছে। সপত্নী ও সপত্নী পুত্রের ভারী সৌভাগ্য তাঁকে তীক্ষ্ণ আঘাত হেলেছে হৃদয়ে, তাই তিনি স্বামী দশরথের বিচার বুদ্ধি ও ধর্মজ্ঞানের নিকট আবেদন জানিয়ে তাঁর অনুযোগের যথাযোগ্য প্রতিকার প্রার্থনা করেছেন। অন্তরের ক্রোধের রৌদ্র রাগে কৈকেয়ীর অন্তর্দেশ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে—
‘স্বামীর কুরীতি এই শুনেছি জগতে
অবলার মন চুরি করে সে সতত
কৌশলে। নির্ভয়ে ধর্মে দিয়া জলাঞ্জলি
প্রবঞ্চনা রূপ ভঙ্গ মাঝে মধুরসে।
অনুরূপ উক্তি মর্ত্যকামনা বাসনাময়ী কৈকেয়ীর পক্ষে অবশ্যই সম্ভব।
ভানুমতি ও দুঃশালার পত্রে স্বামীর অমঙ্গল আকাঙ্ক্ষায় ভীতত্রস্ত নারীমনের আন্তর পরিচয় উদ্ঘাটিত স্বামীকে আসন্ন সংকটের হাত হতে উদ্ধার করবার জন্য অনুরোধ জানিয়ে তাঁরা যে পত্র প্রেরণ করেছেন সেখানে তাঁদের পতিগতপ্রাণা রূপমূর্তিই উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। একমাত্র স্বামীকে কেন্দ্র করেই তাঁরা পিতৃকুলের ও পতিকুলের অবিমৃষ্যকারিতাকে বিধৃত করেছেন। দুঃশাসনের একমাত্র কারণ—
অবিলম্বে যাব
এ পাপ নগর তুমি সিন্ধুরাজালয়ে
কপোত মিথুন সম যাব উড়ি নীড়ে।
ঘটুক যা থাকে ভাগ্যে কুরুপাণ্ডবকুলে।
ভানুমতীরও একমাত্র চিন্তা—
এস তুমি প্রাণনাথ রণ পরিহরি
পঞ্চখানি গ্রামমাত্র ‘মাগে পঞ্চরথী,
কী অভাব তব কহ? তোষ অভাগীরে
রক্ষ কুরুকুল, ওহে কুরুকুল মণি।
মাত্র তেজের প্রদীপ্ত ছটায় জনার পত্রটি অত্যুজ্জল। প্রাণপ্রিয় পুত্র প্রবীর অশ্বমেষ যজ্ঞকালে পাত্র কর্তৃক নিহত হলে জনা স্বামী নীলধ্বজকে প্রতিশোধ গ্রহণের উৎসাহে উদ্দীপিত করবার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু যখন দেখা গেল, যে স্বামী নীলধ্বজ কাপুরুষের মতো পুত্রঘাতক পার্থের পদসেবায় নিরত, তার অভ্যর্থনার জন্যই এই উৎসব আয়োজনের ঘনঘটা, তখন আর জনা মানসিক সংস্কৃতির অক্ষুণ্ণ রাখতে পারলেন না, মাতা জনা, পত্নী জনা ক্ষত্রিয়ামী জনা বিদ্রোহের কথা বহ্নিতে আপন দাহ প্রকাশ করতে উদ্ধতা হলেন, স্বামীকে বিকৃত করলেন পাণ্ডবকুলের তীব্র জ্বালা নিয়ে জাহ্নবী গর্বে আত্মবিসর্জনে উদ্ধতা হলেন। বস্তুত আশা ছিন্না নারী হৃদয়ের এই মর্মান্তিক আর্তনাদে প্রতিষ্ঠার বিদ্রোহ বাণীর উচ্চারিত ঘোষণাই অন্তর্লীন হয়ে আছে।
তাই বলতে হয়, একদিকে মদুসূদন যেমন বন্দিনী মানবকন্যাকে জীবনের প্রতিষ্ঠাভূমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে এনে মুক্ত করতে চেয়েছেন, সমাজ সংস্কারের সংকীর্ণতাকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন স্বাধীনতার উদার ব্যাপ্তিতে, অন্যদিকে তেমনি তিনি স্বর্গলোকের উত্তুঙ্গ মহিমায় নয়। মর্ত্যলোকের উচ্চাঙ্গ প্রতিষ্ঠা ভূমিতেই তাদের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, স্বর্গ মহিমার সত্যাবর্তনেই বস্তুতপক্ষে কবির আন্তরিক কামনা। ফলে, আত্ম-প্রতিষ্ঠার আন্তরিক বাসনায়, সমাজ শাসনের শৃঙ্খল বন্ধন ছিন্ন করার দুর্দম আবেগে, মানবিকতার বিস্তৃত ব্যাপ্তিতে ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’ নারীর জয়যাত্রার প্রেরণাপণ্য আবর্তিত হয়েছে বিদ্রোহের বহ্নিজ্বালার মধ্য দিয়েই।
Leave a comment