যুগস্রষ্টা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা কাব্যে এনেছিলেন মানবতাবাদ, এনেছিলেন নবজাগরণের জোয়ার। নবযুগের জয়োল্লাসের বাণী। তার রচনার মধ্যে দিয়ে স্বর্গীয় দেবতা, অপ্সরাগণ যেমন মাটির কাছাকাছি এসে মানুষে পরিণত হয়েছে, রাক্ষস দৈত্যাদিও তেমনি স্বীকৃত হয়েছে অনার্য মানুষ হিসেবে। মানুষের উচ্চারচ স্তর নির্বিশেষে সকলকে মানুষের রূপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের চরিত্রে মানবতাবাদের বীজ উপ্ত করে দিয়েছেন।
তাঁর আগের যুগে দেবতাকে দূরে বসিয়ে তাঁর অলৌকিকতা সম্বলিত কাহিনী বিন্যাসেই অভ্যস্ত ছিল বাংলার অধিকাংশ সাহিত্য জগৎ। সাহিত্যের জগতে অধিকাংশ আখ্যান ছিল দৈবাধীন ঘটনা সংঘটন পূর্ণ। পুরুষরা যেমন ছিল দৈব নির্ভর নারীরাও তেমনি ছিল হয় সতী শিরোমণি অথবা অবহেলার সামগ্রী। তৎকালীন সমাজে নারীদের না ছিল কোন স্বাধীনতা না স্বতন্ত্র মনোবৃত্তি। মনের ভাব প্রকাশ তাদের পক্ষে প্রায়শঃই ছিল অসম্ভব। এমন কি প্রেমানুরাগের ক্ষেত্রেও তাদের মেনে চলতে হত সমাজকে, শাসনকে। অর্থাৎ সব দিক থেকেই তারা ছিল পরাধীন। অথচ পুরাকালে এমন ব্যবস্থা ছিল যেখানে পুরুষের পাশেই নারীর স্থান ছিল। আবশ্যিক বক্তব্য ছিল, ‘নানা নারীং নিষ্ফলা লোকযাত্রা।’ তাই সে যুগে নারীকে দেখা যেত যজ্ঞ বেদীতে আহুতি দান করতে, যজ্ঞোপবীত ধারণ করতে। এর পরের যুগে কিছু সামাজিক বিধানের প্রচলন করার জন্যে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও রাজার যৌথ উদ্যোগে নারীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে পরাধীন করে দেওয়া হল। সেই পরিবেশের মধ্যে কবি মধুসূদন নারীদের মর্যাদা দিতে শেখালেন। তাদের মানুষ জ্ঞান করতে আহ্বান জানালেন। সেই মানবতার ছোঁয়ায় বীরাঙ্গনা কাব্যের নায়িকারা হয়ে উঠলেন আধুনিক জীবন বোধের রূপায়ণ।
বীরাঙ্গনা কাব্যের শকুন্তলার মধ্যে লক্ষ্য করা যায় আধুনিক মানসিকতার প্রতিবিম্বন। কালিদাসের শকুন্তলার মতো মধুসুদনের শকুন্তলা সখী নির্ভর নয়। কালিদাসের শকুন্তলার যা কিছু বক্তব্য বা সংলাপ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের হিসেবে তার এক তৃতীয়াংশ শকুন্তলা বলেছেন বাকিটুকু সম্পূর্ণ করেছেন তার সখীদ্বয়। এমন কি রবীন্দ্রনাথের মতে দুষ্মন্তের রাজসভায় সখীদ্বয় উপস্থিত ছিল না বলেই শকুন্তলাকে রাজা চিনতে পারেন নি। এহেন সখীসর্বস্বতার লক্ষ্য মধুসূদনের শকুত্তলার মধ্যে দৃষ্ট হয় না। বীরাঙ্গনা শকুন্তলা নিজেই রাজাকে পত্র লিখেছেন, তার মনোভাব জানিয়েছেন। এ শকুন্তলার নব জন্মে। নতুন করে তাঁকে বাংলা সাহিত্য পাঠকের কাছে এনে দিয়েছেন কবি মধুসূদন। যে শকুন্তলা বিলাস ব্যসনাকাঙ্ক্ষী নয়। বহু নারী ও বহু প্রেম বিলাসী রাজার কাছে তার একটাই বক্তব্য ‘কিঙ্করী করিয়া মোরে রাখ রাজপদে।’ মধুসূদনের শকুন্তলা তার চারিত্রিক দৃঢ়তায়, বচন পারিপাট্যে এবং কাহিনীর নব বিন্যাসে আধুনিকতার বাতাবরণ সংবাহী। পুরাতন শিল্পের মধ্যে নব অর্থ ও মাধুর্যের অনুসন্ধান এবং নব রূপায়ণ পদ্ধতিও আধুনিকতার আরো একটি লক্ষণ। সে দিক থেকে বিচার করলেও শকুন্তলা আধুনিক জীবনবোধের রূপায়ণে রূপায়িত।
বীরাঙ্গনা কাব্যের তারা এক প্রেম বুভুক্ষু নায়িকা। তিনি যেমন প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী তেমনি বিদ্রোহিনী। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের তারাই বোধ হয় প্রথম সমাজ বহির্ভূত প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী। খুব সম্ভব বীরাঙ্গনা কাব্যের তারা চরিত্রের আদর্শ থেকেই সাহিত্যে অবৈধ প্রেম সম্পর্কের কাহিনী প্রচলন শুরু হয়।
মধুসূদনের তারা অবলা নয় সবলা। আপন ভাগ্যকে আপন হাতে চালিত করার সুদৃঢ় মানসিকতা তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। আধুনিকতার লক্ষণাযোগে তারা তার প্রেমের অকুণ্ঠ অভিব্যক্তি দান করেছে। তারার প্রেম সমাজ নিন্দিত হলেও মুক্ত স্বভাবী। বীরাঙ্গনা কাব্যের দ্বিতীয় স্বর্গে তারার পত্রেই নারীর মনের আবেগের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতায় যে মত ব্যক্ত হয়েছে–বিবাহের পরেও নরনারীর পরকীয়া প্রেমের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রসঙ্গে, সে কথাই ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে মধুসূদন তারা পত্রিকার মাধ্যমে বলতে চেয়েছেন। তাই তাঁর তারা আধুনিক জীবনবোধের লক্ষণাক্রান্ত। তার প্রেম তার চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে সমস্ত সম্পর্ক সূত্র আপন মনে নিয়ন্ত্রিত করতে এক কথায় তাকে স্বাধীন করতে সাহায্য করেছে। স্বাধীন চিন্তায় তার আচরণ ও মানসিকতা তার নতুন প্রেমের অনুকূলে প্রবাহিত হয়েছে। তাই গুরুপত্নীরূপে সামাজিক শাসনানুসারে বাধ্য হয়ে সে চন্দ্রের প্রণাম গ্রহণ করলেও মানসিক ভাবে তার নব ব্যাখ্যায় মনকে তুষ্ট করেছে। এ কথাও তারা অকুণ্ঠে চন্দ্রকে জানিয়েছে, যাতে তার প্রেম চন্দ্র মাতৃজ্ঞানে প্রত্যাখ্যান না করে—
“গুরুপত্নী বলি যবে প্রণমিতে পদে
সুধা নিধি, মুদি আঁখি, ভাবিতাম মনে
মানিনী যুবতী আমি, তুমি প্রাণপতি
মান-ভঙ্গ আশে নত দাসীর চরণে।”
প্রেমের মধ্যে একটা ভাব হল দাস্য ভাব। দাস্য ভাবের মাধুর্য ও পরিচয় পাওয়া যায় বৈষ্ণব সাহিত্য জুড়ে। কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম্’-এ ব্যক্ত হয়েছে প্রেমে দাস্য ভাবের মাধুর্য। সেখানে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধার মান ভাঙাতে, ‘দেহি পদপল্লবমুদারম্’ বলেছেন। এমনকি কথিত আছে এই দাস্য ভাবের কথাটি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ ছদ্মবেশে এসে কবি জয়দেবের খাতায় লিখে গিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ পুরুষোত্তম বিশ্বপূজা হয়েও যদি কোন নারীর চরণ প্রার্থনা করতে পারেন তবে সাধারণ পুরুষদের পক্ষে তা আর এমন কি? এই ভাবনা মনে রেখেই তারার চরণে পতিত চন্দ্রকে দেখে মনে হয়েছে বুঝি মানিনীর মান ভাঙাতে প্রেমাস্পদ তার পায়ে ধরছে। জয়দেবের গীতগোবিন্দমের ক্ষেত্রে এই দাস্য ভাবে প্রণয়কাঙ্ক্ষা যেমন বিপ্লবের সৃষ্টি করেছে, এখানেও তেমন। এখানে প্রেমের কারণে তারা বিদ্রোহী, প্রেমের বীর্যে অশঙ্কিনী। বস্তুতঃ প্রেম বঞ্চিত প্রেম বুভুক্ষু এবং প্রণয়ী নারীর কাছে পাত্র অপাত্রের বাছ বিচার থাকে না।
তারা চরিত্র আরো আধুনিক এই কারণে যে সে মধুসুদনের হাতে গড়া পৌরাণিক তারার অভিনব সংস্কার। পৌরাণিক তারা সমাজ শাসনের ভয়ে ভীতা। সতীত্ব রক্ষার তাগিদে বা তাড়নায় তার যৌবন ও মনের ওপর ছিল কড়া সংযম শাসন। কিন্তু মধুসূদনের তারা মনকে, মনের সত্যকে অস্বীকার করে নি। তার প্রেম নিন্দিত হলেও সমাজের কাছে গোপন হলেও মুক্ত প্রেম ও প্রেমমুক্তির গর্বে তারা অশঙ্কিনী।
আধুনিকতার অপর একটি লক্ষণ হল কোন চরিত্রই অপর কোন চরিত্রের আদলে তৈরি নয়। বীরাঙ্গনা কাব্যের প্রতিটি নায়িকাই তাই স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত। শকুন্তলা, তারা, দ্রৌপদী এই তিন নায়িকাই প্রেমাকাঙ্কিণী। এদের মধ্যে শকুন্তলা ও দ্রৌপদীর অবস্থা প্রায় এক। উভয়েই প্রোষিত ভর্তৃকা। উভয়েই পতি মিলনের আকাঙ্ক্ষায় উৎকণ্ঠিতা। কিন্তু দুটি চরিত্র গঠনের দিক থেকে, মানসিকতার দিক থেকে যেমন ভিন্নধর্মী, অভিজ্ঞতার দিক থেকেও তেমনি। শকুন্তলা শাস্ত, হিংসাদ্বেষ অসুয়ালেশহীন, সে উচ্চকণ্ঠে কথা বলতে পারে না, তার থেকে কেউ কোনরূপ আঘাত বা কষ্ট পাবে এ তার আচরণের কোথাও দৃষ্ট হয় না। শকুন্তলা সদাসর্বদা নম্র নত ও ক্ষমাশীলা। কিন্তু দ্রৌপদী দাম্পত্য লীলা অভিজ্ঞ। প্রবাসী স্বামীর প্রতি কি ধরনের বিদ্রূপ ও অভিমানী পত্র তাঁকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনে মরিয়া করে তুলবে, তা তার জানা আছে। স্বামীর হৃদয়ে তার অবস্থান সম্বন্ধে সে অসন্দিগ্ধ এবং প্রেমে আস্থাশীল। নিজের সামর্থ্য সম্বন্ধে দ্রৌপদী সচেতন তাই অর্জুনকে দ্বিধাহীন ভাবে, খোঁপায় পারিজাত ফুল পরার আব্দারের পাশে পাশে, উপদেশ দেয় পত্রবাহক ঋষিপুত্রের যথাযোগ্য সমাদর করতে এবং পরামর্শ দেয়—
“কি কাজ উত্তরে?
পত্রবহ সহ ফিরি আইস এ বনে।”
এই পরামর্শের আড়ালে যে প্রেমের আহ্বান প্রচ্ছন্ন রয়েছে কামক্রীড়া অভিজ্ঞ কোন পুরুষের পক্ষে তাকে উপেক্ষা করা সহজ নয়।
শকুন্তলা ও দ্রৌপদী চরিত্র দুটি যেমন উভয়ে প্রোষিতভর্তৃকা হওয়া সত্ত্বেও ভিন্নধর্মী এবং আধুনিক। অনুযোগ পত্রিকা রচয়িতা কেকয়ী এবং জনা চরিত্র দুটিও তেমনি ভিন্ন রকমের একের চরিত্রের আদল না আদর্শ কোনটিই কারো ওপর বর্তায় নি। একজন নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে স্বামীর প্রতি অনুযোগ অভিমান করেছেন। অপরজন ক্ষত্রিয় নারীর মর্যাদা রক্ষার তাড়নায় স্বামীকে ভর্ৎসনা অনুযোগ করেছেন। দুই নারীর অভিযোগ অনুযোগের মূল সূত্র সন্তান। কিন্তু একজন সন্তানের সিংহাসন-বঞ্চনার জন্যে ক্ষুব্ধ, অপরজন পুত্রহত্যার প্রতি প্রতিশোধ না নেওয়ার জন্যে ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ। দুটি চরিত্রই দৃঢ়তায়, চিন্তা চেতনায়, রাজনীতি জ্ঞানে পৌরাণিক চরিত্র থেকে ক্রমবিকশিত, বিবর্তিত। দু’জনের মধ্যেই আধুনিকতা সমভাবে বিদ্যমান। মানবিকতাবোধে দুটো নারী সত্তাই মধুসূদনের কাছে স্বাধীন ব্যক্তি মর্যাদা লাভ করেছে। তাদের চিন্তা ভাবনার গুরুত্বও যথেষ্ট পরিমাণে প্রদান করা হয়েছে বীরঙ্গনা কাব্যে। এই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যই নব যুগের নতুন বাণী যা আধুনিকতা নামে পরিচিত। কাজেই বীরাঙ্গনা কাব্যের নায়িকারা যে আধুনিক জীবন বোধের রূপায়ণ এ কথার স্বপক্ষে অনায়াসে মত দান করা যায়।
Leave a comment