রোমক কবি, ওভিদের The Heroides এর প্রেরণায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত পৌরাণিক উপাদান দিয়ে নব যুগের কৃত্রিম ক্লাসিক বীরাঙ্গনা কাব্য রচনা করেন। পুরাণ ও মহাকাব্যের কয়েকজন নায়িকার চরিত্র চয়ন করে। তাঁদের বয়ানে তাঁদের প্রেমিক, প্রেমাস্পদ বা স্বামীর উদ্দেশ্যে লিপি রচনা করে বাংলা কাব্য সাহিত্যে অভিনব পত্রকাব্য সৃষ্টি করেছিলেন। এই পত্রকাব্যের ধারা বাংলা সাহিত্যে আর নজরে পড়ে না। বাংলায় পত্র উপন্যাস, পত্র-গল্প পরবর্তীকালে এমনকি তার আমলে অনেক রচিত হয়েছে কিন্তু পত্রকাব্য আর রচিত হয় নি।

পৌরাণিক এগারোজন নায়িকাকে বেছে নিয়ে মধুসূদন তাঁদের স্বভাব, ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রানুযায়ী নানা উপলক্ষে পত্র রচনা করেছেন। সেই এগারোখানি পত্রিকা বীরাঙ্গনা কাব্যের এগারোটি সর্গরূপে সংকলিত হয়েছে। যদিও উক্ত এগারোখানি পত্রের মূল সুর – প্রেমের সুর। তবু পত্রগুলির মধ্যে স্বাতন্ত্র্যভাব বিদ্যমান। আবার সমালোচকগণ উক্ত এগারোটি পত্রকে চারটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করেছেন। স্মরণার্থ পত্রিকা, প্রেম পত্রিকা, প্রত্যাখ্যান পত্রিকা এবং অনুযোগ পত্রিকা – এই চারটি শ্রেণীতে বিনস্ত করে সমালোচকগণ বীরাঙ্গনা কাব্যের আলোচনা করেছেন। চার শ্রেণীর মধ্যে বর্তমান আলোচ্য বীরাঙ্গনা কাব্যের চতুর্থ সর্গের কেকয়ী এবং একাদশ সর্গের জন্য যথাক্রমে রাজা দশরথ ও মাহেশ্বরী রাজ নীলধ্বজকে যে পত্র লিখেছেন তা অনুযোগ পত্রিকা শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। স্বামীর অন্যায় আচরণে এই দুই নায়িকা ক্ষুব্ধ মর্মাহত। স্বামীকে সংশোধন এবং তাঁর কৃতকর্মের ভ্রম সংশোধনে দুই নায়িকার প্রয়াসে এবং অবশেষে স্বামীকে নানা উপদেশ ও ভর্ৎসনা সহযোগে অনুযোগে পত্রিকা দুটি রচিত।

রামায়ণের অন্যতমা নায়িকা দশরথ পত্নী কেকয়ী, কেকয়রাজ দুহিতা। রামায়ণের মধ্যে তাঁর কোন পত্র রচনা ও প্রেরণ প্রসঙ্গ নেই। কিন্তু কবি মধুসূদন আপন প্রতিভা বলে, দশরথ ও কেকয়ীর প্রেমাবেগ কাহিনী, মনের সাধ ও সাধ্যের সঙ্গে সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতিতে তাঁদের ঘাত প্রতিঘাতের দ্বন্দ্ব থেকে যে নাটকীয়তা সৃষ্টি হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে পত্র রচনা করিয়েছেন। কেকয়ীর মতো জনাকে দিয়েও একটা উপলক্ষ সৃষ্টি করে সময়োপযোগী পত্র রচনায় উদ্বুদ্ধ করিয়েছেন।

কেকয়ী ও জনা দুজনেই ক্ষত্রিয় রমণী এবং রাজার পত্নী। উভয়েরই স্বামীর প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা অগাধ। উভয়েরই আত্মমর্যাদা সচেতন। এঁদের স্বামীদ্বয় তাঁদের আচরণে এঁদের মর্যাদার প্রতি আঘাত করেছেন। স্বামীর আচরণে আত্মমর্যাদার অবমাননা এবং জগৎসভায় তাঁদের আচরণের জন্যে সম্ভাব্য বিরুদ্ধ সমালোচনার কথা ভেবেই এই দুই নায়িকার উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। প্রথমে নানা ভাবে তাঁরা স্বামীদের বোঝাতে চেয়েছেন। ক্রমে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ এবং অবশেষে প্রায় মরিয়া হয়ে ভর্ৎসনা করে স্বামীকে এই দুই রাজী স্বমতে ও সৎপথে আনার চেষ্টা করেছেন।

দুই নায়িকার স্বামীর প্রতি ক্ষুব্ধ হবার কারণ তাঁদের পুত্রদের ঘিরে। কেকয়ী চান তাঁর পুত্র ভরতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। জনা চান তার পুত্রের হত্যাকারীর প্রতিশোধ নিতে। অন্ততঃ স্বামী নীলধ্বজের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বালাতেই তিনি নানাভাবে স্বামীকে উদ্দীপ্তরসে প্রদীপ্ত করতে চেষ্টা করেছেন।

পত্রিকা দুটির আরম্ভে একটা চমৎকার মিল লক্ষ্য করা যায়। উভয়েই দাসীর কাছে রাজসভার কথা শুনে মর্মাহত হয়েছেন এবং পত্রের শুরুতে উভয়েই তাঁদের স্বামীর চেতনা ফিরিয়ে আনতে রাজ্য জুড়ে আয়োজিত এবং পালিত আনন্দোৎসবের কারণ জিজ্ঞাসা করেছেন। তার মধ্যে কেকয়ীর পত্রে আছে নাটকীয়তার চমক আর জনার পত্রে আছে বীররসের দ্যোতনা। সম্ভবত কেকয়ী ও জনা উভয়েই তাদের স্বামীর আচরণে মর্মপীড়িতা বলেই এই ধরনের আকস্মিকতা দিয়ে দুটির রচনারম্ভ হয়েছে।

রাজা দশরথ একদা কেকয়ীর সেবায় তুষ্ট হয়ে তাঁকে কথা দিয়েছিলেন যে কেকয়ীর গর্ভজাত সন্তান ভরতকে তিনি যৌবরাজ্যে অভিষেক করবেন কিন্তু কার্যকালে তিনি জ্যেষ্ঠ পুত্র রামচন্দ্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করার কেকয়ী ক্ষুব্ধ। তিনি রামচন্দ্রের অভিষেকের কথা মন্থরার মুখে শুনে বিস্মিত হয়ে পত্ররচনা শুরু করেছিলেন।

রামায়ণের কেকয়ীর মতো মধুসূদনের কেকয়ীও দশরথের বিশিষ্টা প্রেয়সী। তিনি কুটিল স্বভাব নন, তাঁর দাসী মন্থরাই তাঁকে নানা মন্ত্রণা দিয়ে কুখ্যাত করিয়েছে। অন্যথায় তিনি পতি কল্যাণ পরায়ণা, সাধ্বী রমণী এবং বীরাঙ্গনা কাব্যেও দেখা যায় পুত্রের সৌভাগ্য বঞ্চনায় তিনি যতটা না ক্ষুব্ধ তার চেয়ে বেশি মাত্রায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। দশরথের মিথ্যাচারে। প্রথম দিকে স্বার্থ সর্বস্বতার লক্ষণ তাঁর পত্রিকায় দৃষ্ট হলেও পরের দিকে সত্য নিষ্ঠ ন্যায় বিচার প্রার্থনায় তাঁর আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে।

ভরতকে যৌবরাজ্যে অভিষেক না করার জন্যে কেকয়ী রাজা দশরথকে গঞ্জনা দিয়ে লিখেছেন –

কি সত্য করিলা প্রভু, ধর্মে সাক্ষী করি

মোর কাছে? কাম-মদে মাতি যদি তুমি

বৃথা আশা দিয়া মোরে ছলিলা তা কহ;—

নীরবে এ দুঃখ আমি সহিব তা হলে।

পুত্র ভরতের প্রতিষ্ঠার জন্যে যে বর কেকয়ী চেয়েছিলেন একদা দশরথের কাছে, সে প্রার্থনা অঙ্গীকার করে একদা দশরথ যে সত্য করেছিলেন, স্বামীর সে সত্যভঙ্গে কেকয়ী ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি রুষ্ট হয়ে রাজার বিরুদ্ধে কঠিন কথা ও সংকল্প উচ্চারণ করেছেন – এ কেকয়ীর অতিশয়োক্তি – ‘পরম অধর্মাচারী রঘুকুলপতি’। বার বার একই কথা বলে কেকয়ী রাজাকে যেমন সতর্ক সচেতন করে দিতে চেয়েছেন তেমনি এখানে কেকয়ীর ব্ল্যাকমেলিং-এর অপচেষ্টাও লক্ষিত হয়। কিন্তু এ টুকুতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকেন নি। পুত্র স্বার্থ প্রতিষ্ঠার দাবীতে তিনি সপত্নী কৌশল্যা এবং রামচন্দ্রের অপযশ ব্যাখ্যা করেছেন। অপিচ, ভরতকে রাজা দশরথের রাজপুরীতে শয্যাসনাশন নিষিদ্ধ করার হুমকিও তিনি দিয়েছেন –

“মাতামহালয়ে পাবে আশ্রয় বাছনি।

দিব্য দিয়া মানা তারে করিব খাইতে 

তব অন্ন, প্রবেশিতে তব পাপ পুরে।”

কেকয়ী পুত্রস্বার্থ প্রতিষ্ঠার জন্যে স্বামীর প্রতি যে রূপ ক্ষুব্ধতার প্রকাশ করেছেন, জনার পত্রিকায় তা পাই না। জনার ক্ষুব্ধতা যথেষ্ঠ যুক্তিসংগত এবং মর্মস্পর্শী। তিনি বিদ্রোহ করেছেন তাঁর পুত্র হস্তারকের প্রতি প্রতিহিংসার চরিতার্থতার দাবীতে।

যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া মাহেশ্বরী নগরে প্রবেশ করলে মাহেশ্বরী রাজার পুত্র প্রবীর তাকে ধরে ফেলে। ফলে অশ্বের তত্ত্বাবধায়ক অর্জুনের সঙ্গে তার যুদ্ধ হয় এবং পরিণামে অর্জুনের হাতে তিনি নিহত হন। এরপরে প্রবীরের পিতা তথা মাহেশ্বরী রাজের পক্ষে উচিত ছিল পুত্রহত্যার প্রতিশোধ নিতে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া। কিন্তু নীলধ্বজ অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে তাঁকে পরম মিত্র জ্ঞানে যথোচিত সমাদরে নিজ সিংহাসনে বসিয়ে নরনারায়ণ জ্ঞানে পূজা করতে লাগলেন। অর্জুনের মনোরঞ্জনের জন্যে নাচে গানে রাজসভা আনন্দময় করে তুলতে লাগলেন।

নীলধ্বজের এ হেন আচরণে স্বাভাবিক ভাবেই জনা মর্মাহত, ক্ষুব্ধ। তাঁর ক্ষত্রিয় রমণীর মর্যাদায় স্বামীর এই আচরণ আঘাত হেনেছে। তবে জন্য এই আত্ম-অবমাননার জন্যে স্বামীকে তীব্র কটাক্ষ করলেও তাঁর অমর্যাদা সূচক কোন কথা বলেন নি। বরঞ্চ তাকে উচিত পথে চালিত করার জন্যে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। এমনকি শত্রুর সঙ্গে বন্ধুবৎ আচরণ করে তিনি যে কাপুরুষোচিত আচরণ করেছেন সে বিষয়েও স্বামীকে সচেতন করতে তিনি যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ উক্তি করেছেন –

“না ভেদি রিপুর বড় তীক্ষ্ণতম শরে 

রণক্ষেত্রে, মিষ্টালাপে তুষিছ কি তুমি 

কর্ণ তার সভাতলে? কি কহিবে, কহ, 

যবে দেশ-দেশান্তরে জনরব লবে 

এ কাহিনী, – কি কহিবে ক্ষত্ৰপতি যত?”

অর্জুনের প্রতি নীলধ্বজের মোহের অবসান ঘটাতে জনা অর্জুনের মহাবীর খ্যাতির যে নেপথ্য কাহিনী তুলে ধরেছেন তা প্রাণিধানযোগ্য। তাঁর বক্তব্য একমাত্র শ্রীকৃষ্ণের সখা বলেই অর্জুনের মহাবীর খ্যাতিলাভ সম্ভব হয়েছে। আর দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় অর্জুন ব্রাহ্মণের বেশে ছিলেন বলেই ক্ষত্রবীরগণ তাঁর সঙ্গে যথাসাধ্য যুদ্ধ করেন নি। ফলে ‘রাজ দলে তেঁই সে জিতিল।’ কিন্তু এতেও যখন কোন কাজ হল না তখন কুত্তী, দ্রৌপদী এমনকি ব্যাসদেবেরও অপযশ গেয়ে স্বামীর মনে পুত্রহা রিপুর প্রতি প্রতিহিংসার আগুন প্রজ্জ্বলন করতে চেষ্টা করলেন।

অবশেষে যখন জনা দেখলেন কিছুতেই কিছু হবার উপায় নেই তখন স্বামীর চরণে চির বিদায় প্রার্থনা করলেন— 

‘যাচি চির বিদায় ও পদে’

লক্ষ্যণীয় কেকয়ী বিদায় প্রার্থনা করার সময় যে রোষ প্রকাশ করেছিলেন, জনা বিদায় কালে সে রোষ প্রকাশ করেন নি। তিনি বিদায় প্রার্থনা করেছেন সুতীব্র অভিমানে। তাঁর বীর পুত্রের মৃত্যুর প্রতিশোধ না নিয়ে তাঁর স্বামী যে অক্ষত্রিয় আচরণ করেছেন তাতে তাঁর অমর্যাদা হয়েছে। কিন্তু এই অমর্যাদার কারণে তিনি স্বামীকে কুবাক্য বলেন নি। বরঞ্চ যথোচিত শ্রদ্ধা বজায় রেখেছেন। বীরাঙ্গনা জনা চরিত্রের এটাই সবচেয়ে বড় গুণ।