বীরাঙ্গনা কাব্যের নায়িকারা কেউ অভিমানী, কেউ অনুযোগকারিনী কিন্তু সকলেই বীরাঙ্গনা। কী অর্থে এই অভিধা ভিন্নজাতীয় নায়িকার ক্ষেত্রে সুপ্রযুক্ত হয়েছে, তার মুক্তিগ্রাহ্য পর্যালোচনা করো।
মানবতাবাদী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও অনবদ্য বীরাঙ্গনা কাব্যে পৌরাণিক নারী চরিত্রগুলিকে স্বমহিমায় উপস্থাপন করিয়ে বাংলা কাব্য ও সাহিত্যে মানবতাবাদ ও নারীপ্রগতির সূচনা করেছেন। মূলত নারী মনের গভীরে দৃষ্টিপাত করে তাদের কামনা-বাসনা-চাহিদা-ভাবনা ইত্যাদির পরিচয় এবং তার অমোঘ পরিণতিকে কাব্যে রূপ দিয়েছেন এবং কাব্য রচনা কালে সমাজ শাসনের চেয়ে শিল্প সৃষ্টির প্রতি পক্ষপাত প্ৰদৰ্শন করেছেন অধিক মাত্রায়। ফলে বীরাঙ্গনা কাব্যের প্রতিটি চরিত্রই হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র্য ব্যক্তিত্বময়ী এবং শিল্প সৌকর্যের অপূর্ব নিদর্শন।
বীরাঙ্গনা কাব্যের অন্তত পাঁচখানি পত্রিকা নিয়েও যদি আলোচনা করা যায় তা হলেও দেখা যায় সেই পাঁচ জন নায়িকারই স্বভাব চরিত্র স্বতন্ত্র ধরনের। কেউ কোমল, নম্র, কেউ আপন প্রেমাধিকার লাভে উন্নত মস্তক বা দুর্দমনীয় আবেগ প্রবণ, কেউ অভিমানী, কেউ দক্ষ দাম্পত্য লীলা বিলাসী, কেউ আবার তেজস্বিনী। প্রত্যেকের মধ্যেই কোন না কোন স্বাতন্য বর্তমান। কেউ যুদ্ধে যাত্রা করতে পরান্মুখ নয়, কেউ আবার রক্তপাত নিতান্তই পরিহার করে সর্বত্রই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিপাত করেন। এই সমস্ত নায়িকাদের পত্রিকা নিয়ে সৃষ্ট-কাব্যের নাম কবি দিয়েছেন ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’। অর্থাৎ কবির ভাবনায় প্রতিটি নায়িকাই বীর। শকুন্তলা, তারা, দ্রৌপদী, কেকয়ী, জনা এই পাঁচ নায়িকা বা অঙ্গনাকেও কবি ‘বীর’ আখ্যা দিতে চেয়েছেন। যদিও একমাত্র জনা ভিন্ন আর কারো পত্রিকার মধ্যেই এ বাণী ধ্বনিত হয় নি–
“কুলনারী আমি, নাথ, বিধির বিধানে
পরাধীনা! নাহি শক্তি মিটাই স্ববলে
এ পোড়া মনের বাঞ্ছা।”
তবু এই সাহস, এই তেজ না থাকা সত্ত্বেও কোমল চিত্তবৃত্তিধারী অন্যান্য নায়িকাদের বীরাঙ্গনা বলাও যে যুক্তি সঙ্গত সে কথা এই নায়িকাদের পত্রিকার আলোচনা থেকেই বুঝতে পারা যাবে।
প্রথম সর্গের শকুন্তলা পত্রিকা থেকে শকুন্তলার যে চরিত্রের চিত্র পাওয়া যায়, সেখানে শকুন্তলা শাস্ত নম্র ধীর ইত্যাদি সুকোমল চিত্তবৃত্তিধারিনী আশ্রমকন্যা। হিংসা-দ্বেষ-অসূয়ালেশহীন তার মনোভাব। যুদ্ধ বিবাদের ভাবনা সম্ভাবনাও তার পক্ষে অসম্ভব। সে বিরহকাতর। রাজা দুষ্মন্তের সঙ্গে গান্ধবমতে বিবাহ হওয়ার পর থেকেই সে সর্বক্ষণ দুষ্মন্তময়। স্বামী বিরহে তার সবই অন্ধকারময়। আহারে-বসনে শয়নে রুচি নেই। সে ঐশ্বর্য চায় না, রাজভোগ চায় না, কেবল চায় দাসী ভাবে স্বামীকে সেবা করতে। শকুন্তলা আর কারো দোষ দেখতে পায় না। তার স্বামী পরিত্যক্তা পরিস্থিতির জন্যে সে নিজের ভাগ্যকেই দায়ী করে। এই কুসুম কোমল স্বভাবযুক্তা শকুন্তলাকে কবি বীরাঙ্গনা বলেছেন শকুন্তলার ব্যক্তিত্ব ও বীর্যের প্রতি ইঙ্গিত করে। লক্ষ্য করে দেখা যায় অসহ বিরহ বেদনার মধ্যেও শকুন্তলা তার ব্যক্তিত্বকে ছোট করে নি। হীনমন্যতার মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দেয় নি। তাই সে প্রতীক্ষমানা এবং রাজা দুষ্মন্ত দূত পাঠিয়ে তাকে রাজালয়ে নিয়ে যাবে সেই আশায় সে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। এখানে বিরহ কাতরতপ্ত শকুন্তলা যদি কুৎসিত ভাবে রাজাকে নিন্দা করত বা অনসূয়া প্রিয়ম্বদা রাজার উদ্দেশ্যে উক্ত নিন্দাবাক্য সমর্থন করত তা হলে আত্মকেন্দ্রিকতার কালো জলে শকুন্তলার বীরাঙ্গনা চরিত্রটি ডুবে যেত। অত্যন্ত দুঃসময়েও বিপথে চালিত না হয়ে নিজেকে সুস্থ সংযত এবং শুদ্ধ রাখার অনাবিল প্রয়াসই তাকে ব্যক্তিত্বময়ী বীর্যবর্তী করে বীরাঙ্গনা করে তুলেছে।
দ্বিতীয় সর্গের তারা একজন প্রেম বুভুক্ষু নারী। তাঁর স্বামী দেবগুরু বৃহস্পতি প্রাজ্ঞ ও প্রৌঢ় পন্ডিত এবং সুরনরগণ কর্তৃক পূজিত ব্যক্তি। দেবতুল্য স্বামী বৃহস্পতি হলেও তারার নারী চিত্তে ও দেহে যে প্রেম কামনা তা থেকে তারা বঞ্চিত। শাস্ত্রবিদ স্বামীর ঔদাসিন্যেই জন্মেছে তার প্রেম বুভুক্ষা। এই রকম সময়েই সোম অর্থাৎ চন্দ্র এসেছিলেন দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে বিদ্যাশিক্ষা করতে। তারার যুবতী দেহে ও মনে দিব্যকান্তি অঙ্গ সৌষ্ঠব দেখে এক পলকের আঘাতেই চন্দ্রের প্রতি প্রণয় বাসনা মুখর হয়ে উঠেছিল। সে প্রেম ছিল গোপন। প্রথমে কাউকেই তারা জানতে দেয় নি। কিন্তু চন্দ্রের শুরুর আশ্রম থেকে বিদ্যাশিক্ষাস্তে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের সময়েই তারা তার প্রেম চন্দ্রের কাছে পত্র দিয়ে প্রথম ব্যক্ত করল। তারার মধ্যে প্রেম বুভুক্ষার সঙ্গে আজন্ম লালিত সামাজিক সংস্কার ও পাপ বোধও কাজ করেছে। প্রথমেই সে তার হস্তধৃত লেখনীকে ভর্ৎসনা করেছে–
“কেমনে তুইরে পোড়া লেখনি,
লিখিলি ও পাপ কথা,- হায় রে কেমনে?”
অর্থাৎ তার মধ্যে প্রেম ও কামনা বাসনার দুর্বার আবেগ আছে সত্য কিন্তু তা বলে সে তার সমাজিক অবস্থানকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে যায় নি। আর ভোলে নি বলেই নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলেছে—
“জনম মম মহা ঋষিকুলে
তবু চন্ডালিনী আমি”
একদিকে যেমন সে সামাজিক অনুশাসনকে ভুলতে পারে নি, অন্যদিকে তেমনি প্রেমের বীর্যে অশঙ্কিনী হয়েই ধর্ম-কুল-মান সমস্ত কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত। তার এই প্রস্তুতি যে দীর্ঘ দিনের তা বোঝা যায় চন্দ্রের ভোজন-শয়ন কর্মসম্পাদন-পুষ্পচয়নাদিতে অলক্ষ্যে তাকে সাহায্য করার ঘটনা থেকে। এমনকি গুরুপত্নীরূপে প্রণত চন্দ্রের প্রণাম গ্রহণ কালেও তারার মানসিকতা ছিল প্রণয়ীতুল্য। চন্দ্রের প্রণাম কালে তারা মনে মনে ভাবতো—
“মানিনী যুবতী আমি, তুমি প্রাণ-পতি মান-ভঙ্গ-আশে নত দাসীর চরণে”
তারার অন্তরের গোপন প্রেমকে যে দুঃসাহসে চিত্তকে বঞ্চিত না করে প্রকাশ্যে অভিব্যক্ত করেছে, সেই তেজে, সেই সাহসে তারা বীরাঙ্গনায় উন্নীত হয়েছে।
দ্রৌপদী বীর্যবতী। তার উৎপত্তি হয়েছিল কুরুবংশ ধ্বংসের কারণে। দ্রৌপদী পত্রিকায় অবশ্য তার কোন উল্লেখ মাত্র দেখা যায় না। বীরাঙ্গনা কাব্যের দ্রৌপদী হলেন দক্ষ দাম্পত্য লীলা বিহারী প্রোষিতভর্তৃকা নায়িকা। তিনি অর্জুনের প্রতি সবিশেষ অনুরক্তা। পঞ্চপতির মধ্যে অর্জুনের প্রতিই তাঁর সবিশেষ পক্ষপাত। তিনি জানেন এ অন্যায়, এ পাপ। তবু তিনি তার মনকে অস্বীকার করেন নি। তিনি স্বীকার করেছেন—
“পাঞ্চালীর চির-বাঞ্ছা, পাঞ্চালীর পতি
ধনঞ্জয়; এই জানি এই মানি মনে।
যা ইচ্ছা করুন ধর্ম, পাপ করি যদি
ভালবাসি নৃমণিরে,—যা ইচ্ছা, নৃমণি!”
মুক্ত কণ্ঠে দ্রৌপদীর এই যে একেশ্বর অনুরাগ তাই তাকে ব্যক্তিত্বময়ী করে তুলেছে। আর সেই সঙ্গে তাঁর দাম্পত্য সম্পর্কে অসীম আস্থা জ্ঞাপক যে সমস্ত তীব্র কটাক্ষ বিদ্রূপ বাণ অর্জুনের প্রতি পত্রে নিক্ষিপ্ত হয়েছে এবং পত্রের উত্তরে ‘পত্রবহ সহ ফিরি আইস এ বনে’ বা পত্রদূতকে যথাবিধি আপ্যায়ন করার পরামর্শ দান দ্রৌপদীকে মহিমাময়ী করে তুলে, দাম্পত্য প্রেমের বীর্যে বীরাঙ্গনা করে তুলেছে।
কেকয়ী এবং জনা দুজনেই প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব। এদের দুজনের পত্রেই অনুযোগকারিণীর সুর ফুটে উঠেছে। পত্রে সুরের সাদৃশ্য থাকলেও দৃষ্টিকোণ বিচার, প্রকাশ ভঙ্গি, অনুভবের মাত্রা এবং পরিবেশ পরিস্থিতির পার্থক্য আছে। উভয়ের মধ্যে ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা যায়।
কবি মধুসূদন পৌরাণিক এই দুটি চরিত্রকেও নবরূপে যুগোপযোগী করে নির্মাণ করেছেন। এরা উভয়েই স্বামীর আচরণে মর্মপীড়িতা। কেকয়ীর দুঃখ ও অভিমান নিতান্ত আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বার্থসর্বস্ব। রামায়ণের কেকয়ী (বা কৈকেয়ী), রাজা দশরথ রামচন্দ্রকে যৌবরাজ্যে অভিষেক করলে কেকয়ী রামচন্দ্র ও তাঁর জননী কৌশল্যার প্রতি ঈর্ষা ও বিদ্বেষ ভাব ব্যক্ত করেছেন। তাঁর পুত্র ভরতকে, কথা দেওয়া সত্ত্বেও, যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত না করায় কেকয়ী দুঃখিত ও ব্যথিত।
অন্যদিকে জনা, তার বীরপুত্র প্রবীরের মৃত্যুতে শোকাহত। তার বীর পুত্রের মৃত্যু হয়েছিল অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে। যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া মাহেশ্বরী রাজ্যে প্রবেশ করলে মাহেশ্বরী রাজপুত্র প্রবীর তাকে ধরে ফেলে এবং নিয়মানুযায়ী অশ্বের রক্ষক অর্জুনের সঙ্গে তার যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে প্রবীর বীরগতি প্রাপ্ত হলে, তার পিতা নীলধ্বজ, পুত্রের হত্যাকারীর প্রতি প্রতিশোধ না নিয়ে তাকে নরনারায়ণ জ্ঞানে পূজা করতে শুরু করেন। পরম মিত্র বলে সিংহাসনের পাশে স্থান দেন। নীলধ্বজের এই আচরণে জনা বিস্মিত ও ব্যথিত হন। তার ক্ষত্রনারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ায় তিনি স্বামীর প্রতি অভিমান করেছেন। তাঁকে অনুযোগ সহ ভৎসনা করেছেন। জনার অনুযোগের মূল কারণ তাঁর পুত্রহা রিপুর সঙ্গে স্বামীর বন্ধুত্ব পাতানো এবং ভক্তবৎ আচরণ। স্বামীর এই জাতীয় আচরণ জনার পক্ষে আক্ষেপের কারণ হয়েছে এবং স্বামীকে পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিতে না পারার জন্যে ও জনাকে সক্রিয় নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা দান না করতে পারার জন্যে নীলধ্বজের প্রতি অভিমানী জনা অনুযোগ করেছেন—
“তুমি পতি, ভাগ্যদোষে বাম মম প্রতি
তুমি! কোন্ সাধে প্রাণ ধরি ধরাধামে?”
তার পুত্র কোল ছাড়া, তার স্বামী পুত্র হত্যাকারীর বশ তাই জন্যে জনার কাছে সবই শূন্যময় মনে হয়—
“হায় রে এ জনাকীর্ণ ভবস্থল আজি
বিজন জনার পক্ষে।”
জন্য তার স্বামীর কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিতে দৃঢ়তার সঙ্গে অর্জুন, কুস্তী, যুধিষ্ঠির, দ্রৌপদী সকলের সমালোচন করেছেন। এমনকি স্বামী অপারগ হলে তিনি নিজেই তাঁর পুত্রের হত্যার প্রতিশোধ নিতে চান। এই সমস্ত বাক্য সহযোগে দিকভ্রান্ত স্বামীকে যথাযোগ্য পথ প্রদর্শন করাতে চাইলেও, নীলধ্বজ যখন অর্জুনের নিমন্ত্রণ স্বীকার করেছেন—এ সংবাদ পেলেন তখন জনা নিজের মৃত্যুই শ্রেয় বিবেচনা করে রাজাকে পত্রে লিখলেন, ‘ছাড়িব এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে।’ এ আত্মহনন তার নিজেকে নিঃশেষ করতে নয়, স্বামীকে বাস্তব সচেতন করে তুলতে। তার এই দৃঢ়তা, তেজস্বিতা তাকে যথার্থ বীরাঙ্গনা রূপে চিহ্নিত করেছে।
তাই সব দিক থেকে বিচার করে দেখলে, সহজেই বোঝা যায় মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যের নায়িকারা বিভিন্ন চিত্তবৃত্তিধারী হওয়া সত্ত্বেও, প্রত্যেকের স্বাতন্ত্র্য ব্যক্তিত্বে প্রত্যেকে মহীয়সী ও বীর্যবর্তী। ফলে এই কাব্যের নায়িকাদের প্রত্যেককে বীরাঙ্গনা আখ্যা দেওয়া যথার্থ ও যুক্তিসঙ্গত হয়েছে।
Leave a comment