মধুসূদন দত্ত যখন বীরাঙ্গনা কাব্য রচনা করেন, বাংলা সাহিত্যে অন্তত তখন নারী চিত্তমুক্তির কোনো সচেতন প্রত্যাশা ব্যক্ত হয়নি। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে দেবদেবী অধ্যুষিত ক্ষেত্রে, নারী কেন পুরুষের স্বাধীনতাও বিশেষ কখনও স্বীকৃত হয়নি। সপ্তদশ শতকের মুসলিম কবিরা এবং ময়মনসিংহ গীতিকার কবিগণ নারী চিত্তের আশা আকাঙ্ক্ষা অস্ফুট উন্মোচন অন্তত ঘটিয়েছিলেন ; মনসামঙ্গলের কবিরা চাঁদ সদাগর নামক পুরুষটিকে কিছুটা স্বাধীনভাবে বিচরণের সুযোগ দিয়েছিলেন।

ঊনবিংশ শতকের পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহচর্যের ফলে এদেশে এক ভাব বিপ্লবের সূচনা হয়। ফরাসি নবজাগরণ বা রেনেসাঁসের আদলে একে ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণের আখ্যা দেওয়া হয়। এ ধরনের ভাব বিপ্লবে তিন রকমের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় । এক্ষেত্রেও তাই দেখা গিয়েছিল। আমাদের সমাজে নারী স্থান ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ। নারীর মূল্য পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা, রামমোহনের সতীদাহ রোধ এবং বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রবর্তন করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘটে।

বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সামাজিক উপন্যাসে নারীর বৈধব্যের জ্বালা সম্পর্কে কিছু চিন্তাভাবনার পরিচয় দিয়েছিল। কিন্তু তাঁর নীতি নিয়ন্ত্রিত মনোভাবের জন্য এ ধরনের চরিত্রের প্রতি শেষ পর্যন্ত সুবিচার করতে পারেননি। অবশ্য ব্যতিক্রম হিসাবে আনন্দমঠ ও দেবী চৌধুরাণীর উপন্যাসে তিনি নারীদের বিরাট কর্মক্ষেত্রে আহ্বান করেছেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ছোটোগল্প কবিতা, গানে নারীচিত্তমুক্তির কথা নিঃসংশয় উচ্চারণ করলেন এবং দাম্পত্য সমাজ জীবনে নারীর প্রকৃত স্থান নির্দেশ করে দিলেন। কবিতায় তাঁর নায়িকা বলেছেন-আমি নারী আমি মহিয়সী/আমার সুরে সুরে বেঁধেছে জ্যোৎস্না রাতের/নিদ্রাবিহীন শশী। বদনাম গল্পের নায়িকা বলেছে—“পুরুষেরা বোকা, তারা আমাদের বলে সরলা, অবলা—এই নামের আড়ালেই আমরা করে থাকি আর এই খোকার বাবারা মুগ্ধ হয়ে যায়। আমরা অবলা অবলা কুকুরের গলায় শিকলের মতো এই খ্যাতি গলায় পরে থাকি। আর তোমরা আমাদের পিছন পিছন টেনে নিয়ে বেড়াও।”

সাহিত্যের নারী চিত্তের মুক্তি ঘোষণা মধুসূদনের সময়ে সম্ভব হয়নি সত্য। কিন্তু তিনি এমন একটি কাজ করেছিলেন যাতে তাঁকে নারী চিত্তমুক্তির অগ্রদূত হিসাবে সম্মান জানতে হবে। মেঘনাদবধ কাব্যের ‘চিত্রাঙ্গদা’ চরিত্রটি এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। বীরত্বের সংস্কার ও স্তোকবাক্য দিয়ে তার পুত্র শোক দমিত করা যায় না, মিথ্যা বীরত্বের অহংকারের চেয়ে এই মানবীমাতার পুত্রশোক অনেক বাস্তব সত্য। বীরাঙ্গনা কাব্যের নারীদের ক্ষেত্রে মানবিকতা স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে।

‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ নাটকে শকুন্তলা দুষ্মত্তের চিন্তায় কীরকম বিভোর হয়ে থাকতেন তার আভাষ আমরা পাই দুর্বাশার অভিশাপে, কিন্তু তার বিরহিণী চিত্তের সতৃ প্রতীক্ষা সর্বপ্রকার মান অভিমান বিরহজ্বালা নিয়ে শকুন্তলা কতখানি মানবীয় হয়ে উঠতে পারে, তার প্রমাণ আমরা পাই বীরাঙ্গনা কাব্যে। কালিদাসের নাটকে সেই বিরহের মর্মর মূর্তি এখানে পরিণত হয়েছে এক সজীব নারীতে।

সামাজিক সম্পর্ক ও হৃদয়ের সম্পর্কের মধ্যে ব্যবধান যে অনেক সময়ই থাকে এবং সমাজের আরোপিত সম্পর্কের চেয়ে হৃদয়ের সম্পর্ক অনেক সময়ই যে বড়ো হয়ে ওঠে মধুসূদনের দ্বিতীয় সর্গে তারা দেবীকে অবলম্বন করে তার দীপ্ত ধ্বনিতে পরিণত করেছেন। তারা সামদেবের গুরুপত্নী—এটাই তার সামাজিক সম্পর্ক, কিন্তু হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয় সে সম্পর্ক করে নেয় তাই গড়ে উঠেছিল সোমের সঙ্গে এ সম্পর্ক প্রেমের। সামাজিক অবৈধ প্রেমের সঙ্গে এই স্বীকৃতিতে তারা সতীত্বের ব্যাখ্যা করতে পারেনি। একথা সত্য কিন্তু মানবিকার সম্পর্কের এই সততা রক্ষায় একটি বলিষ্ঠ নারী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

আর একটি মানবিক সত্যভাষণা পাই আমরা ষষ্ঠ সর্গে দ্রৌপদীর পত্রে। পাণ্ডবদের মাতৃভক্তি অতুলনীয়। মায়ের কথায় তারা দ্রৌপদীকে পাঁচভাগ করে নিয়েছিলেন। অর্থাৎ পাঁচজনই একত্রে পত্নীত্বে বরণ করেছিলেন দ্রৌপদীকে। কিন্তু দ্রৌপদীর পক্ষে এটার সম্ভবপরতার প্রশ্ন নিয়ে মহাভারত নামক পুরাণ সম্ভব, কিন্তু মানুষের মন অথবা নারীর মন সম্বন্ধে সত্যভাষণ যদি কেউ করেন তাহলে বলতেই হবে এ ঘটনা সম্ভব হতে পারে না, যে পুরুষ শ্রেষ্ঠতর বিনিময়ে অর্জন করেছে একটি ক্ষত্রিয় নারীকে সে হয়তো তার অধিকার অনেকাংশে ত্যাগ করতে পারে ভ্রাতৃনিষ্ঠায় কিন্তু বীরত্বের উজ্জ্বল আদর্শে যিনি একটি যুবতী মনের একছত্র সাম্রাজ্যে অধিকার করে আছেন সেই অধিকারটি কি মন থেকে সরে যেতে পারে ? গুরুজনের অনুজ্ঞায় যেতে সে পারে না, এই মানবী সত্যটি অচঞ্চলভাবে উচ্চারণ করেছে দ্রৌপদী। সে নিঃশঙ্কোচভাবে স্বীকার করেছে অর্জুনই তার স্বামী আর কেউ নয়।

‘পাঞ্চালীর চির বা পাঞ্চলীর প্রতি

ধনঞ্জয়।

—এই সত্যকথাটি উচ্চারণ করার জন্যে ধর্ম যদি তাকে পাপ দেয়, সেই দম্ভ সে অক্লেশে বহন করতে পারবে, একথাও সে বলেছে, নারীর এই স্বাধীন চিন্তায় কবি উন্মোচিত করতে পেরেছেন। স্বামীকে অন্ধভাবে অনুসরণই পত্নীর পরমব্রত তাতেই সতীত্বের পরাকাষ্ঠা, ভারতীয় রীতিতে এই সংস্কার নারীত্বকে বহুদিক অবদমিত রেখেছে। বীরাঙ্গনা কাব্যের কয়েকটি নায়িকার মাধ্যমে এই অবদমিত নারীত্বকে উন্মোচিত করার বিপ্লবাত্মক কর্মে প্রয়াসী হয়েছেন কবি। দুর্যোধনের কর্মপ্রণালীর সমালোচনা করেছেন ভানুমতী তাঁর স্ত্রী সপ্তম সর্গে। পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্ররোচনা তাঁকে অন্যায়ভাবে দিয়েছেন কষ্ট, এই প্ররোচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যথার্থ শুভার্থী পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যে দুর্যোধনের করা উচিত নয়, সেকথা ভানুমতি তার চিঠিতে বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করেছে।

অপর নায়িকা জনার অবশ্য এই ধরনের শান্তভাবে কিছু বোঝানোর মতো মানসিক অবস্থা ছিল না। যোগ্য বীরসন্তান প্রবীরকে অন্যায় যুদ্ধে হত্যা করেছেন অর্জুন। সেই পুত্রঘাতি শত্রুকে তাঁর স্বামী কেবল নিষ্কৃতি দেননি। তাঁকে মহিমপুরীতে ডেকে নিয়ে এসে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক পাতাবার চেষ্টা করেছে। এই ঘটনা জনাকে প্রায় উন্মত্ত করে তুলেছে। স্বামীকে তিনি বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। অৰ্জ্জুনকে নবরূপী নারায়ণ মনে করে পুজো করার প্রচেষ্টা অর্থহীন। স্বৈরিণী মাতারা গর্ভে নারায়ণ জন্মগ্রহণ করতে এসেছেন একথা বিশ্বাস করা যায় না। ব্যাসদেব অর্জুনের জয়গান গাইলেও তার জীবন কলঙ্কিত। দ্রোণাচার্য, ভীষ্ম, প্রবীরকে তিনটে কাপুরুষেচিত উপায়ে হত্যা করেছেন তাতে বীর মাত্রেরই মনে লজ্জা হওয়া উচিত। জনা যখন এত দৃষ্টান্ত দিয়েও স্বামী নীলধ্বজকে বিচলিত করতে পারেননি তখন তিনি ব্যঙ্গ বিদ্রূপ বর্ষণ করেছেন। একটি নারী ব্যক্তিত্বের এই স্ফূরণ আমাদের বিস্মৃত করে।

এই ব্যক্তিত্বেরই একটি দিক আমরা দেখি অষ্টম সর্গে অঙ্কিত দুঃশলা চরিত্রে। স্বামী জয়দ্রথকে বধ করার যে ভীষণ প্রতিজ্ঞা অর্জুন করেছিলেন তা শুনেই যুদ্ধের বিভীষিকা বর্জন করে সে শান্ত সুন্দর এক তীক্ষ্ণতর দাম্পত্য জীবনের আহ্বান জানিয়েছেন তাঁর স্বামীকে।

পৌরাণিক চরিত্র নতুনতর ব্যঞ্জনায় প্রায় নতুন হয়ে উঠেছে চতুর্থ ও পঞ্চম সর্গে। দশরথের স্ত্রী কৈকেয়ী রাজাকে সত্যভঙ্গের অপরাধে অপরাধী করেছে এবং এই সত্য রাজার দুটি বরদানে পৌরাণিক স্বীকৃতি নয়। মানবিক দুর্বলতাক্রমে প্রদত্ত বধূর আশ্বাস। কৈকেয়ীর যৌবন সুধা পানে তৃপ্ত রাজা দশরথ কামামোদে মত্ত হয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার গর্ভজাতপুত্র ভরতই যুবরাজ পদে অধীষ্ঠ হবে। সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পর একেবারেই মানসিক কারণে কৈকেয়ী রাজাকে অভিযুক্ত করেছে। শূর্পণখা চরিত্রটি আরও মানসিক ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে কবির হাতে। মধুসূদন ভোলেননি সে রাবণের ভগ্নী, অতুল ঐশ্বর্য সুখে প্রতিপালিতা রাক্ষস কুলোদ্ভব এবং রাম রূপবিদ্যায় পারদর্শিনী, মানবিক প্রেমেই আপ্লুত হয়ে সে লক্ষ্মণের কাছে প্রেম নিবেদন করছে, প্রেমাস্পদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাবার জন্য সমস্ত দুঃখ বহন এবং ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে। পৌরাণিক রাক্ষসী চরিত্রের মাধ্যমে প্রেমময়ী নারী করে তুলেছেন।

এই কারণেই বলা যায় মধুসূদন তাঁর ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে আধুনিক চেতনার স্পষ্ট প্রমাণ রেখেছেন। ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণ যে মানবিকবোধ জাগিয়ে তুলেছিল মধুসূদনের স্পষ্ট নারীচরিত্রগুলি সেই মানবিক বোধে উজ্জীবিত। ফলে বাংলা সাহিত্যে নারীমুক্তির যে আন্দোলন সূচিত হয়েছে উত্তরকালে, মধুসূদনকে তার অগ্রপথিক বলা যায়—অন্ত্যজ বীরাঙ্গনা তারই সুস্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করছে।

এই প্রশ্নের অনুকরণে লেখা যায়—

(১) উনিশ শতকের নারী ব্যক্তিত্বের জাগরণ কীভাবে ও কতটা বীরাঙ্গনা কাব্যে রাজ করেছে আলোচনা করো। অথবা (২) বীরাঙ্গনা কাব্য সৃষ্টিতে কবির কোনো উদ্দেশ্যমূলকতা কাজ করেছে কিনা তা পাশ্চাত্য প্রভাব ও কাব্যের উৎসর্গের দিকে লক্ষ্য রেখে আলোচনা করো। অথবা (৩) বীরাঙ্গনা কাব্যে নারীমুক্তির কথা বলা হয়েছে আলোচনা করো। অথবা (8) বীরাঙ্গনা কাব্যে রেনেসাঁসের প্রভাব আলোচনা করো। অথবা (৫) বীরাঙ্গনা কাব্যের কাহিনি সূত্র পৌরাণিক হলেও চরিত্রগুলি একেবারেই আধুনিক আলোচনা করো। অথবা (৬) মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যে এমন কতকগুলি লক্ষণ পাই যাদের যথার্থ আধুনিক বলে বোধ হয়—আলোচনা করো।