ছোটোগল্পকার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পের পটভূমি বাংলাদেশের মাঠঘাট, দিগন্ত থেকে শুরু করে সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চল, চা বাগান, ডুয়ার্স তরাই-এর গভীর ও হিংস্র অঞ্চল পর্যন্ত বহুদূর বিস্তৃত। কখনও মানুষের মনের বিশেষ ভাব, কখনও কোনো চরিত্রের সবিশেষ পরিচিতি। কখনও কোনো বিশেষ বক্তব্য উপস্থাপন করার জন্যে তিনি রচনা করেছেন তাঁর গল্পের জগৎ। আলোচ্য ছোটোগল্পটিও সেই রকমই এক সৃষ্টি যেখানে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে আপাত সম্ভ্রান্ত বদান্য মুখোশের আড়ালে লুকানো মানবচরিত্রের দুঃসহ হিংস্রতা। সে হিংস্রতায় মানুষের কাছে পশুও পরাজিত।
আলোচ্য গল্পে দেখা যায় রামগঙ্গা এস্টেটের রাজাবাহাদুর এন. আর. চৌধুরীর শিকারের প্রসঙ্গ লেখক বর্ণনা করেছেন চিত্তাকর্ষকভাবে। শিকারের মধ্যে যে রোমাঞ্চকর বাতাবরণ দরকার তার কোনো অভাব লক্ষিত হয় না। রাত্রিবেলা অন্ধকারে বনের মধ্যে মশার কামড় খেয়ে শিকারের অপেক্ষায় রাত্রি যাপনের অভিজ্ঞতা লেখক বেশ মুন্সীয়ানার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সেখানে কোনো শিকার না মেলায় প্রথম প্রথম রাজাবাহাদুরের সঙ্গে পাঠকরাও হতাশ হয়েছেন। অবশেষে লেখকের মতো পাঠকের রক্তও হিম হয়ে গেছে রাজাবাহাদুরের মাছ শিকারের হিংস্রতা দেখে। একজন মানুষ যে কতটা ক্রুর, নৃশংস হতে পারে তারই যেন প্রমাণ পাওয়া যায়।
গল্পের শুরু করেছেন লেখক একজোড়া বাঘের চামড়ার জুতো পার্শেল আসা নিয়ে। পার্শেলটি কার পাঠানো সে কথা ভাবতে ভাবতে তাঁর মনে পড়ে গেছে আট মাস আগের একটি আরণ্যক ইতিহাস। সে ইতিহাস অত্যন্ত ক্রুরতায় পূর্ণ। শিকারের ঘটনার মধ্যে কৌতূহল, রোমাঞ্চ, ভয়ঙ্কর আবেশ থাকলেও এরকম ভয়ঙ্কর হিংস্রতা লক্ষ্য করা যায় না। আসলে মানুষ তার নৃশংসতাকে গড়ে তোলে তার বুদ্ধি ও শক্তির দাপটে। সে শক্তি শারীরিক বল নয়, সে শক্তি অর্থবল, জনবলের সমাবেশে সৃষ্ট। পশুর সঙ্গে মানুষের তফাত এই যে পশু গায়ের জোরে হিংস্রতা প্রকাশ করে। কিন্তু মানুষ করে তার বুদ্ধি ও শক্তি দিয়ে তাই মানুষ ক্ষেত্র বিশেষে হয়ে উঠতে পারে পশুর চেয়েও হিংস্র, নৃশংস। আলোচ্য গল্পের মধ্যে রাজাবাহাদুরের চরিত্রের সেই হিংস্র স্বভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, গল্পকার কোথাও রাজাবাহাদুরের চরিত্রে গুণদোষ অযথা আরোপে তাকে কৃত্রিম করে তোলেননি। বেশ স্বাভাবিক ও সাবলীলভাবেই তিনি রাজাবাহাদুরের চরিত্র চিত্রণ করেছেন। অপিচ, সে চরিত্র তিন চিত্রণ করেছেন পরোক্ষে। অর্থাৎ সোজা করে রাজাবাহাদুরের দোষগুণের বর্ণনা না করে তিনি কেবল গল্পই বলে গেছেন। সেই গল্পের ঘটনা প্রবাহে ধরা পড়েছে রাজাবাহাদুরের ব্যক্তিত্ব—যা ‘ফিয়ার্সেস্ট টেরাই’-এর চেয়েও ভয়ঙ্কর।
রাজাবাহাদুরের বদান্যতা তুলনারহিত। তিনি অতিথিকে যেমন যত্ন করেন, কবিকে যেমন সম্মান দেন তেমনি দেখা যায়, তাঁর বাংলোর কীপারের আশ্রিত কয়েকটি অনাথ শিশুকে (যাদের বেওয়ারিশ সম্পত্তি বলে গল্পকার পরিচয় দান করেছেন) তিনি রোজই লাউঞ্ঝের ওপর থেকে ছুঁড়ে দেন রুটির টুকরো, কখনও খুচরো পয়সা। তারা সেসব নিয়ে কাড়াকাড়ি করে। তা দেখে তিনি মজা পান। সেই মজা পাওয়াটা তাঁর বিলাসিতার মধ্যেই পড়ে।
তিন রাত অরণ্যের মধ্যে নাইট-সুটিং-এ গিয়ে শিকার্য কিছু না পেয়ে, নিজের বীরত্ব, নিশানা, কীর্তি লেখকের সামনে তুলে ধরার জন্যে হিংস্রতম উপায়ে শিকারের আয়োজন করতে কীপারের ওই সমস্ত আশ্রিত ছেলেদের মধ্যে থেকে একজনকে হাত পা মুখ বেঁধে তিনি বাঘ শিকারের টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। বলাবাহুল্য সেদিন তিনি অবার্থ লক্ষ্যে বিশালাকৃতি একটা রয়্যাল বেঙ্গল মেরেছিলেন।
আলোচ্য গল্পের মধ্যে সেই ভয়ঙ্কর, হাড়-হিম হিংস্রতাই প্রধান হয়ে উঠেছে। যাকে ব্যঙ্গ করতে লেখক বলেছেন, ‘কীপারের একটা বেওয়ারিশ ছেলে যদি জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে থাকে, তা অস্বাভাবিক নয়, তাতে কারও ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রকান্ড রয়্যাল বেঙ্গল মেরেছিলেন রাজাবাহাদুর লোককে ডেকে দেখানোর মতো। সেই হিংস্রতা আরও একবার পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে গল্প শেষ করেছেন আর একটি মন্তব্যে–এক শিশুর প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া বাঘের চামড়ার চটি জোড়া ‘পায়ে দিয়ে একবার হেঁটে দেখলাম, যেমন নরম, তেমনি আরাম।
Leave a comment