যে কোনো শিল্পেরই মূলত দুটি দিক–একটি তার বলবার বিষয় বা প্রসঙ্গ, আরেকটি তার বলবার আঙ্গিক বা উপস্থাপনের ভঙ্গি। শৈলী ব্যাপারটি প্রধানত এই দ্বিতীয় দিকটির সঙ্গে জড়িত। নৃত্য, সংগীত, চিত্রকল্প, ভাস্কর্যশিল্পের প্রতিটি বিভাগের ক্ষেত্রেই শিল্পীকে তার শৈলীগত দিক অর্থাৎ উপস্থাপনের ভঙ্গিটির দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয়। একই বিষয়–ভিন্ন ভিন্ন স্রষ্টার প্রকাশ শৈলীর বিভিন্নতার কারণে তা হয়ে ওঠে ভিন্ন ভিন্ন রসবাহী, তাতে যুক্ত হয় ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য। আর এখানেই লুকিয়ে আছে শিল্পীর মৌলিকতা বা স্বকীয়তার প্রসঙ্গটি। শিল্পের জগতে তাই শৈলী অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

সাহিত্য একধরনের বাচনিক শিল্প বা Verbal Art, কারণ ভাষাই এর প্রধান আধার ও একমাত্র প্রকাশমাধ্যম। আর এজন্যই শিল্পের অন্যান্য বিভাগ যেমন—সংগীত, নৃত্য, চিত্রাঙ্কন, ভাস্কর্য প্রভৃতি থেকে সে স্বতন্ত্র। সাহিত্যের এলাকায় শৈলী ব্যাপারটি মুখ্যত তাই ভাষারীতির দিকটিকেই ইঙ্গিত করে। একজন কবি বা লেখক যখন তাঁর বক্তব্য বিষয়কে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ভাষারীতির মাধ্যমে প্রকাশ করেন, তখন তাকেই বলা যেতে পরে শৈলী। শৈলীর আলোচনার ক্ষেত্রে তাই বক্তব্য বিষয়-এর চেয়েও গুরুত্ব পায় তার প্রকাশরগত কৌশল ও লেখকের উপস্থাপণের ভঙ্গিমার দিকটি। শৈলীতে পৌঁছানোর জন্য কবি বা লেখক বিশেষ কতগুলি কৌশল অবলম্বন করে থাকেন যেগুলি তাঁর দ্বারা সচেতন ভাবে আরোপিত অথবা অচেতন ভাবে নিয়োজিত দুই-ই হতে পারে।

ইংরেজি শব্দ ‘Stylistics’-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবেই বাংলায় ‘শৈলী’ কথাটি ব্যবহৃত হয়। আর ‘Style’ শব্দটির সঙ্গে ব্যক্তির নিজস্বতা বা মৌলিক চিন্তার দিকটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। সাহিত্যের শৈলী বিচারের ক্ষেত্রেও তাই রচনার ভাষারীতির বিচারের সাথে সাথে লেখকের নিজস্ব Style টিকেও অনেকখানি ধরে ফেলা সম্ভব যা একান্ত ভাবেই ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত।

শৈলী বিচারের সঠিক মানদণ্ড ঠিক কী হতে পারে তা নিয়ে অজস্র বিতর্ক আছে। তবে, শৈলীবিচারের ক্ষেত্রে মোটামুটি নিম্নলিখিত বিষয়গুলির ওপর গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে—

  • ১। রচনার সমাজ-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট 
  • ২। লেখকের ব্যক্তিজীবন, মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা বা ব্যক্তিগত অভিরুচি।
  • ৩। রচনার ভাষা সংগঠন (ধ্বনিগত প্রসঙ্গ : শাব্দিক প্রসঙ্গ; বাক্যনির্মাণ, রূপনির্মাণ প্রসঙ্গ; ছেদ, যতি প্রভৃতি চিহ্নের প্রয়োগগত প্রসঙ্গ অর্থাৎ এককথায় লেখকের বিনির্মাণ রীতি)। 
  • ৪। রচনার আঙ্গিকগত দিক কোনো রচনার সূচনা, সমাপ্তি ও মধ্যবর্তী অংশ ; রচনার বিশেষ অংশের সঙ্গে অন্যান্য অংশের যোগাযোগ; ছন্দ, অলংকার; অনুচ্ছেদের গড়ন : হরফের সজ্জা প্রভৃতি দিক।)

মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের শৈলীগত আলোচনার ক্ষেত্রে ওপরের বিষয়গুলিকে মনে রেখেই অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। ‘বীরাঙ্গনা’ মধুসূদনের চতুর্থ কাব্য, রচনাকাল ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ। তব ঠিক পূববর্তী কাব্যগুলি যথাক্রমে ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ (১৮৬০ খ্রিঃ), ‘ব্রজাঙ্গনা’ (১৮৬১ খ্রিঃ) এবং কবির সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা ‘মেঘনাদ বধ’ (১৮৬১ খ্রিঃ)। ‘বীরাঙ্গনা’-র পর ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে কবি তাঁর প্রবাসজীবনে রচনা করেছিলেন ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ নামের সনেটগুচ্ছ। মাইকেলের রচিত সবকটি কাব্যের মধ্যে ‘বীরাঙ্গনা’ কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী রচনা। কারণ, এটি ‘পাত্রকাব্য’ জাতীয় রচনা এবং আজও পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও শেষ সার্থক পত্রকাব্য-এর নিদর্শন রূপে আমরা কেবল ‘বীরাঙ্গনা’-কেই চিহ্নিত করতে পারি৷ ‘বীরাঙ্গনা’-তে একদিকে যুক্ত হয়েছে পূববর্তী ‘মেঘনাদ বধ’-এর গাম্ভীর্য অন্যদিকে মিশেছে ‘ব্রজাঙ্গনা’-কাব্যের মাধুর্যময়তা। একাব্যে তপোবনবাসিনী আশ্রমকন্যা শকুন্তলার কোমল লাবণ্য যেমন চোখে পড়ে তেমনি জনার দৃপ্তকণ্ঠ হৃদয়ভেদী তিরষ্কারের ধ্বনিও আমাদের কানে বাজে। ছন্দ, অলংকার, বিষয়বস্তু সমস্ত কিছুর অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে এ কাব্যে। ‘তিলোত্তমাসম্ভব’-এ যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রথম আহ্বান সূচিত হয়েছিল তাই-ই মধুকবির প্রতিভাস্পর্শে ‘মেঘনাদ বধ’-এ বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা লাভের মধ্যে দিয়ে ‘বীরাঙ্গনা’ তে এসে একটি পূর্ণ পরিণতি পেল। এজন্যই বোধ হয় বঙ্কিম ‘কবিত্ব শক্তির বিচারে’ ‘মেঘনাদ বধ’-কে মধুসূদনের সর্বোৎকৃষ্ট রচনা বলে মনে করলেও ‘ভাষার লালিত্য’ ও ‘ছন্দের পারিপাট্যে’ ‘বীরাঙ্গনা’-কেই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রচনারূপে মর্যাদা দিয়েছেন।

‘বীরাঙ্গনা’-র নায়ক-নায়িকা সবাই পৌরাণিক চরিত্র। পুরাণ থেকে গৃহীত কতগুলি খণ্ড কাহিনিকে কেন্দ্র করেই এ কাব্য রচিত এবং এটি নায়িকা প্রধান। কাহিনি নির্বাচনে সর্বত্রই কবি তাঁর ক্লাসিক-অনুসারী মনের পরিচয় দিয়েছেন। কবি-প্রতিভার স্বকীয় চিন্তনের স্পর্শে চির-পরিচিত পৌরাণিক আখ্যান গুলিতেও যুক্ত হয়েছে এক অভিনব দৃষ্টিভঙ্গী। উনিশ শতকের নবজাগরণ ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব সেদিনকার বাঙালি জনমানসে যে মুক্তিচেতনা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ ও বিদ্রোহী মনোভাব জাগিয়ে তুলেছিল তখনকার নারীসমাজেও তার প্রভাব ছিল সুগভীর। সতীদাহপ্রথা উচ্ছেদ, বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তন, পুরুষের বহু-বিবাহ প্রথা নিবারণ এবং স্ত্রীশিক্ষার সূত্রপাত এসবের মধ্যে দিয়ে নারীজাগরণের যে বিপুল উন্মাদনার জোয়ার ১৯ শতকের বাঙালি সমাজকে আলোড়িত করেছিল সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কবি যে নারীকে নিয়ে বিশেষভাবে ভাবিত হয়েছিলেন তার প্রমাণ ‘বীরাঙ্গনা’। নারীমুক্তি চেতনার এক বিচিত্র প্রকাশক্ষেত্র রূপে মধুসূদন তাঁর ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যরচনার প্রেরণা অন্তরে অনুভব করেছিলেন। নারীজাগৃতি সম্বন্ধে কবির এই সচেতনতা কাব্যের নামকরণেই সুস্পষ্ট। নবযুগের নারীমুক্তি-র ঘটনাকে আন্তরিক সম্মান জ্ঞাপন করেই তিনি সম্ভবত তাঁর কাব্যের নায়িকাদের উদ্দেশ্যে ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। পুরাণ-রামায়ণ মহাভারত-এর সব বিখ্যাত নারীরা তাঁর নায়িকা। তাদের জীবনের বিচিত্র মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলি মধুকবির রচনায় উন্মোচিত হয়েছে, রচিত হয়েছে প্রোষিতভর্তৃকা রমণীর বিরহযন্ত্রণার কথা, বিবাহিতা নারীর প্রবঞ্ছিত জীবনের কাহিনি, কুমারী প্রেমের রোমান্টিক ভালোবাসা কিংবা বিবাহিতা হওয়া সত্ত্বেও অতৃপ্ত হৃদয় নারীর মানসিক বেদনার আখ্যান। নবযুগের ব্যক্তিত্ব সচেতন কবি নায়িকাদের হৃদয়গত কামনা প্রকাশের ক্ষেত্রে পৌরাণিক চরিত্রগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেও তাঁদেরকে অনেকখানি স্বাধীন ভাবে সৃষ্টি করেছেন। চারিত্রিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে আত্মমর্যাদায় ভূষিতা করে তাদের মনোজগত আলোড়িত আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, কামনা-বাসনা ও সর্বোপরি নারীকে তার আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার দাবীর মধ্যে দিয়ে নীরব, অবলা চরিত্রগুলিকে অনেক বেশি সরব, সাহসিকা করে তুলেছেন।

‘বীরাঙ্গনা’-এর অবয়ব গঠনে নাট্যকাব্য, আখ্যানকাব্য, গীতিকাব্য সমস্ত স্বরূপগুলিরই সংমিশ্রণ ঘটেছে। প্রতিটি কাব্যে আখ্যানধর্মিতার প্রাধান্যের পাশাপাশি সঞ্চারিত হয়েছে গীতি-প্রবণতার সুর। আবার এর ভেতরেই নায়ক-নায়িকার কথোপকথনে পাই নাট্যকাব্যের মতো নাটকীয় সংলাপ সর্বস্বতা। নাট্যকাব্যের লক্ষণ থাকলেও সমগ্র কাব্যটি অবশ্য রচিত হয়েছে পত্রকাব্যের আঙ্গিকে। পত্র মানব মনের দর্পণ যাতে মানুষের অন্তরের অনেক গোপন কথা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ‘বীরাঙ্গনা’ রচনার ক্ষেত্রে নারী হৃদয়ের গোপন অন্তঃপুরের না বলা অনেক ব্যথা বেদনার প্রকাশ মাধ্যম হিসেবে একারণেই কবি বোধহয় পত্ররীতির দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তাছাড়া, মাইকেলের কবিত্বশক্তির মধ্যে গীতিপ্রবণতার যে আধিক্য ছিল তা প্রকাশের জন্যেও পত্ররীতি অনেকাংশেই সহায়ক। তবে লক্ষ করবার বিষয় এটি যে এ কাব্যে পত্রগুলি ঠিক উত্তরের প্রত্যাশা নিয়ে রচিত নয়। প্রাপক ও প্রেরকের উত্তর প্রত্যুত্তরের রীতিটি বজায় রাখলে গীতিময়তা ও রোমান্টিকতার অপূর্ব মাধুর্যটি অনেকক্ষেত্রে ক্ষুণ্ণ হত বলেই বোধ হয় কবি এই রীতিটি সচেতনভাবে বর্জন করেছেন।

‘বীরাঙ্গনা’ রচনাকালে কবি পাশ্চাত্য আদর্শে প্রভাবিত হয়েছিলেন। রোমান কবি ওভিদের ‘Heroides’-এর অনুসরণে রচিত হলেও তাতে অবশ্য এ কাব্যের মৌলিকতা কোথাও হারায়নি। কারণ, পাশ্চাত্য আদর্শের পাশাপাশি প্রাচ্য ঐতিহ্যকেও কবি কখনও বিস্মৃত হননি। য়ুরোপীয় সমাজের নারীর সঙ্গে ভারতীয় নারীর মূলগত পার্থক্য বিষয়ে সচেতন ছিলেন বলেই হয়তো তিনি প্রেমিক নায়কদের সামনে নায়িকাদের সরাসরি উপস্থাপিত না করে পত্রের মাধ্যমে তাদের বক্তব্যকে প্রকাশ করবার পরিকল্পনা করেছেন।

এ কাব্যের মোট পত্রসংখ্যা ১১টি, প্রায় সবগুলি পত্রের বিষয়বস্তু প্রেম সম্পর্কিত হলেও তাদের প্রেমের কবিতা হিসাবে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন—

ক. প্রেম বিষয়ক– প্রেমাস্পদের কাছে প্রণয় প্রার্থনা ও মিলনের প্রত্যাশা এ জাতীয় পত্রের মূল বিষয়। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রেমের বৈচিত্র্যও আছে। কোথাও পাওয়া যায় কুমারীর প্রেম, আবার কোথাও বা আছে বিবাহিতা নারীর অবৈধ প্রেম সম্পর্কের আভাস। উদাহরণ হিসেবে ‘সোমের প্রতি তারা’ বা ‘লক্ষ্মণের প্রতি শূর্পনখা’ প্রভৃতির উল্লেখ করা চলে।

খ. প্রত্যাখ্যান বিষয়ক— এই পর্যায়ে রয়েছে ইন্দ্রিয়াশ্রয়ী প্রেমের মোহবন্ধন ছিন্ন করবার প্রয়াস। যেমন—’শান্তনুর প্রতি জাহ্নবী’ পত্রিকা।

গ. স্মরণ মূলক— এজাতীয় পত্রিকাগুলিতে বর্ণিত হয়েছে প্রোষিতভর্তৃকা নারীদের প্রেরিত পত্রে প্রেমাস্পদের জন্য উদ্বেগ ও ব্যাকুলতা। ‘স্মরণ’ অনুষঙ্গকে ঘিরেই পত্রগুলি রচিত। যেমন—‘দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা’ বা ‘অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী’ ইত্যাদি। 

ঘ. অনুযোগ বিষয়ক— অনুযোগ বিষয়ক পত্রে মুখ্যত স্বামীর অনুচিত ব্যবহারে ক্ষুব্ধ স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া তাদের মানসিক যন্ত্রণার কথা ব্যক্ত হয়েছে। ‘দশরথের প্রতি কেকয়ী’ বা ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রে ধরা পড়েছে এ জাতীয় অনুযোগের সুর।

মোট ১১টি পত্রিকার সবকটির মধ্যে ভাব ও সুরের ঐক্য থাকলেও প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী মনস্তত্বের স্বরূপ উদ্ঘাটন ও তাঁদের অন্তরের গোপন ব্যথা-বেদনার প্রকাশরীতিটি ভিন্ন ভিন্ন। সবসময় যে, নারীদের মধ্যে বীর নারীর ভাবটি দ্যোতিত হয়েছে তা নয়। ‘জনা’-র মধ্যে যেমন বীরোচিত ভাবের প্রকাশ ঘটেছে, শকুন্তলা বা দ্রৌপদীর মধ্যে তা অনুপস্থিত কিন্তু নীরব অবলা নারীর নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া, সুখ-দুঃখ, সবকিছুকে কেন্দ্র করে তাদের যে সবুর অকপট অভিব্যক্তি পত্রগুলিকে প্রকাশিত হয়েছে তাই-ই সম্ভবত কবির কাছে বীরত্বসূচক বলে মনে হয়েছে।