যুগন্ধর কবি মধুসূদন বাংলা কাব্যের কলনাদিনী তটিনীকে সাগর সঙ্গমে মিলিত করে এক বিরাট সম্ভবনার দ্বার ধরে খুলে দিয়েছেন। পয়ার পাঁচালী ইত্যাদি প্রাচীন বাংলা ছন্দের বেড়ি সবলে ভেসে নতুন যুগভাবনার উপযোগী করে ইংরেজি Blank verse-এর অনুকরণে অমিত্রাক্ষর ছন্দ সৃষ্টি করেছিলেন মধুকবি। শর্মিষ্ঠা নাটক ও তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে এর সূচনা মেঘনাদবধ কাব্যে এক বিকাশ ও বীরাঙ্গনা কাব্যে এর সার্থক পরিণতি আমরা লক্ষ্য করি।
অমিত্রাক্ষর ছন্দে লিখিত মেঘনাদবধ কাব্যের বহুল সাফল্যের পর মধুকবি ভাবলেন epic ধর্মী বা মহাকাব্যের সংকীর্ণ গণ্ডিতে অমিত্রাক্ষর ছন্দকে আবদ্ধ করে রাখলে তা গতিশীল নয় স্থিতিশীল হয়ে পড়ে। তাই অমিত্রাক্ষর ছন্দকে মহানাট্যের পরিধি থেকে বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে মুক্ত করার জন্যই মধুকবি সম্ভবত রোমক কবি ওভিদের Heroic epistle নামক পত্রকাব্যের প্রেরণায় বীরাঙ্গনা কাব্য রচনা করেছেন। বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন পর্যায়ের নারী সাধারণ আপন অন্তরিত প্রণয় বার্তা পতি বা প্রণয়পত্রে সমীপে প্রেরণ করেছেন পৌরাণিক নারী সাধারণের এই পত্রিকা প্রেরণের প্রসঙ্গ অবলম্বনে বীরাঙ্গনা কাব্যের কথাবস্তু পরিকল্পিত ও ভাব বৈচিত্র্য বিলসিত হয়েছে। মধুসূদন কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের গীতি-প্রবণতা সম্পূর্ণ রূপে অতিক্রম করে ছন্দকে সম্পূর্ণ ভাবেই জীবনোপযোগী করে তুলেছেন। বীরাঙ্গনা-র ছন্দ সুর প্রাধান্য বর্জিত, যথাসম্ভব কথ্য ভাষা ঘেঁষা, দেশীয় অলংকার সমৃদ্ধ । বিভিন্ন নারী চরিত্রের বিভিন্ন ভাব প্রকাশের সার্থক সহযোগী হয়ে উঠেছে এই পত্রিকা।
যেমন শকুন্তলার পত্রে—
‘আকাশে করেন কেলি লয়ে কলাধারে
রোহিণী কুমুদী তাঁরে পূজে মর্ত্যতলে
কিংকরী করিয়া মোরে রাখ রাজপদে
তারা পত্রিকায়—
‘কি আর কহিব?
জীবন মরণ মম আজি তব হাতে।
দ্রৌপদী পত্রিকায়—
‘হে ত্রিদশালয়বাসী পড়ে কভু মনে
এ পাপ সংসারে আর? কেন বা পড়িবে ?
কি অভাব তব, কান্ত, বৈজয়ন্ত ধামে।
ঊর্বশী পত্রে—
‘থাকিব নিরখি পথ, স্থির আখি হয়ে
উত্তরার্থে, পৃথ্বীনাথ, নিবেদন মিতি।
জনার পত্রে—
‘ক্ষত্ৰকুল বালা আমি, ক্ষত্রকুলবধূ
কেমন এ অপমান সব ধৈর্য্য ধরি?
ছাড়িব এ পেজে প্রাণ জাহ্নবীর জলে।
নারী হৃদয়ের এই যে এত বৈচিত্র্যময়তা তা অমিত্রাক্ষর ছন্দের ওপরে ভর করেই প্রতিষ্ঠিত, এছাড়াও বলা চলে, মধু কবি তাঁর এ কাব্যে যে নারীর মুক্ত ও স্বাধীন প্রেমের রচনা গীতিরচনা করেছেন সমাজ সংসারের শৈবাল সরোবরে নারীর আত্মমর্যাদা ও আত্মস্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী মনোভাবের উচ্ছ্বলন ঘটিয়েছিলেন, সে কাজে তার সার্থক সহায়ক হয়েছিল অমিত্রাক্ষর ছন্দ। তিনখানি কাব্যের তিলোত্তমা সম্ভব, মেঘনাদবধ ও বীরাঙ্গনা) ছন্দ আলোচনা প্রসঙ্গে যৌগেন্দ্রনাথ বসুর মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য— “তিলোত্তমা সম্ভব ওই ছন্দের (অমিত্রাক্ষর ছন্দে) প্রথম প্রবর্তন, ভাষা কর্কশ ও জড়তাময় ও ছন্দ আড়ষ্ট। মেঘনাদবধ প্রথম ভাগের ওইসব দোষ অধিক না থাকিলেও স্থলে স্থলে ছিল….সবশেষে বীরাঙ্গনা কাব্যের রচনায় দেখা যায় কাব্যের ভাষা ও ছন্দ যতদূর উৎকৃষ্ট হয়, তাহাই হইয়াছে—কোথাও কর্কশতার লেশমাত্র নাই।” অন্যত্রও তিনি বলেছেন—“মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দের মাধুর্য এই কাব্যে (বীরাঙ্গনা কাব্যে) পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হইয়াছে। বলাবাহুল্য ভাষার পুরুষাচিত দাতা প্রকাশ নজির সহজ সুস্পষ্টতা ধ্বনি গাম্ভীর্যের হৃদয়োন্মাদক ঝংকারে মেঘনাদ বধেরই পরিণততম রূপ ছন্দের ক্ষেত্রে বীরাঙ্গনা কাব্যে বিধৃত হয়ে আছে, ছন্দোকীর্তির বিচারে মধুসূদনের সমগ্র কাব্যজীবন প্রবাহে বীরাঙ্গনা কাব্য নিঃসন্দেহে জীবস্থানীয়।
Leave a comment