আধুনিক কবিতার বহুবিধ লক্ষণের মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি লক্ষণ ছিল রবীন্দ্রনাথের ভাব-ভাষা ও ভঙ্গি থেকে মুক্তি। অন্যান্য আধুনিক কবিদের মতো প্রথম জীবনে বিষ্ণু দে-রও প্রত্যয় ছিল যে, বাংলা কাব্যের মুক্তি রবীন্দ্র-অনুসরণে নয়। এলিয়টের পৃথিবী বিষ্ণু দের মানস-পটভূমিকে প্রভাবিত করেছিল সন্দেহ নেই। যুদ্ধ তাড়িত পৃথিবী, সেই পৃথিবীর রুক্ষতা, বিকার, পচন বিষ্ণু দের পরিশীলিত অনুভূতিপ্রবণ চিত্তকে আলোড়িত করেছিল, যেখানে রাবীন্দ্রিক পেলবতা, তাঁর প্রেম-সৌন্দর্যময় ভাবলোকের বিন্যাস বড় বেশি কৃত্রিম বলে মনে হয়েছিল। তাই প্রথম দিকের কবিতায় তিনি লিখেছিলেন-

‘হেথা নাই সুশোভন রূপদক্ষ রবীন্দ্রঠাকুর।’

রাবীন্দ্রিক রোমান্সের আতিশয্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেও মার্কসীয় চিন্তায় উদ্বুদ্ধ তাঁর দ্বান্দ্বিক সময়েও শেষ পর্যন্ত বিন্নু দে নেতিবাদ ও নৈরাশ্যকে অতিক্রম করে মানুষ ও জীবনের সুস্থ বিকাশ ও বিজয়ে বিশ্বাস করেন। এবং এই কারণেই শেষ পর্যন্ত বিষ্ণু দে ফিরে আসেন রবীন্দ্র প্রতিভার ও তাঁর চৈতন্যের সমুন্নত ঐশ্বর্যের কাছে। অন্তত তাঁর মনে হয়েছে এই প্রতিকূল পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথ মানবতার শিখাটিকে আমৃত্যু সন্তর্পণে রক্ষা করার ব্রত নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন –

‘আমাদের দুর্ভাগা দেশের আত্ম অপমানকর বহু বঞ্চনার মধ্যেও সৌভাগ্যবশত এই পর্বের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার স্বর্গমর্ত্যপাতালে অভিযান করে গেছেন অন্তত কয়েকজন মহীয়ান পুরুষ। রাজনীতির চারিত্রিক ক্ষেত্রে যেমন গান্ধীজী, সংস্কৃতির ব্যক্তিক ও সামাজিক সর্বক্ষেত্রে তেমনি রবীন্দ্রনাথ। বস্তুত রবীন্দ্রনাথই আমাদের দেশে শিল্পসাহিত্য তো বটেই, দেশের সমস্ত সংস্কৃতি, মানবজীবন ও কর্মের আধুনিকতার আদি ও মৌলিক দৃষ্টান্ত। তাঁর মতো আত্মপরিচয়লাভের আকৃতি অথবা সত্তা সংকটের তীব্রতা ও ব্যপ্তিবৈচিত্র্যে বোধহয় বিশ্বে তুলনারহিত….।”

বিষ্ণু দে-র ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘দামিনী’ কবিতাতেও কবির রবীন্দ্র-সাহিত্য অনুধ্যানের এক স্পষ্ট স্বাক্ষর চিহ্নিত হয়ে আছে। প্রত্যক্ষভাবে রবীন্দ্র-চেতনা নয়, রবীন্দ্র-সৃষ্ট একটি চরিত্রের জীবন-সন্ধানের তীব্র অর্তিকেই এখানে কবি বিষ্ণু দে-কে আবিষ্ট করেছে।

‘দামিনী’ কবিতাটির মর্মকথা অনুধাবন করতে গেলে আবশ্যিকভাবেই রবীন্দ্রসৃষ্ট চরিত্রটিকে তথা রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসটির পাঠ প্রয়োজন।

‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসটি সবুজপত্রে ১৩২১ বঙ্গাব্দে চারটি পৃথক নামে প্রকাশিত হয়েছিল। তার মধ্যে তৃতীয় পর্ব তথা কাহিনীটির নাম ছিল ‘দামিনী’। ‘চতুরঙ্গ’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২৩ বঙ্গাব্দে। ‘চতুরঙ্গ’, ‘শেষের কবিতা’ প্রভৃতি রবীন্দ্র উপন্যাস তৎকালীন আধুনিক কবিদেরও সচকিত করেছিল উপস্থাপনার অভিনবত্বে ও বিষয়ের চমৎকারী শক্তিতে। বিষ্ণু দে-ও রবীন্দ্রনাথের এই দুই উপন্যাসের আধুনিকতায় তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। সমগ্র রবীন্দ্র-জীবনদর্শনের গভীরে যে বিশ্ববীক্ষা, আশ্চর্যভাবে তা বিষ্ণু দে-র জীবনবোধকেও পরিণত হতে সহায়ক হয়েছিল। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের দামিনী চরিত্রের মধ্যে কবি বিষ্ণু দে জীবন-পিপাসার যে তীব্র মূর্তি দেখেছিলেন, দেখেছিলেন যে জীবনের প্রাণময় অর্থ সন্ধানের আকুলতা,—সেই জীবন-পিপাসা একদিকে যেমন রবীন্দ্র-জীবনভাবনার অন্তর্গত, অন্যদিকে তা বিঘ্ন দেরও অন্বিষ্ট। দামিনী চরিত্রের সঙ্গে নিজ কবি-স্বভাবের একাত্মবোধের স্বীকারোক্তিই উচ্চারিত ‘দামিনী’ কবিতায়।

‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের গঠন-শৈলীর মধ্যেই রয়েছে বিভিন্ন আয়তনে বিবিধ পন্থায় জীবনের সত্য বা স্বরূপ আবিষ্কারের একটা পরীক্ষা। উপন্যাসের নায়ক শচীশ যেমন নির্ভেজাল বুদ্ধিবাদ, ভক্তিসর্বস্ব রসবাদ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে জীবনকে খুঁজেছে, উপন্যাসটির গঠনও সেই বৃত্ত থেকে বৃত্তান্তরে চলমান জীবনের অনুসারী। উপন্যাসের তৃতীয় পর্বের নাম ‘দামিনী’ এবং সেই দামিনী চরিত্রই এই পর্বের এবং উপন্যাসের অবশিষ্টাংশের কেন্দ্রবিন্দু।

দামিনীকে আমরা দেখেছি লীলানন্দ স্বামীর বৃত্তে একমাত্র বিদ্রোহী সত্তা হিসাবে। ভক্তিরসে মাতোয়ারা অন্ধ মত্ত জীবন প্রবাহের মধ্যে সে এসেছে রক্ত মাংসের জৈবিক দাবী নিয়ে, যেখানে জীবন মায়ামাত্র বলে স্বীকার্য নয় ও জীবনলীলা বিদেহী অপ্রাকৃত আইডিয়া বা তত্ত্বমাত্রও নয়। তাই লীলানন্দ স্বামীর ভক্তিরসপ্রবাহের মত্ততায় দামিনী আত্মসমর্পণ করেনি কখনো। ননীবালার মতো ভবিতব্যের কাছেও সে আত্মসমর্পণ করেনি। বঙ্কিমচন্দ্রের শৈবলিনীর মতো ধর্ম হোক, সামাজিক বোধ হোক বা প্রেম হোক সবই সে দেখেছে উয় মৃত্তিকার সঙ্গে সংলগ্ন থেকে। লীলানন্দের আশ্রমের ছক উদ্ধৃত বিদ্রোহে ভাঙার ফলে শচীশও অনুভব করেছিল দামিনীর স্বরূপ—’দামিনীর মধ্যে নারীর আর এক বিশ্বরূপ দেখিয়াছি। সে নারী মৃত্যুর কেহ নয়, সে জীবন রসের রসিক….সে সন্ন্যাসীকে ঘরে স্থান দিতে নারাজ, সে উত্তুরে হাওয়াকে সিকি পয়সা খাজনা দিবে না পণ করিয়া বসিয়াছে।

দামিনী—বিধবা দামিনী তার অদ্যম জীবন-পিপাসার তাড়নাতেই শচীশকে তার জীবনে চেয়েছিল। ননীবালার পবিত্রতা-বোধ মৃত্যুবরণের মধ্য দিয়ে প্রস্ফুটিত হলেও দামিনীর প্রকৃতি সে ধাতুতে গড়া নয়। সে বুদ্ধিবাদ কিংবা ভক্তিবাদের তত্ত্বদর্শনে ছকে জীবনকে বাঁধতে চায়নি শচীশের মতো। সে চেয়েছিল নির্ভেজাল জীবনরসের পাত্রে পরিতৃপ্ত ওষ্ঠস্থাপন করতে। তাই শচীশকে সে লীলানন্দের ছক থেকে বাইরে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু যখন দামিনী দেখেছে, মর্ত্য-কামনার আগুন শচীশকেও দগ্ধ করছে, তখন সে চায়নি যে, শচীশ নিতান্ত হীন জৈবকামনার দহনে তার সাধনার পথ থেকে বিচ্যুত হোক। তাই সে শচীশের পদপ্রান্তে লুণ্ঠিত হয়ে তাকে গুরু পদে বরণ করে নেয়। শেষে শচীশকে মহত্ত্বের সীমায় সাধনার পথে অবিচল রাখতেই সে বিবাহ করে শ্রীবিলাসকে।

কিন্তু পশ্চিম সমুদ্রতীরে গৃহামধ্যে কামনাময় যে রোমশ জন্তুটি শচীশের আঘাতে আহত হয়েছিল, সেই আঘাতই দামিনীকে ক্রমে অসুস্থ করে তুলল। শচীশ-দামিনীর দাম্পত্য জীবন যখন পূর্ণিমা জ্যোৎস্নার মতো কুলপ্লাবী হয়ে জীবনরস সম্ভোগের বাসনা পূর্ণ করে তুলছে, তখনই বুকের সেই গোপন ব্যথায় মৃত্যুমুখী হয়েছে দামিনী। সে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে পশ্চিমের সেই সমুদ্র উপকূলে যাবার। সেখানে এক ফাল্গুনী পূর্ণিমায় মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবন-পিপাসু দামিনী জন্মান্তরে প্রেমের পূর্ণিমা জ্যোৎস্না অবগাহনের বাসনা প্রকাশ করেছিল— ‘যেদিন মাঘের পূর্ণিমা ফাল্গুনে পড়িল, জোয়ারে ভরা অশ্রুর বেদনায় সমস্ত সমুদ্র ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল, সেদিন দামিনী আমার পায়ের ধূলা লইয়া বলিল, সাধ মিটিল না, জন্মান্তরে আবার যেন তোমাকে পাই।’

দামিনীর এই অপরিতৃপ্ত জীবন পিপাসাই শ্রীবিলাসকে অবশিষ্ট জীবন এক নূতনতর জীবনবোধে উদ্দীপ্ত রেখেছিল। জীবন যে তত্ত্বমাত্র নয় এবং জীবন যে ‘স্বৰ্গখেলনা’ বা কামলীলার পাদপীঠমাত্র নয়-একথা অনুভব করতে হয়েছিল শ্রীবিলাসকে— ‘আমি যাহাকে পাইলাম সে গৃহিণী হইল না, সে মায়া হইল না, সে সত্য রহিল, সে শেষ পর্যন্ত দামিনী। কার সাধ্য তাহাকে ছায়া বলে।’

অতএব ‘দামিনী’ কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে রবীন্দ্র-সাহিত্য, বিশেষত ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট জানা জরুরী। বিষ্ণু দের কবিতার পাঠক মাত্রেই জানেন যে, তাঁর কবিতায় সুধীন্দ্রনাথের কবিতার মতোই মিশে থাকে দেশী-বিদেশী পুরাণ ও সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ। রবীন্দ্রসাহিত্যের নিবিড় পাঠও যে কখনো কখনো তাঁর কবিতার বিষয় নির্মাণের অন্তপ্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে, তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ‘দামিনী’ কবিতাটি। দামিনী চরিত্র তথা ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের পাঠের উজ্জ্বল স্বাক্ষর মুদ্রিত হয়ে আছে বিষ্ণু দে-র ‘দামিনী’ কবিতায়।