বাংলা সাহিত্যের সম্ভবত একমেবাদ্বিতীয়ম্ পত্রকাব্য মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্য। কবি মধুসূদনের অনবদ্য ও সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি রূপে বিবেচিত এই কাব্যটি গড়ে উঠেছে পৌরাণিক নায়িকাদের কর্তৃক তাঁদের নায়কদের উদ্দেশ্যে রচিত একাদশটি পত্রিকার সমবায়ে। কাব্য রচনার উপাদান হিসেবে কেবলমাত্র নায়িকার নাম এবং চরিত্র ও ঘটনার সার তিনি গ্রহণ করেছিলেন রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ও সংস্কৃত কাব্য থেকে। কিন্তু শিল্প সৃষ্টির কারণে অনেকাংশে নামটুকু রেখে নায়িকাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং ঘটনার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে নিয়েছেন কবি। তবু সমস্ত কিছুর মধ্যে থেকে নায়িকাদের যে বৈশিষ্ট্য তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন তাতে প্রতিটি নায়িকাই ব্যক্তিত্বে, মাধুর্যে, স্বাতন্ত্র্যে মহীয়সী হয়ে উঠেছে। বস্তুতঃ বীরাঙ্গনা নামকরণের সঙ্গে সাজুয্য রেখেই এর অঙ্গনাগণ বীর্যবর্তী ব্যক্তিত্বময়ী।
রোমক কবি ওভিদের বীরগাথা বা Heroic Epistle-এর আদর্শে প্রাণিত হয়ে মধুসূদন বীরাঙ্গনা কাব্য রচনা করেছিলেন এবং বন্ধুদের কাছে এই স্বীকারোক্তি করে পত্র দিয়েছিলেন যে ওভিদের মতো তিনিও একুশটা পত্র সহযোগে বীরাঙ্গনা কাব্য প্রকাশ করতে চান। কিন্তু সময়াভাবে এগারোটি পত্র সংকলন করেই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করতে হয়েছিল। তবু তিনি চেষ্টা করেছিলেন একে সম্পূর্ণ করার কিন্তু মাত্র পাঁচখানি পত্রিকা রচনা শুরু করে অসমাপ্ত অবস্থায় ফেলে রেখে মন্তব্য করেছিলেন—”My poetical career is drawing to close.”
বীরাঙ্গনা কাব্যে কঠোর কোমল ভাব সংমিশ্রণে এগারোটি পত্রিকায় পৌরাণিক নারী চরিত্রের নারীত্বের বিচিত্র ও সম্ভাব্য দিকগুলি উন্মোচিত ও চিত্রিত করে তাঁদের চরিত্র বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্বের পরিচয় প্রদান করেছেন মধুসূদন। সেই সঙ্গে তাঁর যুগদ্ধর কবি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় পত্রকাব্য বীরাঙ্গনা কাব্যের পাতায় পাতায়। নারী স্বভাবের স্নেহময় কোমল রূপের পাশাপাশি বাৎসল্য, তেজস্বী, ক্রুর, ঈর্ষ প্রভৃতি নানারূপের এবং তাদের স্বপ্ন, ইচ্ছা, সাধ্য, কামনা ও কর্মের প্রকাশ এবং জীবনের নানা আকাঙ্ক্ষার ব্যর্থতা ও সার্থকতার চিত্র চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পত্রিকাগুলির মধ্যে। সে দিক থেকে প্রতিটি পত্রই অনবদ্য। নারীর ব্যক্তিসত্তাকে মানবিকতার দৃষ্টিতে দেখে মধুসূদন তাদের প্রেম বাৎসল্য ও অন্যান্য ঘটনার মধ্যে নিহিত ব্যর্থতার অন্তর্নিহিত বেদনা বা ট্র্যাজেডির সুর ধ্বনিত হয়েছে নারী চরিত্রের রূপ চিত্রণের পাশাপাশি। তবে সমস্ত পত্রিকাতে ট্র্যাজেডি উপলব্ধি হয় না। কোনো কোনো পত্রিকায় ট্র্যাজেডির উপাদান থাকলেও সার্থক ট্র্যাজেডি যেমন আসেনি তেমনি কোথাও আবার ট্র্যাজেডি সার্থকরূপে প্রতিফলিত হয়েছে।
বস্তুতঃ ব্যর্থতার অন্তর্বেদনায় দুর্ভোগের সঙ্গে কর্মসম্পাদনই ট্র্যাজেডি। পণ্ডিত এ্যারিস্টটল বলেছেন, Tragedy is an imitation of an action that is serious… সে দিক থেকে বিচার করতে গেলে মানবজীবনের চিত্তবৃত্তির মধ্যে সবচেয়ে প্রধান বৃত্তি হল প্রেম এবং ঘটনা সংঘটন বা Action-ও প্রেম। সেই প্রেমের বা action-এর ব্যর্থতা যেখানে দুর্ভোগের সঙ্গে অবস্থান করে, কঠিন পরিস্থিতিতে কর্ম সম্পাদন করায় তখনই তা Tragedy-তে পর্যবসিত হয়। বীরাঙ্গনা কাব্যে কিভাবে এই ট্র্যাজেডি নেমে এসেছে এবং কোথায় ট্র্যাজেডির লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও তা ট্র্যাজেডি হতে পারে নি এখন আলোচনা করে দেখা যাক।
বীরাঙ্গনা কাব্যের তারা চরিত্রের মধ্যেই ট্র্যাজেডি সার্থকরূপে প্রতিফলিত হয়েছে—এ কথা আমরা জানি। কিন্তু কি কারণে ট্র্যাজেডি সেখানে সার্থকরূপে ফুটে উঠেছে এবং অন্যান্য পত্রগুলির মধ্যে বিরহ বেদনা, একাকীত্বের রোদন, পুত্রহীনার বুকফাটা আর্তনাদ ধ্বনিত হলেও কেন সেখানে ট্র্যাজেডি সার্থকরূপে প্রতিফলিত হতে পারে নি। তার কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে।
মনে রাখা প্রয়োজন যে, দুঃখ আর ট্র্যাজেডি এক জিনিস নয়। দুঃখ যে সব সময়েই ট্র্যাজেডি হবে তা নয়। সাময়িক দুঃখ পরে আনন্দে পরিণত হতে পারে কিম্বা দুঃখের মধ্যে মুক্তির আশা থাকতে পারে। যে সব ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের কোন সোনালী রেখা অনুভূত বা উপলব্ধি হতে পারে সে সব ক্ষেত্রে ট্র্যাজেডি হয় না। যেমন, বীরাঙ্গনা কাব্যের প্রথম সর্গে শকুন্তলার দুঃখ—যতই করুণ রসের সৃষ্টি করুক না কেন সেখানে ট্র্যাজেডি হয় নি। কেন না রাজা দুষ্মন্ত তাকে বিবাহ করে রাজ্যে ফিরে গেছেন, প্রচ্ছন্নে রয়ে গেছে শকুন্তলার পতিগৃহ গমনের আশ্বাস। আরো কি, শকুন্তলার চিঠির মধ্যে তার বিরহ সম্ভাপ যতটা প্রকট হয়েছে তার কোথাও শকুন্তলার দুর্ভোগের সঙ্গে কোনো রকম সক্রিয়তা না থাকায় ঠিক ট্র্যাজেডি সেখানে প্রতিফলিত হয় নি।
চতুর্থ সর্গে দশরথের প্রতি কেকয়ীর পত্র থেকে জানতে পারা যায় ভরতকে রাজা না করে দশরথ রামকে যৌবরাজ্যে অভিষেক করায় তিনি ক্ষুব্ধ। সে মুগ্ধতায় যে চিঠি তিনি রাজাকে লিখেছেন তাকে প্রতিজ্ঞা রক্ষা না করার জন্যে অনুযোগ যেমন আছে তেমনি অধর্মাচরণের জন্যে ভর্ৎসনাও আছে, আছে অভিমানী কণ্ঠস্বরও। বিশেষত বিগত-যৌবনা কেকয়ী রাজার কাছে যথাযথ আদর না পাওয়ার অনুযোগে তার বিলীয়মান যৌবন সম্পদের জন্যে আফশোষ করেছে—
“না পড়ি ঢলিয়া আর নিতম্বের ভরে!
নহে গুরু উরুদ্বয়, বর্ভুল কদলী
সদৃশ ……
“লাইল
লুটিয়া কুটিল কাল, যৌবন-ভাণ্ডারে
আছিল রতন যত,”
কেকয়ীর এই বিলয়মান যৌবনশ্রীর জন্যে হাহাকারের সঙ্গে তাঁর তির্যক বচন-কুশলতা ক্ষেত্রবিশেষে নাট্যরসের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নায়িকা কেয়ীর আত্মদর্পের অতিরেক পরিণাম তাঁকে পাঠকের সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত করেছে যা কিনা ট্র্যাজিক চেতনার পথে স্বীকৃত অন্যতম শর্ত।
একাদশ সর্গের নীলধ্বজের প্রতি জনার পত্রিকাটি অনুযোগ শ্রেণীর পত্রিকার মধ্যে অন্যতম। এখানে বীর রসের সঙ্গে করুণ রসের মিশ্রণ ঘটেছে। কঠিনে কোমলে মেশা এই পত্রিকার মধ্যে ট্র্যাজেডির উপাদান থাকা সত্ত্বেও এটি ট্র্যাজেডি হয়ে উঠতে পারে নি। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করে জনার পুত্র প্রবীর মৃত্যুবরণ করেছে। সেই মৃত্যুশোক সদ্য পুত্র হারা মাতার কাছে করুণতম। ট্র্যাজেডির লক্ষণ বা ট্র্যাজিক-মহিমা এখানেই সৃষ্টি হতে পারত। যদি পুত্রের মৃত্যুর কারণে মানসিক ও নৈতিক বিরোধ স্বামীর সঙ্গে অনিবার্য ব্যবধান সৃষ্টি করে গৃহকর্মে স্থির থেকে অন্তর্দ্বন্দ্বে জনাকে মথিত করতো তা হলে পরিপূর্ণ ট্র্যাজিক মহিমা আস্বাদ করা যেত। কিন্তু এখানে প্রবীরের মৃত্যুর পরে রাজা নীলধ্বজ অর্জুনের সঙ্গে পুত্রশোকের প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে অর্জুনকে নরনারায়ণ জ্ঞানে পূজা করে নিজ রাজভবনে এনে তাঁকে সেবা যত্ন করার ঘটনায় জনা মর্মাহত হয়েছে এবং পুত্রশোকাতুর জনার এই মর্মযাতনা পাঠক চিত্তকে স্বভাবতই ট্র্যাজিক-মহিমায় আচ্ছন্ন করে। কিন্তু সে ট্র্যাজেডি এখানে শেষ পর্যন্ত প্রকৃত ট্র্যাজেডি হয়ে উঠতে পারলো না জনার আত্মহত্যার সংকল্পে। আত্মহত্যার সংকল্প না করে যদি সে তার অন্তর্বেদনা নিয়ে মনের বিরুদ্ধে সাংসারিক পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হতো তা হলে পরিপূর্ণ ট্র্যাজেডি হয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু যখনই জনা বলল—
“ছাড়িব এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে;
দেখিব বিস্মৃতি যদি কৃতান্তনগরে
লভি অন্তে।”
তখনই এই পত্রিকার সমস্ত ট্র্যাজেডির উপাদান ব্যর্থ হয়ে গেল।
বীরাঙ্গনা কাব্যের একমাত্র দ্বিতীয় সর্গের তারা চরিত্রের মধ্যেই ট্র্যাজেডি সার্থকরূপে প্রতিফলিত হয়েছে। পুরাণকারের তারার সঙ্গে মধুসূদনের তারার চরিত্রগত স্বভাবগত তফাৎ আছে। মধুসূদনের তারা শাস্ত্রবাক্যে বাঁধা আচার ভীরু নারীমাত্র নয়, মধুসূদনের মানবতাবাদের ছোঁয়ায় সে নারীমুক্তির পথিকৃৎ। তারা নিজের মনোভাব দৃঢ়প্রত্যয়ে নিজেই ব্যক্ত করতে পেরেছে। মধুসুদন তাঁর স্বকীয়তার দ্বারা এবং মৌলিক সৃজন প্রতিভার দ্বারা তারাকে যেমন স্বাধীনতা দিয়েছেন, তেমনি তার প্রেম চেতনারও মুক্তি দিয়েছেন। সে যুগে তারার এই প্রেম সমাজে নিন্দিত হয়েছিল কিন্তু তৎপরবর্তী বঙ্কিম-রবীন্দ্র শরৎচন্দ্রের হাত দিয়ে সে মুক্ত প্রেম ছড়িয়ে পড়েছে সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে।
তারার স্বামী ছিলেন স্থিতধী-শাস্ত্রজ্ঞ তপনিরত বৃহস্পতি। তারার দেহের উদ্ভিন্ন যৌবনের প্রতি তাঁর উদাসীনতা শাস্ত্রজ্ঞের সংযমের পরিচায়ক হলেও— তারার মতো এক নারীর পক্ষে তা পীড়াদায়ক। অন্যদিকে সোম অর্থাৎ চন্দ্ৰ যখন বৃহস্পতির শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন, তখন তারা সুদর্শন যুবা পুরুষ চন্দ্রের প্রতি আকৃষ্ট হলেন এবং তাকে নিজ দেহ মন চন্দ্ৰকে সমর্পণ করতে আগ্রহী হলেন। গুরুপত্নী হিসেবে তিনি স্বামীর শিষ্যের কাছে ভিক্ষা চাইলেন—
“ছায়ারূপে থাকি তব সাথে দিবা নিশি।”
কিন্তু দুঃসাহসী প্রেম যতই তিনি নিবেদন করতে চাইলেন চন্দ্রের কাছে ততই তার আজন্ম সিদ্ধ-সংস্কারে বাধতে লাগল। তার মনে হল সে পাপ করছে। এই পাপচিত্তার কারণে যে অনুশোচনা অনুতাপ তারার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছিল তার যাতনা থেকে মুক্তি পেতে সে জনার মতো আত্মহননের সংকল্পের কথা মনে স্থান দেয় নি। বরঞ্চ “জনম মম মহা ঋষি-কুলে তবু চণ্ডালিনী আমি” এই আত্মধিক্কারে নিজেকে ধিকৃত করেছে। নৈতিক স্খালন বিষয়ে এই চেতনার দ্বন্দ্বই তার অন্তর্বেদনাকে মথিত করে ট্র্যাজিক করে তুলেছে। সার্থক মানুষের এই ধরনের নিদারুণ ভাগ্যবিপর্যয় ট্র্যাজিডির মূল। তারার পত্রিকার মধ্যে কবি মধুসূদন তারার সেই দুর্ভাগ্যকে, দ্বন্দ্বকে সার্থক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তারার দুর্ভাগ্য সে স্বামী প্রেম বঞ্চিতা। সেই প্রেম বঞ্চনার দুঃখ পাঠক চিত্তে সহানুভূতির সঞ্চার করে, ট্র্যাজিক রস সৃষ্টি করে। এই সঙ্গে তারার প্রেম তার অন্তর্দ্বন্দ্ব ও পাপ বা অন্যায়ের জন্যে অনুশোচনা মথিত হয়ে অজুগুপ্সা ভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে এবং এই অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অনুশোচনার কারণেই তার প্রেম ট্র্যাজিক মহিমা লাভ করে পাঠকের ঈপ্সিত আস্বাদ্য রস নিষ্পত্তির সহায়ক হয়ে তারার চরিত্রে ট্র্যাজেডির প্রতিফলন সার্থক হয়েছে।
Leave a comment