মাইকেল মধুসূদন দত্তের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি বীরাঙ্গনা কাব্যের মধ্যে একাধারে কোমলতা ও কাঠিন্য ভাবের সমাবেশ ঘটেছে। নবজাগরণের কবি এখানে কড়ি কোমল ভাব অভিব্যক্ত করে পৌরাণিক কাহিনীর নবায়ণ ঘটিয়েছেন। পুরাণ ও মহাকাব্য থেকে উপাদান সংগ্রহ করে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তাকে নতুন করে নবযুগের ধ্রুপদী সাহিত্য নির্মাণ করেছেন। ফলে এই কৃত্রিম ক্লাসিক কাব্যে ফুটে উঠেছে এ যুগের প্রধানতম লক্ষণ— মানবতাবাদ। বীরাঙ্গনা কাব্যের মধ্যে দিয়ে কবি আহ্বান জানিয়েছেন সমাজের সমস্ত নারীদের আপন ভাগ্য জয় করার অধিকার প্রতিষ্ঠায়।

রোমক কবি ওভিদের The Heroides or Epistles of the Heroines নামক পত্রকাব্য গ্রন্থের প্রেরণায় মধুকবি তাঁর বীরাঙ্গনা কাব্য রচনা করার তাগিদ বা উৎসাহ অনুভব করেছিলেন—এ কথা তাঁর চিঠিপত্র থেকে জানতে পারা যায়। কবি ওভিদের মতোই একুশটি পত্র সহযোগে তিনি বীরাঙ্গনা কাব্য রচনা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কার্যত এগারোটি পত্র রচনা করেই, সময়াভাবের কারণে, তিনি বীরাঙ্গনা কাব্য প্রকাশ করেন। ওভিদের কাব্যের মতো বীরাঙ্গনাও পত্রকাব্য এবং ওভিদের The Heroides-এর মতো বীরাঙ্গনার চরিত্রগুলিও পুরাণ ও মহাকাব্য থেকে চয়িত। ইংরেজিতে যাকে বলে Dramatic Monologue মধুসূদনের বীরাঙ্গনার প্রতিটি সর্গ বা অধ্যায় সেই রকম একোক্তিমূলক নাটকীয় বাতাবরণে রচিত। কিন্তু প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের ‘ভান’ বা ‘বীথী’র সঙ্গে মাইকেলের বীরাঙ্গনার আঙ্গিক ভিন্ন ধরণের। বীরাঙ্গনা কাব্যের নায়িকাদের এই Dramatic Monologue তাদের হৃদয়ের আবেগ অনুরাগ অভিমানাদি সহযোগে নতুন মাত্রা লাভ করেছে। যার ফলে একটা নাটকীয়তা বা নাটকীয় প্রত্যক্ষতা সৃষ্ট হয়ে সাধারণ গীতিকবিতার স্তর থেকে উন্নীত করিয়ে এক বিশিষ্টতা দান করেছে।

বীরাঙ্গনা কাব্যে প্রতিটি নায়িকার পত্রে সক্রিয় ঘটনা সংঘটন এবং দ্বন্দ্বর সমবায়ে যে নাটকীয়তা সৃষ্টি হয়েছে। তা এক কথায় অনবদ্য। বীরাঙ্গনাদের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, অবস্থা এবং ব্যক্তিত্ব প্রকাশ জনিত নিরন্তর দ্বন্দ্ব কাব্যের মধ্যে নাটকীয় অভিব্যক্তি দান করেছে।

গাথাকবিতার মতো বর্ণনাত্মক বা স্তবমূলক রচনা নয় বীরাঙ্গনা কাব্য। এখানে বিভিন্ন চিত্তবৃত্তিধারী নায়িকাদের নানা ভাবনা চিন্তা বিভিন্ন রসের সংবাহে গীতি কবিতার মাধুর্য এনে দিয়েছে। নায়িকাদের নানা পরিবেশের অন্তর্নিহিত ভাবাবেগের দ্বন্দ্বের সূত্রে এখানে গীতিকবিতার সুধারস নির্ঝর মধুময় হয়ে উঠেছে। কাব্যের গাম্ভীর্য ধ্বনি ও ভাবের পাশাপাশি ললিত লিরিকধর্মী রচনা মধুসূদনের শিল্পবৈশিষ্ট্যের তথা কাব্য সৌন্দর্য চেতনার পরিচয় দান করেছে।

কাব্যে সৌন্দর্যের প্রস্ফুটন ঘটে দুটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। একটি হল বৈচিত্র্য অপরটি হল বৈপরীত্যে। বৈচিত্র্যের সন্ধানী মধুসূদন তাঁর কাব্যের পালা বদল করেছেন প্রতিবার। এক ধারার রচনা যে শিল্পীর নবনবোন্মেষ শালিনী উদ্ভাবনী প্রতিভার মৃত্যুতুলা। মধুসূদনের সাহিত্যে তাই মেঘনাদবধের মতো মহাকাব্য রচনার পর অপর একটি মহাকাব্য রচনা করে কৃত্রিম ক্লাসিক কার্য নির্মাণ করেছিলেন। আত্মবিলাপ, মেঘনাদবধ কাব্যের চতুর্থ সর্গে এবং ব্রজাঙ্গনা কাব্যে মধুসূদন গীতিকাব্য রচনা শক্তির নিদর্শন উপস্থিত করেছেন। বীরাঙ্গনা কাব্যে তিনি আনলেন ভিন্নরীতি।

বৈচিত্র্য ছাড়াও তাঁর বীরাঙ্গনা কাব্যে রয়েছে নানাবিধ সৌন্দর্যের উপাদান। তার মধ্যে বৈপরীত্য থেকে সৃষ্ট সৌন্দর্য বীরাঙ্গনা কাব্যে দৃষ্ট হয়। সেখানে একই ধরণের পত্রিকা একাধিক নায়িকা রচনা করলে যেমন তার মধ্যে নায়িকাদের ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্যবোধের কারণে বিভিন্নতা থাকে তেমনি পত্রিকার শ্রেণী বিচারেও ধরা পড়ে আপাত বিপরীত আবেদন। যেমন বীরাঙ্গনা কাব্যের একাদশ সর্গের জন্য পত্রিকায় দেখা যায় একই সঙ্গে জনার স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি প্রেম এবং স্বামীর অন্যায় আচরণের জন্যে তাঁর প্রতি বিদ্বেষবোধ। আবার দ্রৌপদী পত্রিকায় রয়েছে স্বামীর অদর্শনজনিত উৎকণ্ঠা ও বিরহবোধের সঙ্গে তেজস্বিনী নায়িকার ভাব। একাধারে করুণ ও রুদ্র রসের সমবায়।

ভাষার ব্যবহারও বীরাঙ্গনা কাব্যে অপূর্ব মাত্রা যোগ করেছে। দেবগুরু বৃহস্পতি পত্নী তারা স্বামী-শিষ্য চন্দ্রের প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে যে পত্র লিখেছেন, তার ছত্রে ছত্রে শিল্পমাধুর্য ফুটে উঠেছে। যেমন—

কুলের পিঞ্জর ভাঙ্গি, কুল-বিহঙ্গিনী

উড়িল পবন-পথে, ধর আসি তারে

তারানাথ।—তারানাথ? কে তোমারে দিল 

এ নাম, হে শুন-নিধি, কহ তো তারারে,

এ পোড়া মনের কথা জানিল কি হলে

নামদাতা?

এখানে ‘তারানাথ’ সম্বোধনটি লক্ষ্যণীয়। চন্দ্র হলেন নক্ষত্রপতি অর্থাৎ তারাদের নাথ। কিন্তু এখানে এমনভাবে তারা মনোভাব ব্যক্ত করলেন যেন চন্দ্র, বৃহস্পতি-পত্নী তারার নাথ। এই প্রত্যয়ই তারাকে কুলত্যাগ করে চন্দ্রের প্রেমে মথিত হতে প্রভাবিত করেছে।

দ্রৌপদী পত্রিকায় দেখি পঞ্চস্বামীর মধ্যে কেবলমাত্র অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদীর সবিশেষ পক্ষপাত অপূর্ব সৌন্দর্যময় ভাষায় ব্যক্ত হয়ে কাব্যেসৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে—

পাঞ্চালীর চিরবাঞ্ছা, পাঞ্চালীর পতি

ধনঞ্জয়; এই জানি এই মানি মনে।

যা ইচ্ছা করুন ধর্ম, পাপ করি যদি

ভালবাসি নৃমণিরে— যা ইচ্ছা, নৃমণি।

কিম্বা দশরথের প্রতি কেকয়ী যখন নাটকীয় এককোক্তি করেন দশরথকে কটাক্ষ করে—

পাইলা কি পুনঃ এ বয়সে 

রসময়ী নারী ধনে, কহ রাজ-ঋষি?

এখন তার ভাবাবেগের দ্বন্দ্ব কাব্যকে অপূর্ব শ্রীমন্ডিত করে তোলে।

বীরাঙ্গনা কাব্যের ছন্দও এর বক্তব্য প্রকাশের ভাষা সংবাহের এবং ভাব অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে অনুকূল। মাইকেল মধুসূদন সৃষ্ট এই অমিত্রাক্ষর ছন্দ বাংলা কাব্য তাঁর এক অনুজ্জ্বল এবং অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। কড়ি কোমল ভাবের প্রকাশ এবং রসের যথাযথ প্রয়োগে এই ছন্দ সহায়ক হয়েছে।

বীরাঙ্গনা কাব্যের প্রতিটি নায়িকাই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বময়ী। যার ফলে প্রতিটি পত্রিকা হয়ে উঠেছে একএকটি মৌলিক সৃষ্টি। পত্রিকাগুলিতে চিত্রকল্প, রসাবেদন, উপমাদি অলঙ্কারের প্রয়োগ নৈপুণ্য এর ভাবকে সুষ্ঠু রূপে মূর্ত করেছে। এখানেও মধুকবির কবিত্বশক্তি ও শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। বীরাঙ্গনার শব্দ ব্যবহার অযথা পুনরুক্তি দোষ বিবর্জিত। শব্দের পৌনঃপুণ্য নেই এখানে। অলংকারের বহিরঙ্গ প্রয়োগ কাব্যে রসাভাস সৃষ্টি করেনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কবির স্বেচ্ছাকৃত পুনরুক্তি ব্যবহার কাব্যের ব্যঞ্জনা ও বক্তব্য বলিষ্ঠতার সহায়ক হয়েছে। ভাষা ও ছন্দের লালিত্যে ও প্রয়োগকৌশলে বীরাঙ্গনা কাব্যের পত্রসমূহ সার্থক ও অনবদ্য সৃষ্টিরূপে পরিগণিত হয়েছে। এর গাম্ভীর্য ভাব যেমন কাব্যকে উদাত্ত ধ্বনিমন্ডিত করেছে, কোমলকান্ত ভাবের গীতিকাব্যধর্মিতা তেমনি এর মধ্যে সঙ্গীতের সুর উৎসারিত করেছে। ফলে শাস্ত্রেও নয়টি রস ও ভাব নিপুণভাবে ফুটে উঠেছে।

যে এগারো জন নায়িকাকে কেন্দ্র করে বীরাঙ্গনা কাব্য রচিত হয়েছে তারা প্রত্যেকেই পৌরাণিক নারী। কিন্তু কবি মধুসূদনের হাতে পড়ে তারা প্রত্যেকেই হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বময়ী রক্তমাংসের আধুনিক নারী চরিত্র। দেবদেবীর কৃপার আশায় এরা হাত গুটিয়ে বসে নেই। নব প্রগতির চিন্তাধারায় এরা প্রত্যেকেই পুরুষের পাশে উপযুক্ত মর্যাদায় স্থান করে নিতে পেরেছে। চরিত্রগুলির এই নবরূপায়ণ এবং পৌরাণিক উপাদান থাকা সত্ত্বেও কঠোরে কোমলে মিশিয়ে ভাষা-ছন্দ অলংকার রসাদির সার্থক প্রয়োগে তাকে যুগোত্তীর্ণ, ‘ক্লাসিকোমডার্ন’ মহাকাব্যের রূপদান যুগন্ধর কবি মাইকেল মধুসূদনের নিপুণ শিল্প সৃষ্টি বা শিল্প কুশলতার পরিচায়ক। সমস্ত দিক থেকে বিচার করলে বীরাঙ্গনা কাব্য যে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবিস্মরণীয় কীর্তি এ বিষয়ে অপ্রতিবাক্যে মতদান করা যায়।