মধুসূদন তাঁর বীরাঙ্গনা কাব্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যর সুন্দর মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। বীরাঙ্গনা কাব্যের কায়া নির্মাণে তিনি অনেকাংশেই পাশ্চাত্য কবি ওভিদের অনুসারী। তবে আঙ্গিকের দিক থেকে শুধু পাশ্চাত্য নয়, প্রাচীন ভারতীয় অলংকার শাস্ত্রের প্রভাবও কিছু আছে। সাহিত্য দর্পণে পৌরাণিক নায়িকাদের নিজ নিজ নায়ক বা প্রেমিকাদের কাছে পত্র লেখার প্রসঙ্গ আছে। বীরাঙ্গনার আখ্যাপত্রে একটি প্রাসঙ্গিক শ্লেষাংশ উদ্ধৃত হয়েছে—

“লেখা প্রস্থাপণেঃ

নার্য্যা ভাবাভিব্যক্তিরিষ্যতে।”

এখানে উল্লেখ করা উচিত সংস্কৃত সাহিত্যের পত্রগুলি খুবই সংহতশ্লিষ্ট রচনা। মধুসূদনের পত্র পত্রিকার মতো বিশিষ্ট কোনোটিই নয়। এখন দেখা যেতে পারে মধুসূদন পৌরাণিক নায়িকাদের প্রেম মনস্তত্ত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে প্রাচ্য ভাবমণ্ডল সৃষ্টিতে কতখানি কুশলতা দেখিয়েছেন। যেমন দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা পত্রিকায় কালিদাসের নাটকের প্রসিদ্ধ আখ্যান অনেকটা অনুসরণ করলেও শকুন্তলা নায়িকা চরিত্র রূপে নতুন সৃষ্টির মূল্য পেয়েছে।

এছাড়াও ভারতীয় জীবনের মধ্যে যে কর্মফলবাদ, অদৃষ্টবাদ, ও জন্মান্তরবাদের সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়, মাইকেলের এই কাব্যের নায়িকাদের নানা বক্তব্যের মাধ্যমেও এই দিকগুলি ফুটে উঠেছে। তাঁদের প্রেম, ক্রোধ, অভিমান সবই এই পাপ পুণ্য ন্যায়-অন্যায় বোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেমন—

  • শকুন্তলা—কৈ পাপে পীড়ন বিধি’
  • কেকয়ী—‘পাপ পুরী’
  • কেকয়ী—‘পরম অর্ধমচারী’ 
  • দুঃশলা—’অন্যায় সমর’ ইত্যাদি।

মাইকেলের নায়িকাগণ ভারতীয় পাপপুণ্য বোধের দ্বারা চালিত ছিলেন বলে তাঁরা আশাবাদী ও পোষণ করেছেন। তাঁরা জানতেন, তাঁদের পাপপুণ্য-ই তাঁদের আশা পূরণ করবে। আশাবাদের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন—

  • শকুন্তলা—’জীবনের আশা হয়ে কে ত্যজে সহজে।
  • কেকয়ী—’বৃথা আশা’ ইত্যাদি।

এছাড়াও প্রাচ্য পটভূমি মনে করে প্রাচীন ভারতীয় রাজধর্ম, রাজকর্তব্য, দৈনন্দিন আচার অনুষ্ঠানের চিত্র ধরা পড়েছে বেশ কিছু পত্রে। যেমন তারার পত্রে ব্রহ্মদেবের প্রত্যুষ থেকে রাত্রি পর্যন্ত জীবনযাত্রা পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্রিত হয়েছে। তবে প্রাচ্য পটভূমি এত বিশাল থাকলেও পটভূমি কিন্তু শুধুই কারা বা আঙ্গিকের দিক থেকে প্রভাব বিস্তার করে শেষ হয়ে যায়নি। বীরাঙ্গনা কাব্যের সফলতার অন্যতম দাবিদার তার ছন্দ, আর এই অমিত্রাক্ষর ছন্দের ধারণাটিও কিন্তু পাশ্চাত্য থেকেই সংগ্রহ করেছিলেন মধুসূদন। মিল্টনের Blank verse-এর অনুসরণ তিনি এই ছন্দ প্রণয়ন করেন।

তবে উপসংহারে বলাই যায়, শুধু প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য প্রভাবই নয়, মধুর ‘আপন মনের মাধুরী ও মিশেছিল বীরাঙ্গনা কাব্যের ছত্রে ছত্রে, তবেই তো বীরাঙ্গনা কাব্য কালজয়ী।