‘বিসর্জন’ নাটকের পটভূমি
বিসর্জন রচিত হয়েছিল মানসীর চতুর্থ পর্যায়ের পরে। তখন ‘অনন্তপ্রেম’ এর অনুভব কবিচিত্তকে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছে। বিসর্জন-এ তাই নাট্যরূপ পেয়েছে। চিরাগত প্রথায় রচিত রবীন্দ্র নাটকের মধ্যে এটিই সর্বাপেক্ষা সুগঠিত। নাট্য বিষয়ের পরিচয় প্রদান করে কবি লিখেছিলেন- “এই নাটকে বরাবর এই দুটি ভাবের মধ্যে বিরোধ বেধেছে, প্রেম আর প্রতাপ। রঘুপতির প্রভুত্বের ইচ্ছার সঙ্গে গোবিন্দমাণিক্যের প্রেমের শক্তি দ্বন্দ্ব বেধেছিল। রাজা প্রেমকে জয়ী করতে চান, রাজপুরোহিত নিজের প্রভুত্বকে। নাটকের শেষে রঘুপতিকে হার মানতে হয়েছিল। তার চৈতন্য হলো, বোঝবার বাধা দূর হলো, প্রেম হলো জয়যুক্ত।” ‘বিসর্জন’ নাটকে প্রেমের এই শক্তি প্রথম গতি পেয়েছে দেবী-মন্দিরে বলিপ্রথার বিরোধিতায়। অপর্ণা ভিখারিণী মেয়ে, তার লালিত ছাগশিশু ধরে এনে দেবীর মন্দিরে বলি দেয়া হয়েছে। রাজা গোবিন্দমাণিক্যের কাছে তাই নিয়ে সে নালিশ জানায়, দেবীমন্দিরের চত্বরে রক্ত চিহ্ন দেখে আর্তকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, জীব জননীর তৃপ্তি কি হয় জীব রক্তপাতে? তার আকুল কন্ঠ রাজার প্রেমানুভাবকে জাগরিত করে; ত্রিপুরা রাজ্যে বলি নিষেধ করে দেন তিনি। রঘুপতি দেবীর পুরোহিত; সংসারত্যাগী। মাতৃ-পিতৃহীন জয়সিংহ একাধারে তার পালিত পুত্র এবং শিষ্য। দু’জনে মিলে সংস্কার নিয়মিত পূজা-আরাধনা করে তাদের দিন কাটে। তাই বলি নিরোধের প্রস্তাবে রঘুপতি দীপ্ত হয়ে উঠেন, নিজের স্বার্থের জন্য নয়- ব্রাহ্মণ্য আদর্শের বিলুপ্তি, তথা দেবীর রোষের ভয়ে! তাই তিনি বলেন- সমস্ত রাজশক্তির বিরুদ্ধেও আমি আছি মায়ের সেবক।” সংস্কারান্ধ রঘুপতি নিজ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য যে কোনো উপায় গ্রহণ করতে প্রস্তুত। রানী গুণবতীর অন্ধ সংস্কারকে জাগিয়ে তুলে পত্নীকে তিনি পতির বিরোধী করে তোলেন। রাজার পুত্রতুল্য অনুজ নক্ষত্র রায়কে তপ্ত করে তোলেন বিদ্রোহ ও নর হত্যার পথে। প্রজাদের মধ্যে রচনা করতে চান অন্ধ বিপ্লব। রাজা গোবিন্দমাণিক্য আঘাত পান স্ত্রীর কাছে, ভাইয়ের কাছে, বাইরে পরিজনদের কাছে। তবু তিনি নিঃসংশয়। কেবল দ্বিধা-সংশয়ের যন্ত্রণায় মর্মে মর্মে অধীর হয়ে ফেরে জয়সিংহ। একদিকে তার আজন্মের সংস্কার আর গুরুভক্তি তাকে টানে হিংসার পথে, আর একদিকে ক্ষণে ক্ষণে প্রেমময়ী অপর্ণা এসে মনকে দোলা দিয়ে ডাক দেয়- “জয়সিংহ চলে এস এ মন্দির ছেড়ে।” সংস্কার ও শক্তির অন্ধতা বিদীর্ণ করে প্রেমের মুক্ত তুলিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে নেবার এ আহ্বানে। কিন্তু জয়সিংহ আজন্ম দুর্বল। নিজের শক্তিতে ভর করে দাঁড়াবার সাধ্য তার নেই, তাই ভিতরে বাইরে সংশয়ের দ্বন্দ্বে সে ক্ষত-বিক্ষত। অবশেষে সকল জ্বালার অবসান হয় দেবীমন্দিরে তার আত্মহত্যায়; জয়সিংহ নিজের বক্ষে ছুরিকাবিদ্ধ করে; এই যেন শেষ রক্ত হয় মাতা।’
জয়সিংহের মৃত্যুতে রঘুপতির আযৌবন স্নেহাতুর পিতৃ-চেতনার চরম আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে প্রেমের সত্যকে প্রথম সম্পূর্ণ প্রত্যক্ষ করে। পাষাণী মূর্তিকে নদীজলে বিসর্জন দিয়ে অপর্ণার হাত ধরে তিনি বেরিয়ে আসেন মুক্ত পথে। জয়সিংহের আত্মবিসর্জনের মধ্য দিয়ে রাণী গুণবতীরও সংস্কার মুক্তি ঘটে- মুক্ত প্রেমের পূর্ণরূপ অনুভব করে রাজার কাছে আত্মসমর্পণ করেন তিনি। উভয়ে পরস্পরের মধ্যে প্রেমের শাশ্বত শুদ্ধ রূপকে নতুন করে আবিষ্কার করেন। এখানেই তার সার্থকতা।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment