বিস্মৃতি বা বিস্মরণ এককথায় হল কোনাে জিনিস ভুলে যাওয়া, মনে করতে না পারা। পূর্বে শেখা জিনিসগুলিকে আমরা অনেক সময় নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে মনে করতে পারি না, একে বলে বিস্মৃতি। এটি হল স্মৃতির ক্ষয়প্রাপ্তি, এখানে যতটুকু মনে থাকেনা সেটি হল ক্ষয়প্রাপ্তির বা বিস্মৃতির পরিমাণ।


মনােবিদ প্রদত্ত বিস্মরণের সংজ্ঞা

  • মনােবিদ রিবো বলেছেন যে, স্মৃতির অপরিহার্য শর্ত হল বিস্মৃতি।
  • মান বলেছেন, পূর্বাৰ্জিত কোনাে বিষয়কে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে স্মরণ করার অক্ষমতাকেই বিস্মরণ বলে।
  • মনােবিদ ড্রেভার বলেছেন, কোনাে সময়ে পূর্বাৰ্জিত কোনাে কাজ পুনরায় সম্পন্ন করার ব্যর্থতাকে বিস্মৃতি বলে।
  • মনােবিদ ভাটিয়া-র মতে, মূল উদ্দীপকের সাহায্যে কোনাে ভাবনা বা ভাবনাগুলিকে চেতনমনে নিয়ে আসার ব্যর্থতাই হল ভুলে যাওয়া।
  • মনােবিজ্ঞানী রস বলেন, অভিজ্ঞতা আনন্দদায়ক, বেদনাদায়ক যাইহােক না কেন তাতে যদি আমাদের প্রক্ষোভ বা অনুভূতির স্পর্শ লেগে থাকে তবে তা বেশিদিন মনে থাকবে।

বিস্মরণের কারণ 

(1) অধীত বস্তুর গুণ: অধীত বস্তুর প্রকৃতির উপর মনে রাখা বা ভুলে যাওয়া বহুলাংশে নির্ভর করে। যেমন— অর্থ এবং ছন্দযুক্ত বিষয় (কবিতা) আমরা সহজে ভুলি না আবার অর্থহীন শব্দতালিকার ক্ষেত্রে বিস্মরণের হার অনেক বেশি।

(2) অনুশীলন বা চর্চার অভাব: অনভ্যাস বিদ্যা হ্রাসের কারণ। থর্নডাইকের সূত্রানুযায়ী উদ্দীপক প্রতিক্রিয়ার সংযােগ স্থাপনের পর বারবার চর্চা করলে শিখন দীর্ঘদিন মনে থাকে। আর চর্চা না করলে সেটি আমরা কিছুদিন পরে ভুলে যাই।

(3) প্রতিরােধ বা ইনহিবিশন:

  • পশ্চাৎসুখী প্রতিরোধ: একটি বিষয় শেখার পর বিশ্রাম না দিয়ে পরবর্তী বিষয় শিখলে দ্বিতীয় বিষয়টি প্রথম বিষয়ের স্মরণে বাধা দেয়। তাই প্রথম শেখার কিছু অংশ আমরা ভুলে যাই। একে পশ্চাৎমুখী প্রতিরােধ (Retroactive Inhibition) বলে। 
  • অগ্রমুখী প্রতিরোধ: আবার অনেকসময় এর বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়াও লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ অতীত অভিজ্ঞতা বর্তমান শিখনকে প্রভাবিত করে। একে অগ্রমুখী প্রতিরােধ বা Pro-active Inhibition বলে।
  • মস্তিষ্কের আঘাতজনিত কারণ: মস্তিষ্ক হল শিখনের সংরক্ষণাগার অর্থাৎ স্মরণক্রিয়া নির্ভর করে মস্তিষ্কের কাজের উপর। তাই মস্তিষ্ক কোনাে কারণে আহত হলে অনেক সময় স্মৃতি একেবারে লােপ পায়।

(4) আবেগজনিত বাধা: অত্যধিক আবেগঘন পরিস্থিতিতে ভালাে করে শেখা বস্তু আমরা স্মরণ করতে পারি না। যেমন— রাগ, ভয়, দুঃখ, আনন্দ ইত্যাদি আবেগের বশবর্তী হওয়ার ফলে আমরা অনেক সময় লেখা বিষয়টি ভুলে যাই।


(5) নেশাকারক বস্তু:  দীর্ঘদিন ধরে মাদক বস্তু সেবন করলে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোশগুলি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বিস্মৃতির মাত্রা বেড়ে যায়। কোনাে কিছু মনে করতে অসুবিধা হয়।

(6) অবসাদ: খুব বেশি সময় ধরে মানসিক কাজ করলে ক্লান্তি বা অবসাদ আসে। এই অবস্থায় আমরা যা শিখি তা তাড়াতাড়ি ভুলে যাই।

(7) অবদমন: মনােবিদ ফ্রয়েডের মতে, অবদমনই হল বিস্মরণের মূল কারণ। অপ্রিয়, বিরক্তিকর ঘটনা আমরা মনে রাখতে চাই না —তাই এগুলি আমরা সহজে ভুলে যাই। তবে এই সকল ঘটনার অভিজ্ঞতাগুলি আমাদের অবচেতন মনে অবদমিত থাকে যা ইচ্ছা করলে ফিরিয়ে আনা যায়।

(8) বিষয়বস্তুর কাঠিন্যমাত্রা: জটিল ও কঠিন হলে বিষয়বস্তু আয়ত্ত করার সম্ভাবনা কমে যায়। তার ফলে খুব সহজে বিস্মৃতি ঘটে।

(9) কড়া ওষুধের ক্রিয়া: নেশাকারক বস্তুর মতাে উত্তেজক ওষুধ খেলেও স্মৃতিশক্তি লােপ পেতে পারে।

(10) তীব্র শােকজনিত কারণ: গভীর শােক অর্থাৎ অত্যধিক দুঃখজনিত কারণে আমরা অনেকসময় অনেক কিছু ভুলে যাই। ডাক্তারি পরিভাষায় একে ‘অ্যামনেশিয়া’ বলে।

(11) পরিবর্তিত পরিবেশ ও পরিস্থিতি: পরিবর্তিত পরিবেশ এবং পরিস্থিতিতে আমরা অনেক সময় শেখা বিষয় স্মরণ করতে পারি না। এই কারণে বাড়িতে ভালােভাবে শেখা উত্তর পরীক্ষার হলে গিয়ে ভুলে যাই। 

(12) আগ্রহ ও মনােযােগের অভাব: সবশেষে বলা যায়, উপযুক্ত আগ্রহ ও মনােযােগের অভাবে শিখতে যেমন বেশি সময় লাগে তেমনি ভুলেও যাই তাড়াতাড়ি।

উপরােক্ত আলােচনা থেকে এটা স্পষ্টভাবে বলা যায়, বিস্মরণ হওয়াটা ক্ষতিকারক। বিস্মৃতির কারণগুলি দূর করে উত্তম স্মৃতি গঠন একান্ত প্রয়ােজন।