বীরাঙ্গনা কাব্যের নায়িকাদের প্রথাগত ভাবে বীর বলা চলে না- তা সত্ত্বেও এর নামকরণে বীরাঙ্গনা নায়িকার উল্লেখ যুক্তিযুক্ত কিনা বিচার করো।
বাংলা কাব্যের নবজাগরণের সার্থক রূপকার কবিপুরুষ মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মঙ্গলকাব্যের ধীরপ্রবাহী ধারাটি ভেঙে দিয়ে নব আবেগ স্পন্দিত, প্রাণ প্রবুদ্ধ অমিত্রাক্ষর ছন্দের উদ্ভাবনে যে নতুন যুগের সৃষ্টি করেছিলেন তার প্রথম পদক্ষেপে ছিল ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’। তারপরেই সৃষ্টি করলেন ওজঃশক্তি সম্পন্ন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বাংলা ভাষা যে এত বীরত্বব্যঞ্জক হতে পারে, ললিত কলানিধির মধ্যে যে এত বীররস সঞ্চারিত ছিল, বস্তুত মেঘনাদবধ কাব্যের আগে তা বাঙালী সাহিত্য রসিকদের চিন্তাতেও ছিল না। এই ছন্দ এই কাব্য সৃষ্টি করে তিনি যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার করলেন, বাংলা ভাষাকে এগিয়ে দিলেন অন্ধকারের যুগ থেকে আলোক উদ্ভাসে। অমিত্রাক্ষর ছন্দে শুধুমাত্র উদ্দীপন বিভাব সঞ্জাত কাব্যই রচনা করেন নি। ব্রজাঙ্গনা কাব্যের মতো পেলব কোমল কাব্য রচনাও তিনি করেছেন এবং সর্বোপরি এই কঠিন কোমল ভাবের সংমিশ্রণে তিনি সৃষ্টি করলেন তার অনবদ্য বীরাঙ্গনা কাব্য।
রোমক কবি ওভিদের ‘The Heroides or Epistle of the Heroines’ কাব্যের অনুসরণে তিনি বীরাঙ্গনা কাব্য রচনা করেছিলেন। ওভিদের কাব্যে ছিল একুশটি পত্র, মধুসূদনও প্রথমে একুশটি পত্র সহযোগেই কাব্য প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কার্যত এগারোটি পত্রের সমবায়ে বিন্যস্ত হয়েছিল তাঁর বীরাঙ্গনা কাব্য। উক্ত এগারোটি পত্রের পৌরাণিক নায়িকারা সকলেই সমগুণ সম্পন্না নন। কেউ যথার্থ বীর, কেউ কোমল চিত্তবৃত্তির অধিকারী, কেউ অবৈধ প্ৰণয়াকাঙ্ক্ষী কামুক, কেউ আবার বিগত যৌবনা স্বার্থান্বেষী। এই সমস্ত বিভিন্ন চিত্তবৃত্তিধারী পৌরাণিক নারী চরিত্রগুলিকে নিয়ে যুগোপযোগী কাব্য রচনা করেছেন। সে কাব্য যত অনবদ্যই হোক, একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে এই চরিত্রগুলিকে তিনি ‘বীরাঙ্গনা’ বললেন কেন? কিম্বা এই কাব্যের নামকরণ বীরাঙ্গনা কাব্য করলেন কেন।
বলাবাহুল্য বীরাঙ্গনা নায়িকাদের কাহিনী সম্বলিত হয়েছে বলেই এই কাব্যের নাম কবি দিয়েছেন ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’। সাধারণত বীর অর্থে আমরা যা বুঝি তা হল অসম সাহসী লড়াকু মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি। যিনি অনায়াসে যুদ্ধে যাত্রা করতে পারেন কিম্বা সমকালীন কোন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারেন। কিন্তু মধুসুদনের বীরাঙ্গনা কাব্যের একমাত্র জনা কিম্বা মেঘনাদবধ কাব্যের প্রমীলা ছাড়া অন্যান্য কোন নায়িকার মধ্যেই সে বীরত্বব্যঞ্জনা নেই। বীরাঙ্গনা কাব্যের অন্যান্য নায়িকারা নিতান্ত নারী। তাঁদের যাবতীয় চারিত্রিকগুণ তাঁদের কোমল চিত্তবৃত্তি সংযুক্ত হৃদয় নির্যাস। তা হলে এদেরকে বীরাঙ্গনা বলা হল কেন?
প্রথমত অনুমান করা যায় ওভিদের যে বীরপত্রাবলী বা The Heroides or Epistle of the Heroines থেকে প্রেরণা লাভ করে মধুসূদন তাঁর বীরঙ্গনা কাব্য রচনা করেছিলেন, নামকরণ বিষয়েও ওই কাব্য তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। বিশেষ করে ‘Heroines’ শব্দটি কবিকে, কবির ভাবনাকে আচ্ছন্ন করতে পেরেছিল। আর তাঁর কাব্যও তো কেবল নায়িকাদেরই পত্রের সমবায়ে গঠিত। নায়িকারা তাঁদের প্রেম, স্মরণ, প্রত্যাখ্যান অনুযোগাদি পত্র মাধ্যমে তাঁদের প্রেমিক অথবা স্বামীর কাছে প্রেরণ করেছেন। ফলত নায়িকারাই এখানে মুখ্য। তাই নামকরণ প্রসঙ্গে ‘Heroine’ শব্দের প্রতি মধুসূদনের মনাকর্ষণ স্বাভাবিক। কিন্তু কবি যথেষ্ট শব্দ সচেতন থাকার জন্যেই শুধু মাত্র Heroine শব্দের আক্ষরিক অনুবাদ করেই কাব্যের নামকরণ করেন নি। তিনি জানতেন কাব্যে সাহিত্যে কাব্য কবিতা-গল্প-নাটকাদির নামকরণ বিষয়টি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তাই শুধুমাত্র আপাতগ্রাহ্য আঙ্গিককে ছেড়ে তার বিষয়, বক্তব্য ও ব্যক্তিত্বের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করলেন। কাব্যে যেমন গতানুগতিক ঐতিহ্যকে বাড়তি মাত্রা আরোপ করে স্বতন্ত্র-ব্যক্তিত্বময়ী করতে তুললেন, কাব্যের নামকরণেও তেমনি নতুন চিন্তার আলোকসম্পাত ঘটালেন।
বীর শব্দের একটি অর্থ যেমন শক্ত সমর্থ ব্যক্তি, অপর অর্থে তেমনি শ্রেষ্ঠ। ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব তার বীর্যে, সৌন্দর্যে, ঐশ্বর্যে, মাধুর্যে। এই চারটি গুণের সমবায়ে, নারী পুরুষ উভয়েই শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হতে পারে। পুরুষের বীর্য যেমন তার শক্তিমত্তায়, নারীর বীর্য তেমনি তার ব্যক্তিত্বে। আর অঙ্গনা শব্দের অর্থ হল নারী—যে নারী সুন্দর দেহ বিশিষ্ট। সৌন্দর্য, মাধুর্য যে নারীর মধ্যে বিদ্যমান। যে শব্দে নারী কেবলমাত্র সন্তান প্রসবিনী নয়, কটাক্ষময়ী নয়, কাম বিশিষ্ট নয় কিম্বা যে শব্দ স্ত্রী জাতির প্রতি হীনমন্যতার অর্থবহ নয়, সে সৌন্দর্যে মাধুর্যে পরিপূর্ণা স্বতন্ত্রময়ী। অর্থাৎ ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দের অর্থে দাঁড়ায় সৌন্দর্য মাধুর্যে পরিপূর্ণা স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বময়ী শ্রেষ্ঠ নারী।
অন্যদিক থেকে বিচার করলে বীরাঙ্গনা শব্দের অর্থ দাঁড়াতে পারে বীরদের অঙ্গনা অর্থাৎ যে সমস্ত অঙ্গনা বা নারীর নায়কগণ বীর তাঁদেরও বীরাঙ্গনা বলা যেতে পারে। লক্ষ্যণীয় এই অঙ্গনাগণ তাঁদের যে প্রেমাস্পদ বা স্বামীকে পত্র লিখেছেন প্রত্যেকেই বীর এবং সেই বীরগণের অঙ্গনাগণ কর্তৃক রচিত পত্রকাব্যের নাম ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ হতে বাধা থাকে না। সে দিক থেকেও কাব্যের বীরাঙ্গনা নাম সার্থক হয়েছে।
মানবতাবাদী কবি নামকরণের ক্ষেত্রেও নারীকে যথার্থ মূল্য দান করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে নারীরা অবহেলিত জীব নয়, পুরুষের ভোগ্য পণ্য নয়, আচার ভীরু শাস্ত্রবাক্যে বাঁধা গভীতে তারা আবদ্ধ নয়। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ আহ্বান উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতে পারে। এমনকি প্রয়োজনে স্বামীর ঔদাসিন্যে পরিত্যক্ত কর্মকান্ডও সমাপ্ত করার কাজে এগিয়ে আসতে পারে। অথচ স্বামীকে অগ্রাহ্য অবহেলা করে নয়। সমাজকে অস্বীকার করে নয়। এরা প্রত্যেকেই প্রেমের বীর্যে অশংকিনী। কেবলমাত্র সংসারের ও সমাজের চাপে পিষ্ঠ হয়ে বংশগতি বাড়ানোর জন্যে সন্তান উৎপাদনকারী যন্ত্র মাত্র নয়। এদের যথার্থই মূল্য আছে। সেই মূল্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে চেয়েই মধুসূদন এদের নারী বা রমণী না বলে এদের অঙ্গনা বলেছেন। পুরাণ ও মহাকাব্য থেকে চরিত্র চয়ন করতে গিয়ে তাঁকে এই দিক থেকেও যথেষ্ট চিন্তা করতে হয়েছিল। তাই দেখা যায় যে সমস্ত নায়িকা স্বীয় ব্যক্তিত্বে ব্যক্তিত্বময়ী, প্রেমাস্পদের জন্যে অন্য সমস্ত কিছু এমনকি স্বর্গসুখ থেকে বঞ্চিত হয়েও নিজেদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে না বা করতে দেয় না। কেবলমাত্র বীরগণের তথা পুরুষের ভোগ্য হয়ে নিজেকে উপস্থাপন না করে নারী-পুরুষের মিলিত সভ্যতায়, স্বচ্ছন্দে ও প্রেমে যারা বিশ্বাসী তারাই মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যের নায়িকা নির্বাচিত হয়েছে।
বস্তুত মধুসূদন প্রাচীন ঐতিহ্যকে হুবহু অনুকরণ না করে নতুন যুগের প্রেক্ষিতে নারীপ্রজাতির চেতনায় নায়িকাদের যথোপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছেন। বীরাঙ্গনা কাব্যের সমস্ত নায়িকাই তাই বীর্যবর্তী। সে পুরুষের পূজা চায় না, অবহেলা চায় না, সে চায় পুরুষের পাশে থাকতে, সঙ্কটে সম্পদে সহায় হতে। এই ব্যক্তিত্ব পৌরাণিক চরিত্রগুলির মধ্যে প্রতিফলিত হওয়ার ফলেই পত্রলেখিকা নায়িকারা প্রকৃত ও প্রচলিত অর্থে বীর বা দৈহিক শক্তিসম্পন্না কিম্বা প্রতিবাদী ব্যক্তিত্বাধিকারী না হওয়া সত্ত্বেও তারা বীরাঙ্গনায় পরিণত হয়েছে। এই দিক থেকে বিচার করে দেখলে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণ সার্থক বলেই বিবেচিত হতে পারে।
Leave a comment