রোমক কবি ওভিদের “The Heroides or Epistle of the Heroines কাব্যের অনুসরণে যুগন্ধর কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এগারোজন পৌরাণিক নায়িকাকে অবলম্বন করে বীরাঙ্গনা কাব্য রচনা করেছিলেন। পত্রগুলির মধ্যে এগারোজন নায়িকার মনোভাব তাদের প্রেমিক অথবা স্বামীর কাছে ব্যক্ত হয়েছে। এগারোটি পত্র কাব্যসমালোচকদের মতে চারটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত। একই শ্রেণীভুক্ত পত্র একাধিক নায়িকা রচনা করলেও প্রতিটি পত্রিকাই স্বতন্ত্র ধরনের। মূলত নায়িকাদের ব্যক্তিত্ব ও অবস্থা বিশেষের ওপর ভিত্তি করার কারণে পত্রগুলির মধ্যে বৈচিত্র্য পরিস্ফুট হয়েছে।

বক্ষ্যমান আলোচ্য ‘তারা পত্রিকা’ ও ‘শূর্পণখা পত্রিকার মধ্যেও স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান। অথচ, দুটি পত্রিকার সুরই প্রেমের সুর। দুই প্রণয়ী তাদের প্রেমিকদ্বয়ের কাছে প্রেম নিবেদন করেছেন পত্র মাধ্যমে। দুজনেই পূর্বপ্রেমভোগী, তারা বৃহস্পতির পত্নী। তিনি তার স্বামীর শিষ্য চন্দ্রের প্রতি প্রেম নিবেদন করেছেন। আর শূর্পণখা, বাল্যবিধবা, তিনি লক্ষ্মণের প্রতি তাঁর প্রেম আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছেন।

আলোচ্য দুটি পত্রের মধ্যেই নবযুগের নারীভাবনা তথা নারীর ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের দাবি প্রস্ফুট হয়েছে সার্থকভাবে স্বামীঅন্তঃপ্রাণা কিম্বা বৈধব্যরীতি অনুযায়ী জৈব চাহিদা বিবর্জিত হয়ে বেঁচে থাকার কষ্টকর সামাজিক অনুশাসন এখানে লঙ্ঘিত হয়েছে। দুই নায়িকাই ‘পরপুরুষের প্রতি তাঁদের প্রেম অকুণ্ঠে নিবেদন করেছেন।

বীরাঙ্গনা কাব্যের উক্ত দুটি পত্রের মধ্যে সবিশেষ লক্ষ্যণীয় হল, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ওপর দাঁড়িয়ে ওই দুই অঙ্গনা নতুন পথের নতুন বার্তা আনতে সচেষ্ট হয়েছে। উভয়েরই প্রেমিকের পক্ষ থেকে কোনো আবেদন আসার পূর্বেই নিজেদের ‘যৌবন ধন’ অর্পণ করার বাসনা জ্ঞাপিত হয়েছে। এ দিক থেকে বিচার করে দেখলে দুটি চরিত্রকেই বিদ্রোহিনী চরিত্র বলা যেতে পারে। তবে তুলনামূলক ভাবে শূর্পণখার চেয়েও তারা অনেক বেশি সাহসী ও বিদ্রোহিনী।

তারা বিবাহিতা। তাঁর স্বামী দেবপূজা দেবগুরু বৃহস্পতি। কিন্তু স্বামী যতই পূজামান হোন, তারার নারী জীবনের জৈব আকাঙ্ক্ষা তাঁর পক্ষে পূরণ করা সম্ভব হয় নি। তিনি পূজো, পাঠ, হোম, ধ্যান, শিষ্য, অধ্যাপনা নিয়েই ব্যস্ত। যুবতী তারার মন ও যৌবন তাঁর কাছে ছিল উপেক্ষিত। প্রেমবুভুক্ষু তারা তাই তাঁর স্বামীর শিষ্য চন্দ্ৰ তথা সোমকে দেখে প্রেমাসক্তা হয়ে, নিঃশব্দে নিজ মনোভাব গোপন করে, সেবা করে যেতে লাগলেন।

কিন্তু যেদিন কৃতবিদ্য হয়ে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের আয়োজন করতে লাগলেন সেদিনই তারা তাঁর মনের ভাব ব্যক্ত করে সোমকে পত্র লিখে পাঠালেন। লিখলেন প্রথম দিন থেকে তাঁর আচরণের কথা, প্রেমাকাঙ্ক্ষার কথা—

“এ নব যৌবন, বিধু, অর্পিব গোপনে

তোমায়,”

এবং লিখলেন, 

“জীবন মরণ মম আজি তব হাতে।”

অন্যদিকে রাবণের ভগিনী শূর্পণখা—বিধবা। পুরুষ সংসর্গ একবার তার দেহে মনে জৈব আস্বাদ জাগিয়ে দিয়ে অন্তর্হিত হয়েছে। সেই অবস্থায় তিনি জটাজুট সমাযুক্ত ভস্মাচ্ছাদিত অগ্নিস্বরূপ লক্ষ্মণকে দেখেছেন। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রেমাকাঙ্ক্ষা জেগেছে শূর্পণখার দেহে, মনে। সেই প্রেম বুভুক্ষার কথা জানাতেই লক্ষ্মণের কাছে তিনি পত্র প্রেরণ করেছেন।

শূর্পণখার পত্রে নারীজীবনের ভালোবাসার পাত্রের প্রতি ছোটখাট যত্নআর্তির কথাও চমৎকার ভাবে ফুটে উঠে পত্রিকাটিকে আন্তরিক করে তুলেছে। তিনি লক্ষ্মণকে নানাভাবে নানা রূপে সেবা করতে চান। চান লক্ষ্মণের সমস্ত সংকটে সহায় হতেও। অকুণ্ঠে তিনি তাই লেখেন—

“কহ, কোন্ যুবতীর – (আহা, ভাগ্যবতী

রামাকুলে সে রমণী!) কহ শীঘ্র করি, 

কোন যুবতীর নব যৌবনের মধু 

বাঞ্ছা তব? অনিমেষে রূপ তার ধরি

(কামরূপা আমি, নাথ) সেবিব তোমারে।”

তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি, মায়াবী কৌশল লক্ষ্মণের কল্যাণে প্রয়োগ করে লক্ষ্মণকে কাছে পেতে চান। লক্ষ্মণের অভাবে তাঁর আহার বিলাস শয্যা সবই বিস্বাদ লাগে। যদি লক্ষ্মণের অনুমতি পান, তবে রাজনন্দিনী শূর্পণখা তাঁর মনিময় আবরণ, আভরণ ত্যাগ করে শুধুমাত্র বাঙল আশ্রয় করেও লক্ষ্মণের অনুগামিনী হতে পারেন। তারার মতো তিনিও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছেন—

“প্রেম-মন্ত্র দিও কর্ণ মূলে!

গুরুর দক্ষিণারূপে প্রেম গুরু পদে

দিব এ যৌবন ধন প্রেম-কুতূহলে!

প্রেমাধীনা নারীকুল ভরে কি হে দিতে 

জলাঞ্জলী, মঞ্জুকেশি কুল, মান, ধনে,

প্রেম লাভ লোভে কভু?”

প্রকৃতপক্ষে তারা এবং শূর্পণখা দুজনেই প্রেমবুভুক্ষু নারী হলেও দুজনার মানস গঠনে কিছু পার্থক্য আছে। শূর্পণখা রাক্ষস দুহিতা ফলত তাঁর মধ্যে সংস্কৃতি চেতনার অভাব আছে। তিনি ভোগে বিশ্বাসী। সে ভোগও সংযম রহিত তামসিকতায় পূর্ণ। পক্ষান্তরে তারা দেবগুরু বৃহস্পতির পত্নী হওয়ার কারণে আত্মবিশ্লেষিকা। যার ফলে ঋষিকুলোদ্ভবা এবং ঋষিপত্নী হয়েও তারা জৈব ধর্মের কারণে অনার্যা নারীর মতো আচরণ করে ‘চণ্ডালিনী’ বলে ধিকৃত করেছেন। সে আবেগকে সংযত করার ক্ষমতা তারার নেই। তবু তারা মাথা উঁচু করে নিজ মনের কথা আত্মবিশ্লেষণ সহ তুলে ধরেছেন তাঁর পত্রিকায়। এই কারণেই শূর্পণখার চেয়েও তিনি মহিয়সী এবং বিদ্রোহিনী প্রগতিশীলা বীরাঙ্গনা।