নবযুগস্রষ্টা মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্য এগারো জন পৌরাণিক নারীর, তাঁদের প্রিয় অথবা পতির উদ্দেশ্যে লিখিত পত্রিকা সংকলন) বাংলা সাহিত্যে পত্রগল্প পত্রোপন্যাস অনেকে রচনা করেছেন কিন্তু পত্রকাব্য সম্ভবত এই একটিই রচিত হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি যে এই কাব্যের প্রেরণা ও আদর্শ কবি লাভ করেছিলেন রোমক কবি ওভিদের রচিত দি হীরোইদেস থেকে এবং উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন বিভিন্ন পুরাণ, মহাকাব্য এবং প্রাচীন সংস্কৃত কবিদের কাব্য থেকে।

বীরাঙ্গনা কাব্যের প্রথম সর্গ শকুন্তলা পত্রিকার উপাদান কবি সংগ্রহ করেছিলেন মহাকবি কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ থেকে। কিন্তু তিনি হুবহু মহাকবিকে অনুকরণ না করে আপন প্রতিভা বলে সেখানে কিছু স্বকীয়তা বজায় রাখতে চেয়েছেন। ফলে মুহাকবির শকুন্তলার সঙ্গে বীরাঙ্গনা কাব্যের শকুত্তলার কিছু তফাৎ লক্ষ্য করা যায়। তার প্রথম এবং প্রধান লক্ষণ হল মহাকবির শকুন্তলা বাকপটু নয়। দুষ্মন্তের বহু প্রশ্নের উত্তর তাঁর হয়ে তাঁর দুই সখী অনসূয়া এবং প্রিয়ম্বদা দিয়েছিলেন। কিন্তু মধুকবির শকুন্তলা নিজের অবস্থার কথা নিজে ব্যক্ত করতে পারেন। অথচ, পাছে দুষ্মন্তের নিন্দা করে, এই ভয়ে অনসূয়া প্রিয়ম্বদাকেও তিনি মনের ভাব গোপন করেন।

বীরাঙ্গনার শকুন্তলা আশ্রমকন্যা। তিনি নম্র, শাস্ত। হিংসাদ্বেষ অসূয়ালেশহীন। উচ্চকণ্ঠে কথা তিনি বলতে পারেন না এমনকি অন্যের কোন দোষও তাঁর কাছে দৃষ্ট হয় না। পতি বিরহে বিরহিনী শকুন্তলা উৎকণ্ঠিতা। ঐ বুঝি তাঁর স্বামীর কাছ থেকে আহ্বান বার্তা এলো—এই কথা ভেবেই তার দিন কাটে। কিন্তু পরক্ষণেই ভুল ভাঙে—তিনি শোকে মুর্ছিত হয়ে যান।

শকুন্তলাকে গান্ধর্বমর্তে বিবাহ করে রাজা দুষ্মন্ত রাজ্যে ফিরে গেছেন। তিনি আর কোন সংবাদ বিনিময় করেন নি। এদিকে প্রোষিতভর্তৃকা শকুন্তলা বিরহে সব শূন্য সব অন্ধকারময় দেখছেন। কিন্তু তবুও শকুন্তলা তাঁর এই বিরহ-দহন মুখ বুজে সহ্য করেন। কেননা দাম্পত্য জীবনে অভিজ্ঞ না হলেও, কিম্বা পত্নীত্বের পূর্ণ দাবী করার অবকাশ বা সুযোগ তাঁর না থাকলেও তাঁর মধ্যে সাধ্বী রমণী সত্তা বিদ্যমান ছিল। ফলে পতির কল্যাণ কামনাই তাঁর জীবনের এক ব্রত স্বরূপ। সেই জন্যেই তিনি তাঁর অন্তরের দুঃখের করুণ কথা কারো কাছে প্রকাশ করতে পারছেন না। তাঁর ভয়, পাছে তাঁর দুঃখের কথা শুনে বনদেব-দেবী দুষ্মন্তকে অভিশাপ দেন কিম্বা তাঁকে বিবশা দেখলে তাঁর প্রিয় সখীদ্বয় ক্রুদ্ধ হয়ে দুষ্মন্তর নিন্দা করেন। ভারতীয় যে সংস্কার পত্নীকে পতির কল্যাণকামী করে তোলে এবং বিবাহের অব্যবহিত পর থেকেই নারী মনে সেই সংস্কার বদ্ধমূল হয়ে যায়। পুরাণ উপাখ্যান থেকে দৃষ্টান্ত টেনে দেখানো যায়, এই সংস্কার এতই বদ্ধমূল ছিল সতীর মনে যার ফলে পতি নিন্দা সে আর শুনবে না বলেই দেহত্যাগ করেছিল। সেই সংস্কার এখানে শকুন্তলার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। “পতি নিন্দা শোনা পাপ’—এই ধারণা থাকার জন্যেই শকুন্তলা তাঁর বিরহ বেদনা ব্যক্ত করতে পারছেন না। তাঁর বিরহ ব্যথা যতই তাঁকে আচ্ছন্ন করছে ততই তিনি দেখতে পাচ্ছেন আশ্রম জুড়ে ছড়িয়ে থাকা তাঁর স্বামীর তাঁর প্রেমের নানা নিদর্শন।

একদিকে বিরহব্যথা, অন্যদিকে স্বামীর কল্যাণ কামনা এই দোলাচলে পড়ে শকুন্তলার আহারে রুচি নেই, চোখে নিদ্রা নেই এবং মাঝে মাঝে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। চেতনা ফিরে পেলেই দেখেন সামনে দুষ্মন্তের মূর্তি। দুহাত বাড়িয়ে স্বামীর চরণযুগল বেষ্টন করার জন্যে ছুটে যায়। তখনি ভুল ভাঙে, কান্নাই সার হয়।

মাঝে মাঝে শকুন্তলা স্বপ্নে দেখেন দুষ্মন্তর রাজপ্রাসাদ, রাজৈশ্বর্যের –

“স্বর্ণ-রত্ন সংঘটিত দেখি অট্টালিকা

দ্বিরদ-রদ-নির্মিত দুয়ারে দুয়ারী

দ্বিরদ; সুবর্ণাসন দেখি স্থানে স্থানে; 

ফুলশয্যা, বিদ্যাধরী-গঞ্জিনী কিঙ্করী

কেহ গায়, কেহ নাচে যোগায় আনিয়া 

বিবিধ ভূষণ কেহ; কেহ উপাদেয় 

রাজভোগ। দেখি মুক্তা মণি রাশি রাশি, 

অলকা-সদনে যেন।”

স্পষ্টই বুঝতে পারা যায় শকুগুলার অবস্থা দুষ্মপ্তময়। মুচ্ছিতা হয়ে সংজ্ঞা প্রাপ্তির পর যেমন তিনি দুষ্মন্তকে দেখছেন। যদি ঘুম আসে তাহলে স্বপ্নেও তিনি দুষ্মন্তর ঐশ্বর্য দেখছেন, দুষ্মস্তকে দেখছেন— 

“তোমায়, নৃমণি, দেখি স্বর্ণ সিংহাসনে। 

শিরোপরি রাজছত্র; রাজদন্ড হাতে,

মণ্ডিত অমূল্য রত্নে: সসাগরা ধরা,

রাজকর করে, নত রাজীব-চরণে।”

শয়নে স্বপনে জাগরণে শকুন্তলার দুষ্মন্ত চিন্তাই এর একমাত্র ফল। কিন্তু স্বামীর দেবেন্দ্র-সদৃশ ঐশ্বর্য থাকলেও শকুন্তলার মনে সে বিষয়ে কোন লোভ নেই—–নাহি লোভে দাসী বিভব।’ তিনি কেবলমাত্র দাসী রূপে স্বামীর চরণ সেবা করে ধন্য হতে চান। তাই তাঁর প্রার্থনা ‘কিঙ্করী করিয়া মোরে রাখ রাজপদে”।

শ্রকুন্তলার ঐশ্বর্য লোভ বা বাসনা যেমন নেই, তেমনি প্রোষিতভর্তৃকা ও বিরহ দশার জন্যেও অপর কোন ব্যক্তির ওপর তাঁর ক্রোধ না ক্ষোভ নেই। তিনি অদৃষ্টবাদী তার ধারণা এ সবই তাঁর ললাট লিখন। তার বক্তব্য—

“চির অভাগিনী আমি! জনক-জননী

ত্যজিলা শৈশবে মোরে, না জানি, কি পাপে? 

এ নব যৌবনে এবে ত্যজিলা কি তুমি,

প্রাণপতি?

অদৃষ্টবাদীরা যে রূপ নানা শংকায় শংকিত হয় শকুন্তলাও তেমনি শংকিত। তাঁর আশংকা, যে ঋষিবালকের হাত দিয়ে এই পত্র তিনি দুষ্মন্ত সমীপে প্রেরণ করছেন, তার পক্ষে রাজপুরীতে প্রবেশ করা সম্ভবপর কিনা। যদি সে প্রবেশ করে তবে রাজার হাতে এ পত্র সে দিতে পারবে কিনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও শকুন্তলা আশা ছাড়তে নারাজ। এখানেই শকুন্তলার চারিত্রিক দৃঢ়তা ফুটে উঠেছে। তাঁর জীবন কাহিনী করুণ রসে পরিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ট্র্যাজেডি তাকে স্পর্শ করতে পারে নি। শোক দুঃখ পেয়েও শকুন্তলা আপন কর্তব্যে অবিচল থাকতে পেরেছেন এবং শত দুঃখ বঞ্চনার পরেও রাজাকে তিনি তাঁর আশার কথা জানিয়ে লিখেছেন—

“কিন্তু মজ্জমান জন, শুনিয়াছি ধরে 

তৃণে, আর কিছু যদি না পায় সম্মুখে

জীবনের আশা, হায়, কে তাজে সহজে।”

মহাকবি কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম অবলম্বনে মধুসূদন নাট্য-লক্ষণাক্রান্ত এই পত্রিকাটি রচনা করেছেন। কিন্তু মহাকবিকে তিনি হুবহু অনুকরণ করেন নি। ফলে তাঁর শকুন্তলা চরিত্রে ও কাহিনীতে কিছু কিছু পার্থক্য ও মৌলিকতা লক্ষিত হয়।

মহাকবির শকুন্তলা নিজ বিরহের কথা পদ্মপাতায় রচনা করেছিলেন তাঁর সখীদ্বয়ের সহায়তায় কিন্তু মধু কবির শকুন্তলা তাঁর বিরহ কাতরতা সখীদের কাছে গোপন করে রাখার জন্যে স্বয়ং প্রবৃত্ত হয়ে পত্র লিখেছেন। বীরাঙ্গনা শকুন্তলা বিরহে কাতর হলেও দিশেহারা হন নি বা আত্মমগ্নতায় নিমজ্জিত হলেও পতিকল্যাণ কামনাকেই মুখ্য ব্রত হিসেবে সামনে রেখেছিলেন। কালিদাসের শকুন্তলার দুষ্মন্ত চিন্তায় জগৎ ও কর্তব্য বিস্মরণ করেছিলেন বলেই দুর্বাশার অভিশাপ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু মধুসূদনের শকুন্তলা জগৎবিস্মৃত হন নি বলেই দুর্বাশা প্রসঙ্গ এখানে স্থান পায় নি। এই সমস্ত নানা পার্থক্য উভয় কবির শকুন্তলার মধ্যে বিদ্যমান।

বীরাঙ্গনা কাব্যের প্রথম সর্গে শকুন্তলার যে চরিত্র চিত্রিত হয়েছে তা সংক্ষেপে এই রূপ— তিনি নম্র, বালিকা স্বভাবযুক্তা আশ্রমবন্যা। তিনি অদৃষ্টবাদী। ভালো মন্দ ফলপ্রাপ্তি প্রসঙ্গে তিনি দৈবনির্ভর। স্বামীর কল্যাণ কামনাই তাঁর জীবনের মূল ব্রত। তিনি উচ্চকণ্ঠী নন, যাবতীয় কোমল চিত্তবৃত্তিযুক্ত তার অন্তর করুণায় মথিত। তিনি হিংসাদ্বেষ অসূয়ালেশহীন ক্ষমাশীলা নারী। তিনি আশাবাদী। তাঁর একমাত্র আশা দুঃখ দুর্ভাগ্য অপনোদিত হয়ে অবশেষে তিনি তাঁর পতির চরণে আশ্রয় লাভ করবেন।